সুবল বড়ুয়া, চট্টগ্রাম
প্রকাশ : ২৪ আগস্ট ২০২৪ ১৭:৪৯ পিএম
চট্টগ্রামের ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড় থেকে লোকজনকে সরে যেতে মাইকিং করছে জেলা প্রশাসন। প্রবা ফটো
গত ১৭ বছরে পাহাড়ধসে তিন শতাধিক প্রাণহানি হওয়ার পরও থামেনি পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণ বসতি। ‘জীবন ঝুঁকি’ সঙ্গে নিয়ে এখনও চট্টগ্রাম মহানগরীতে সরকারি ও বেসরকারি মালিকানাধীন ২৬টি পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাস করছেন ছয় হাজার ৫৫৮টি পরিবার। এসব দেখভালের দায়িত্বে নিয়োজিত পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটির কার্যকরী উদ্যোগ নেই। শুধুমাত্র বর্ষা এলেই টনক নড়ে তাদের। মাইকিং করে দায় সারে প্রশাসন। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণ বসতি ঠেকাতে বারংবার উচ্ছেদ অভিযান করলেও পুনরায় তারা সেখানে বসতি স্থাপন করে।
চট্টগ্রাম মহানগরীর ২৬টি পাহাড়ের মধ্যে সরকারি বিভিন্ন সংস্থার ১৬টি এবং ব্যক্তি মালিকানাধীন পাহাড় ১০টি। এর মধ্যে বাংলাদেশ রেলওয়ের মালিকানাধীন রয়েছে সাতটি পাহাড়। জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের দুটি, গণপূর্ত বিভাগ-৩-এর একটি, আমিন জুট মিলের একটি, ১নং খাস খতিয়ানভুক্ত পাহাড় রয়েছে তিনটি, এপি রয়েছে একটি এবং ব্যক্তি মালিকানাধীন রয়েছে ১১টি পাহাড়। ঝুঁকিপূর্ণ এই ২৬টি পাহাড়ে এবং পাহাড়ের পাদদেশে অবৈধভাবে ছয় হাজার ৫৫৮টি পরিবার বসবাস করছে।
অভিযোগ রয়েছে, স্থানীয় প্রভাবশালী ভূমিদস্যু, বিভিন্ন দলীয় নেতা ও পাহাড় মালিকদের যোগসাজশে এসব পাহাড়ের পাদদেশে এতগুলো পরিবার ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাস করছে।
চট্টগ্রামসহ সারা দেশে বিরূপ আবহাওয়ার কারণে গত এক সপ্তাহ ধরে ভারী বৃষ্টিপাত হচ্ছে। ইতোমধ্যে চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি, হাটহাজারী, রাউজান, খাগড়াছড়ি, ফেনী, নোয়াখালী, কুমিল্লাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ভয়াবহ বন্যা দেখা দিয়েছে। এতে পতেঙ্গা আবহাওয়া অফিস থেকে পাহাড়ধসের আশঙ্কা থাকার কথা জানিয়েছে।
এই আশঙ্কা থেকেই চট্টগ্রামে ১৭ বছর আগে গঠিত পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটি নগরীতে বিদ্যমান ২৬টি পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাসরতদের সরে যেতে গত বৃহস্পতিবার থেকে মাইকিং করতে দেখা গেছে। কিন্তু এতদিন ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাসরতদের নিয়ে সরানো নিয়ে কোনো কার্যকরী উদ্যোগ নেয়নি। অভিযোগ রয়েছেÑ পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটি শুধুমাত্র বর্ষা এলেই দায়সারা একটি সভা করেই তাদের দায় সারেন।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে চট্টগ্রামের পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্য সচিব ও চট্টগ্রামের ভারপ্রাপ্ত জেলা প্রশাসক ও এডিসি (রাজস্ব) রাকিব হাসান প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, ‘পাহাড়ধস ঠেকাতে গত দুই দিন ধরে মাইকিং করা হচ্ছে। ঝুঁকিপূর্ণভাবে পাহাড়ের পাদদেশে বসবাসরত তিন শতাধিক বাসিন্দাকে ইতোমধ্যে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি ঝুঁকিপূর্ণ বসতি ঠেকাতে জেলা প্রশাসন উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করে থাকে। কিন্তু এরপরও ওরা সেখানে আবারও বসতি গড়ে তোলে। ইতোমধ্যে পাহাড়ের পাদদেশ থেকে নিয়ে বেশ কিছু পরিবারকে আশ্রয়ণ প্রকল্পে পুনর্বাসন করা হয়েছে।’
জীবন ঝুঁকি জেনেও স্থানীয় ভূমিদস্যুদের পকেট ভারী করতেই নগরীর ২৬টি পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাস করাচ্ছে বলে জানিয়েছেন সচেতন নাগরিক কমিটি (সনাক) চট্টগ্রামের সভাপতি অ্যাডভোকেট আখতার কবির চৌধুরী। ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটি করা হয়েছে পাহাড় দেখভাল করার জন্য। যথাযথভাবে দায়িত্ব পালন করলে পাহাড়ে এতগুলো পরিবার জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বসবাস করতে পারত না। মূলতÑ স্থানীয় ভূমিদুস্য, পাহাড়ের জমিদার এবং কিছু অসাধু ব্যক্তির পকেট ভারী করতেই এসব বিষয়ে স্থায়ী উদ্যোগ নিচ্ছে না। এবার এসব বিষয়ে হাত দেওয়া প্রয়োজন। নয়তো আর কত শত প্রাণহানি হলে পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণ বসতি কমবে?
২০০৭ সালের ১১ জুন চট্টগ্রাম মহানগরীতে পাহাড়ধসে এক দিনে ১২৭ জনের প্রাণহানি হয়েছিল। মর্মান্তিক এই প্রাণহানির পর নগরীসহ চট্টগ্রাম, কক্সবাজার এবং তিন পার্বত্য জেলা নিয়ে একটি শক্তিশালী পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটি গঠিত হয়েছিল। এই কমিটি ইতোমধ্যে ১৭ বছর পার করলেও কার্যকরী কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করেননি। অথচ এই ১৭ বছরে নগরীসহ চট্টগ্রাম, কক্সবাজার ও তিন পাবর্ত্য জেলায় পাহাড়ধসে তিন শতাধিক প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে। আর অথচ এখনও চট্টগ্রাম মহানগরীর ঝুঁকিপূর্ণ ২৬টি পাহাড়ে অবৈধভাবে ছয় হাজার ৫৫৮টি পরিবার বসবাস করছে।
পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটির তথ্যানুসারে, নগরীর ২৬টি পাহাড়ের মধ্যে বাংলাদেশ রেলওয়ের মালিকানাধীন সাতটি পাহাড়ের মধ্যেÑ ফয়েজলেক এলাকার ১, ২ ও ৩নং ঝিল সংলগ্ন পাহাড়ের পাদদেশে চার হাজার ৪৪৬টি পরিবার, মতিঝর্ণা ও বাটালি হিল সংলগ্ন পাহাড়ে ৪৩১টি পরিবার, পরিবেশ অধিদপ্তর সংলগ্ন পাহাড়ে ৪৬টি, লেকসিটি আবাসিক এলাকা সংলগ্ন বিজয়নগর পাহাড়ে ২৮৮টি পরিবার, পলিটেকনিক হল্ট স্টেশন সংলগ্ন পাহাড়ের পাদদেশে ১২টি পরিবার, ক্যান্টনমেন্ট এলাকার ফৌজি ফ্লাওয়ার মিল সংলগ্ন পাহাড়ে ৫টি পরিবার, ষোলশহর স্টেশন সংলগ্ন পাহাড়ে ৭৪টি পরিবার অবৈধ ও ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাস করছে।
গণপূর্ত বিভাগ-৩ এর মালিকানাধীন পাহাড়ে বাটালি হিল ও মতিঝর্ণা অংশের পাহাড়ে ৮৮টি পরিবার, জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের দুটি পাহাড়ের মধ্যে ফিরোজ শাহ হাউজিং এস্টেট সংলগ্ন পাহাড়ের পাদদেশে ৪৯টি ও কৈবল্যধাম হাউজিং এস্টেট সংলগ্ন পাহাড়ের পাদদেশে ১৪৬টি পরিবার বসবাস করছে।
১নং খাস খতিয়ানভুক্ত তিনটি পাহাড়ের মধ্যে জয়ন্তিকা আবাসিক সংলগ্ন উত্তর পাহাড়তলী এলাকার খাস খতিয়াভুক্ত পাহাড়ে ২৮টি পরিবার, গার্ডেন ভিউ সোসাইটি সংলগ্ন খাস খতিয়ানভুক্ত পাহাড়ে ১২টি পরিবার, আকবর শাহ বেলতলী পাহাড়ে ৮৯টি পরিবার ও পলিটেকনিক কলেজ সংলগ্ন পাহাড়ে ৪৩টি পরিবার বসবাস করছে।
এ ছাড়াও ব্যক্তি মালিকানাধীন ১১টি পাহাড়ের মধ্যে-লালখানবাজার জামেয়াতুল উলুম মাদ্রাসা সংলগ্ন পাহাড়ে ৩২৩টি পরিবার, হারুন সাহেবের পাহাড়ে ১৪৪টি পরিবার, নাছিয়াঘোনা এলাকার পাহাড়ে ১২টি, চিড়িয়াখানার পেছনের পাহাড়ে ২৮টি, মধুশাহ পাহাড়ে ২৯টি, জালালাবাদ সংলগ্ন পাহাড়ে ৫টি, নাগিন পাহাড়ে ২৫টি, ফরেস্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউট সংলগ্ন মীর মোহাম্মদ হাসানের পাহাড়ে ৩৮টি, এমআর সিদ্দকীর পাহাড়ে ৪২টি, মিয়ার পাহাড়ে ৪৯টি এবং রৌফাবাদ ও অক্সিজেন এলাকার ভেড়া ফকিরের পাহাড়ে ১১টি পরিবার অবৈধভাবে বসবাস করছে।