আমানত উল্যাহ, কমলনগর (লক্ষ্মীপুর)
প্রকাশ : ২৪ আগস্ট ২০২৪ ১৭:২৭ পিএম
কয়েক দিনের অস্বাভাবিক জোয়ার ও টানা বুষ্টিতে পানিবন্দি হয়ে পড়েছে লক্ষাধিক মানুষ। বৃহস্পতিবার কমলনগরের চরমার্টিনে। প্রবা ফটো
নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ থেকে লক্ষ্মীপুর সদর, কমলনগর ও রামগতি উপজেলার ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে মেঘনা নদীতে পড়েছে ভুলুয়া নদী। ৭১ কিলোমিটার দীর্ঘ এ নদীর গড় প্রস্থ ছিল ৫০০ মিটার। দখল, অবৈধ বাঁধ নির্মাণ আর পলি জমে নদীর এখন গড় প্রস্থ দাঁড়িয়েছে ৮৫ মিটারে। নদীটি খনন না হওয়ায় শুষ্ক মৌসুমে হেঁটেই পার হওয়া যায়। আর বর্ষা মৌসুমে এ অঞ্চলের লক্ষাধিক মানুষ থাকে পানিবন্দি। তাই রামগতি-কমলনগরের মানুষের দুঃখ এই ভুলুয়া নদী।
স্থানীয়রা জানায়, অবৈধ দখল আর প্রভাবশালীদের বাঁধ নির্মাণের কারণে ভুলুয়া নদীতে এখন আর জোয়ার-ভাটা নেই। এতে করে ইরি-বোরো আবাদ করতে পারছেন না কৃষকেরা। আবার বাঁধের কারণে বর্ষায় সৃষ্টি হয় জলাবদ্ধতা। এতে দুই মৌসুমেই ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয় এ অঞ্চলের মানুষের।
গত বৃহস্পতিবার সরেজমিনে দেখা গেছে, গত কয়েক দিনের অস্বাভাবিক জোয়ার ও টানা বৃষ্টিতে সৃষ্ট বন্যায় রামগতি-কমলনগরের লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। টানা বৃষ্টি ও পূর্ণিমার প্রভাবে সৃষ্ট জোয়ারের পানিতে রামগতি উপজেলার চরগাজী, চররমিজ, চরআলগী, চরপোড়াগাছা ও চরবাদাম ইউনিয়নের প্রায় ১৫টি গ্রাম জলমগ্ন। এর মধ্যে চরপোড়াগাছা ও চরবাদাম ইউনিয়ন পুরোটাই পানির নিচে।
আর কমলনগর উপজেলার চরকাদিরা, চরলরেন্স, তোরাবগঞ্জ ও হাজিরহাট ইউনিয়নের অন্তত ১২টি গ্রাম পানিতে ডুবে রয়েছে। মাঠের মধ্যে যত দূর চোখ যায় কেবল পানি আর পানি। এসব গ্রামের বেশিরভাগ মানুষ আশ্রয় নিয়েছে বেড়িবাঁধের ঢালে, বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। অনেকেই বাড়িঘর ছেড়ে আশ্রয় নিয়েছে পার্শ্ববর্তী এলাকার আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে। দুই উপজেলার আমন বীজতলা, রোপা আমনক্ষেত, পুকুর, ডোবা-নালা, পথঘাট, রাস্তাসহ সবকিছুই পানিতে তলিয়ে আছে।
স্থানীয়দের অভিযোগ, প্রভাবশালী সিন্ডিকেট ভুলুয়া নদী দখল করে বাড়িঘর নির্মাণ, অবৈধভাবে বাঁধ দিয়ে মাছ চাষ, মাছের ঘের তৈরি, নদীর দুই পাশে বিশেষ প্রকল্পের আওতায় গ্রামীণ সড়ক নির্মাণ, নদীসংলগ্ন খাল দখল, খালে পানিপ্রবাহ বন্ধকারী জাল বসানো, পোল ও কালভার্টের মুখ বন্ধ করাসহ বেশ কয়েকটি কারণে পানিপ্রবাহ বন্ধ হওয়ায় বন্যার সৃষ্টি হয়েছে। এ ছাড়া রামগতি, কমলনগর ও নোয়াখালী সদর উপজেলার ভেতর দিয়ে প্রবাহমান ভুলুয়া নদীর মুখে স্লুইসগেট (রামগতির হাজীগঞ্জ বাজারসংলগ্ন) দখল হয়ে আছে। এলাকাবাসী একাধিকবার মানববন্ধন কর্মসূচিসহ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন অফিস ও দপ্তরে স্মারকলিপি দিলেও কোনো কাজ হয়নি বলে অভিযোগ।
পাঠদান সম্ভব না হওয়ায় ইতোমধ্যে রামগতি উপজেলার পাঁচটি প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং তিনটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়সহ বেশ কয়েকটি মাদ্রাসা বন্ধ রয়েছে। কমলনগরের আট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পাঠদান বন্ধ রয়েছে। এ ছাড়া শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি কম থাকায় সময় কাটছাঁট করে চলছে বেশিরভাগ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। জোয়ার ও বৃষ্টির পানির স্রোতে ধসে পড়েছে আলেকজান্ডার-সোনাপুর সড়কের চরআলগী ইউনিয়নের নবিয়ল মোড়ের একটি সেতু। এ ছাড়া বিবিরহাট-রামগতি বাজার সড়কে যেকোনো সময় ধসে পড়তে পারে আরও তিনটি সেতু।
উপজেলা আবহাওয়া অফিস সূত্রে জানা গেছে, গত বৃহস্পতিবার ৫৮ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। এ ছাড়া গত পাঁচ দিনে ৩৭০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়। পূর্ণিমার কারণে গত কয়েক দিন বৃষ্টির পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে।
সব মিলিয়ে রামগতি ও কমলনগর উপজেলার মানুষের দুঃখ এখন এ ভুলুয়া নদী। নদীটি খনন ও দখলমুক্তের উদ্যোগ নিলে এ অঞ্চলের কৃষিকাজে আমূল পরিবর্তন আসবে। ভাগ্য বদলাবে কৃষকের। বর্ষায় আর এমন জলাবদ্ধতা থাকবে না বলে জানায় দুই উপজেলার বাসিন্দারা।
কমলনগরের চরকাদিরা গ্রামের কৃষক বেল্লাল হোসেন বলেন, একসময় নদীটির বুকে বড় নৌকা চলাচল করত। জাল ফেলে মাছ ধরে চাহিদা মেটানোসহ জীবন-জীবিকা নির্বাহ করত স্থানীয়রা। এখন প্রভাবশালীরা বাঁধ দিয়ে মাছ চাষ, স্থাপনা নির্মাণ ও মাছের বড় বড় প্রজেক্ট করে বিভিন্নভাবে দখল করে রেখেছে। এখন আর নদীতে জোয়ার-ভাটা নেই। আবার বর্ষার মৌসুমে সৃষ্টি হয় জলাবদ্ধতা। এতে নানাবিধ সমস্যায় পড়তে হয় তাদের।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) উপবিভাগীয় প্রকৌশলী (রামগতি) ইমতিয়াজ মাহমুদ বলেন, ‘পূর্ণিমার প্রভাবে অস্বাভাবিক জোয়ার দেখা দিয়েছে। আগামী দুয়েক দিনের মধ্যে এটি স্বাভাবিক হয়ে যাবে। পাউবোর আওতাধীন খাল ও নদী দ্রুত দখলমুক্ত করা না গেলে ভবিষ্যতে আরও সমস্যা হতে পারে।’
কমলনগরের ইউএনও সুচিত্র রঞ্জন দাস বলেন, অবৈধ দখলদার যেই হোক, তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ভুলুয়া নদী পূর্বের অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে ডেলিকেটেড প্রকল্প গ্রহণ করা দরকার বলেও জানান প্রশাসনের এই কর্মকর্তা। রামগতির ইউএনও সৈয়দ আমজাদ হোসেন বলেন, ছুটিতে ছিলাম। পরিস্থিতি অস্বাভাবিক হওয়ায় ছুটি বাতিল করে কর্মস্থলে ফিরছি। সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলাপ করে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।