নুপা আলম, কক্সবাজার
প্রকাশ : ২৫ আগস্ট ২০২৪ ১৬:২৯ পিএম
বাংলাদেশ ও মিয়ানমার দুই রাষ্ট্রেই উদ্ভূত পরিস্থিতির কারণে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া নিয়ে আলোচনার ক্ষেত্রে জটিলতা দেখা দিয়েছে। ফলে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়াও অনেকটা অনিশ্চয়তার দিকে যাত্রা শুরু করে দিয়েছে এবং নতুন করে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। এ ব্যাপারে রাষ্ট্রকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে ভাবার পরামর্শ দিয়েছেন অভিবাসন ও শরণার্থী বিশেষজ্ঞ আসিফ মুনীর। গতকাল শনিবার দুপুরে তিনি এ কথা বলেন।
প্রসঙ্গত, আজ ২৫ আগস্ট। সাত বছর আগে ২০১৭ সালের এ দিনে কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফ এবং বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্ত দিয়ে ব্যাপক হারে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের ঘটনা ঘটে। এ সময় আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা আইওএমের কর্মকর্তা হিসেবে কর্মরত ছিলেন আসিফ মুনীর। তিনি খুব কাছ থেকে দেখেছেন রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের দৃশ্য। অভিবাসন ও শরণার্থী প্রক্রিয়া নিয়ে দেশে-বিদেশে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করার অভিজ্ঞতার আলোকে তিনি মনে করছেন, রোহিঙ্গা সমস্যা ক্রমাগত জটিল হয়ে উঠছে।
আসিফ মুনীর বলেন, ‘গত ছয় বছর রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে বাংলাদেশ-মিয়ানমারে কিছুটা আলাপ-আলোচনা হলেও গত এক বছর ধরে তা বন্ধ রয়েছে। মিয়ানমারের অভ্যন্তরে বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মির সঙ্গে জান্তা সরকারের যুদ্ধের কারণে এ আলোচনা বন্ধ হয়ে যায়। এর মধ্যে বাংলাদেশে ছাত্র আন্দোলনের পর সরকার পরিবর্তনের ঘটনা ঘটেছে। নতুন প্রেক্ষাপটে রোহিঙ্গা নিয়ে আলোচনার জন্য নতুনভাবে কূটনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ জরুরি হয়ে উঠেছে। কারণ এ পরিস্থিতিতে প্রত্যাবাসন কোনোভাবেই হচ্ছে না।’
তিনি বলেন, ‘এর মধ্যে কিছু কিছু রোহিঙ্গার অনুপ্রবেশের তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। একই সঙ্গে সীমান্তে অনেকেই অনুপ্রবেশের জন্য অপেক্ষা করছে বলে গণমাধ্যমে খবর আসছে। যা বাংলাদেশের জন্য আরও উদ্বেগজনক।’
রোহিঙ্গা নেতারা যা ভাবছেন
এ পরিস্থিতিতে প্রত্যাবাসন কোনোভাবে সম্ভব না বলে মনে করছেন রোহিঙ্গা নেতারাও। উখিয়ার কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্পের কমিউনিটি নেতা রজ্জাক আলী বলেন, ‘মিয়ানমারে আরাকান আর্মি ও জান্তার লড়াইয়ের কারণে মংডু শহর এবং তার আশপাশে থাকা কয়েক লাখ রোহিঙ্গার জীবন এখন বিপন্ন। ওখানে রোহিঙ্গাদের ঘর থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। জীবন বাঁচাতে তারা এদিক-ওদিক ছুটছে। অনেকেই হতাহত হচ্ছে। অনেক মরদেহ নাফ নদ দিয়ে এপারেও ভেসে আসছে। অনেকেই গোপনে সীমান্ত অতিক্রম করে এপারে পালিয়ে এসেছে। এ পরিস্থিতিতে মিয়ানমারে রোহিঙ্গারা ফিরতে পারবে না।’
এই রোহিঙ্গা নেতার দেওয়া তথ্যের সঙ্গে মিলে যায় টেকনাফ ও উখিয়ার সীমান্তবর্তী মানুষের দেওয়া তথ্যও। সীমান্তের ছয়-সাতজন জনপ্রতিনিধি নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানিয়েছেন, সীমান্তরক্ষী বিজিবি বা রোহিঙ্গা ক্যাম্পসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা স্বীকার করুক বা না করুক সীমান্ত দিয়ে গত এক মাসে কম হলেও কয়েক হাজার রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ করেছে। এসব রোহিঙ্গার একটি অংশ সীমান্তরক্ষীরা আটক করলেও বেশিরভাগই ক্যাম্পসহ বিভিন্ন স্থানে গোপনে আশ্রয় নিয়েছে। এখনও সীমান্তের অন্তত ২০টি পয়েন্ট দিয়ে নাফ নদের পাড়ে রোহিঙ্গারা অনুপ্রবেশের চেষ্টায় অপেক্ষা করছে। অনেকে অনুপ্রবেশকালে নৌকা ডুবে মারাও যাচ্ছে।
এক মাস ধরে টেকনাফের নাফ নদের সীমান্ত দিয়ে অসংখ্য মরদেহ এপারে ভেসে এসেছে। যে মরদেহগুলো আল মানাহিল ওয়েলফেয়ার ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ নামের একটি সংস্থার মাধ্যমে স্থানীয়ভাবে দাফন করা হয়।
ওই সংস্থার কর্মী মাহবুব আলম মিনার বলেন, ‘আমাদের ফাউন্ডেশন মরদেহ উদ্ধার করে দাফন করছে। গত এক সপ্তাহে আমরা মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা গুলিবিদ্ধ ও নৌকাডুবিতে নিহত ২৮৬ জনের মরদেহ দাফন করেছি। তার মধ্য সবচেয়ে বেশি ছিল শাহপরীর দ্বীপে।’
যে কারণে অনুপ্রবেশ অব্যাহত রয়েছে
গত ফেব্রুয়ারি থেকে বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী রাখাইন রাজ্য ঘিরে আরাকান আর্মির সঙ্গে জান্তার তীব্র লড়াই অব্যাহত রয়েছে। ইতোমধ্যে মংডু শহর ছাড়া পুরো রাজ্যই আরাকান আর্মির নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার তথ্য মিলেছে। এখন মংডু শহর দখলের জন্য লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে আরাকান আর্মি। এতে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ হচ্ছে বাংলাদেশে।
সম্প্রতি আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম এএফপির এক প্রতিবেদন নতুন করে ২০১৭ সালের মতো রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের আশঙ্কার পাশাপাশি নাফ নদে মরদেহ উদ্ধারের তথ্য জানিয়েছে। প্রতিবেদনটি কিছু রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের তথ্যও দিয়েছে। এই প্রতিবেদনে শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মোহাম্মদ মিজানুর রহমান কিছুসংখ্যক রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ হয়ে থাকতে পারে বলে মন্তব্য করেছেন। গতকাল শনিবার এ ব্যাপারে মোহাম্মদ মিজানুর রহমানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি ফোন ধরেননি। এদিকে বিজিবি ও কোস্ট গার্ডের পক্ষ থেকে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ঠেকাতে সীমান্তে নজরদারি ও টহলদারি বাড়ানোর কথা বলা হচ্ছে।
সশস্ত্র গোষ্ঠীর তৎপরতায় অস্থিতিশীল ক্যাম্প
এ পরিস্থিতিতে কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফের ৩৩টি রোহিঙ্গা ক্যাম্প অস্থিতিশীল হয়ে উঠেছে। এসব ক্যাম্পকেন্দ্রিক সশস্ত্র গোষ্ঠীর তৎপরতাও বেড়েছে। গত দুই মাসে এসব ক্যাম্পে অভিযান চালিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা অন্তত ১০টি জি-থ্রি রাইফেলসহ বিদেশি আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার করেছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষে বলা হয়েছে, মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষী বিজিপি এ ধরনের অস্ত্র ব্যবহার করে থাকে। মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ সংঘাতে বিজিপি পালিয়ে যাওয়ার সুযোগে এসব অস্ত্র রোহিঙ্গাদের কাছে পৌঁছে গেছে।
কক্সবাজার জেলা পুলিশের তথ্যমতে, ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পর থেকে ২০১৪ সালের জুলাই পর্যন্ত ১১ ধরনের অপরাধে রোহিঙ্গা ক্যাম্পকেন্দ্রিক ৩,৮৩২টি মামলা হয়েছে। যার মধ্যে খুনের ঘটনায় মামলা হয়েছে ২৩৫টি। এর মধ্যে জানুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত খুনের মামলা হয়েছে ৩২টি। এই সাত মাসে অস্ত্র উদ্ধারের মামলা ৯৪টি, মাদকের মামলা ১৬০টি।
কক্সবাজারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন) মো. রফিকুল ইসলাম জানিয়েছেন, রোহিঙ্গা ক্যাম্পকেন্দ্রিক মামলার পরিসংখ্যান মতে, ২০১৭ সালে ৭০, ২০১৮ সালে ২৪৯, ২০১৯ সালে ২৫৯, ২০২০ সালে ৩৪৯, ২০২১ সালে ৬২৪, ২০২২ সালে ১,১৩৯ এবং ২০২৩ সালে ৬৮৩টি মামলা হয়েছে। এ ছাড়া গত সাত মাসে ২৩৫টি মামলার মধ্যে অস্ত্র ও খুনের মামলাগুলো তদন্তের সময় দেখা গেছে সশস্ত্র গোষ্ঠীগত সংঘাত কিছুটা বেড়েছে। ক্যাম্পের নিরাপত্তায় থাকা এপিবিএন পুলিশ, জেলা পুলিশ অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সমন্বয়ে এসব অপরাধ নিয়ন্ত্রণে কাজ করে যাচ্ছে।
গত সাত মাসে ৩২টি খুনের মামলার বিপরীতে নিহতের সংখ্যা ৪৫ জন। এসব খুনের ঘটনা বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের সশস্ত্র সংগঠন আরসা এবং আরএসওর মধ্যে বিরোধের জের ধরে খুন হয়েছে ৩৯ জন। বাকি ছয়টি খুনের ঘটনা অন্য রকম। রোহিঙ্গাদের এই দুই সশস্ত্র গোষ্ঠীর আধিপত্য বিস্তার ও নিয়ন্ত্রণকে কেন্দ্র করে এসব খুনের ঘটনা ঘটেছে। অস্ত্র উদ্ধারের ঘটনায় গ্রেপ্তার ১৬৬ জনই ওই দুই সংগঠনের সদস্য বলে জানিয়েছে পুলিশ।
পুলিশ বলছে, মিয়ানমারের অভ্যন্তরে সংঘাতের কারণে রোহিঙ্গা ক্যাম্পেও অস্থিরতা বেড়েছে। মিয়ানমার থেকে এপারে অস্ত্র আনার প্রমাণও মিলেছে অভিযানে। এসব কারণে প্রত্যাবাসন অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। পরিস্থিতি বিবেচনায় ক্যাম্পকেন্দ্রিক নজরদারি বাড়াতে ও সশস্ত্র গোষ্ঠী নিয়ন্ত্রণে সর্বোচ্চ সজাগ থাকার কথা বলেছেন অভিবাসন ও রোহিঙ্গা বিশেষজ্ঞ আসিফ মুনীর।
তিনি বলেছেন, ‘ক্যাম্পকেন্দ্রিক কোনো অপরাধ যেন না হয়, সেদিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব না দিলে বাংলাদেশের জন্য সশস্ত্র রোহিঙ্গা গোষ্ঠী হুমকি হয়ে উঠতে পারে।’