চট্টগ্রাম অফিস
প্রকাশ : ২৪ আগস্ট ২০২৪ ১৫:১৯ পিএম
বন্যায় রাস্তাঘাট-বাড়ি ডুবে যাওয়ায় তৈরি হয়েছে বিশুদ্ধ পানির সংকট। বোতলজাত পানি নিয়ে বাড়ি ফিরছেন দুইজন। শুক্রবার বিকালে চট্টগ্রামের ফটিকছড়ির পূর্ব সুয়াবিল এলাকা থেকে তোলা। প্রবা ফটো
স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যায় বিপর্যস্ত চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি উপজেলা। দুই দিন ধরে পানির নিচে তলিয়ে আছে এই উপজেলার অধিকাংশ এলাকা। ধুরং ও হালদা নদীতে পানির চাপ বাড়ায় কয়েকটি স্থানে ভেঙে গেছে বেড়িবাঁধ। প্লাবিত হয়েছে বিস্তীর্ণ জনপদ। এরই মধ্যে মৃত্যু হয়েছে এক শিশুর। নিখোঁজ রয়েছেন আরও দুজন।
ফটিকছড়ির মতোই পানির নিচে তলিয়ে গেছে চট্টগ্রামের হাটহাজারী ও মিরসরাই উপজেলার অধিকাংশ এলাকা। এসব এলাকার ঘরবাড়ি হাঁটু থেকে কোমরসমান পানিতে ডুবে রয়েছে। বেশিরভাগ গ্রামীণ সড়ক পানিতে তলিয়ে গেছে। ঘরবাড়ি, ফসলি জমি তলিয়ে যাওয়ায় চরম দুর্ভোগ পোহাচ্ছে ওইসব এলাকার মানুষ। সড়ক ডুবে যাওয়ায় নিরাপদ আশ্রয়েও যেতে পারছে না তারা। দ্রুত কোনো একটা নিরাপদ আশ্রয়ে সরিয়ে নিতে আকুতি জানাচ্ছে দুর্গতরা। তবে এ দুই উপজেলায় নিহত অথবা নিখোঁজের কোনো খবর এখন পর্যন্ত পাওয়া যায়নি।
ভয়াবহ বন্যায় দুর্গত মানুষের ভোগান্তি যখন সীমাহীন; তখন তাদের পাশে দাঁড়াতে দেশের নানা প্রান্ত থেকে বহু মানুষ ছুটে যাচ্ছেন সেখানে। দুঃসময়ে ফুটে উঠেছে মানবিকতার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। সাধারণ মানুষ সামর্থ্য অনুযায়ী সহযোগিতা নিয়ে হাজির হচ্ছেন এসব এলাকায়। দুর্গতদের উদ্ধারে কেউ ভাড়া করে নিয়ে যাচ্ছেন নৌকা। আবার কেউ কেউ নিয়ে যাচ্ছেন বিশুদ্ধ খাবার পানি, শুকনো খাবার, মোমবাতিসহ নানা সামগ্রী।
সরেজমিন দেখা যায়, বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক সংগঠন বন্যাদুর্গত মানুষদের উদ্ধারে এগিয়ে এসেছে। অনেকে নৌকা নিয়ে আটকা পড়া দুর্গতদের উদ্ধার করছেন। আবার ত্রাণ নিয়ে ছুটছেন তাদের দ্বারে দ্বারে। শিক্ষার্থীসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষকেও উপদ্রুত এলাকায় তৎপরতা চালাতে দেখা গেছে। হাটহাজারীর ফকির মোহাম্মদ চৌধুরী এলাকায় দেখা গেছে, সড়কে পানি উঠে যাওয়ায় ওই এলাকায় যান চলাচল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ত্রাণ নিয়ে যাওয়া স্বেচ্ছাসেবকরা হেঁটে ওই এলাকা পার হচ্ছেন।
গত বুধবার থেকে ভারত সীমান্তবর্তী বাগানবাজার, দাঁতমারা ইউনিয়নসহ ফটিকছড়ি পৌরসভা, নাজিরহাট পৌরসভা, সুন্দরপুর, পাইন্দং, হারুয়ালছড়ি, সুয়াবিল, নারায়ণহাট, ভূজপুরে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি ঘটে। এ ছাড়া লেলাং, সমিতিরহাট, রোসাংগিরী, জাফতনগর, বক্তপুর, নানুপুর, ধর্মপুরসহ ইউনিয়নের বিভিন্ন স্থানে বন্যার সৃষ্টি হয়।
বন্যার পানিতে চট্টগ্রাম-খাগড়াছড়ি সড়ক, গহিরা-ফটিকছড়ি সড়ক, নাজিরহাট-কাজিরহাট সড়ক, ফটিকছড়ি ভূজপুর ও হেয়াকো সড়ক পানিতে তলিয়ে গেছে। ফটিকছড়ি থেকে হেয়াকো রামগড় সড়ক পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় যান চলাচল বন্ধ রয়েছে। ফলে উপজেলা সদর ও খাগড়াছড়ির রামগড়ের বাসিন্দাদের দুর্ভোগ আরও বেড়েছে। এ ছাড়া মাইজভান্ডার-রাউজান সড়কও পানিতে ডুবে গেছে।
সুন্দরপুর ইউনিয়নের বাসিন্দা মোহাম্মদ শাহজাহান প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, ‘বৃহস্পতিবার দুপুর থেকে পানি বেশি বাড়তে থাকে। রাতে এলাকার অধিকাংশ ঘরবাড়ি তলিয়ে যায়। অধিকাংশ এলাকা ৮ থেকে ১০ ফুট পানির নিচে তলিয়ে যায়। পানিবন্দি হয়ে পড়েছে শত শত পরিবার। খাবার, ওষুধ ও পানীয়জলের অভাব দেখা দিয়েছে এসব এলাকায়।
হাটহাজারীতেও একই অবস্থা বিরাজ করছে। উপজেলার অধিকাংশ ঘরবাড়ি পানিতে তলিয়ে গেছে। স্থানীয়রা জানান, হাটহাজারীর সীমান্তবর্তী নাজিরহাট পুরাতন ব্রিজ ও নতুন ব্রিজের মাঝামাঝি এলাকায় বাঁধ ভেঙে লোকালয়ে পানি ঢুকেছে। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ৬টার দিকে বাঁধ ভেঙে যায় বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা। বাঁধ ভাঙার ১০ মিনিটের মধ্যে আশপাশের প্রায় আড়াইশ পরিবারের ঘরবাড়িতে পানি ঢুকে যায়। এরপর ফরহাদাবাদ ইউনিয়ন হয়ে হাটহাজারীতে বানের পানি প্রবেশ করে। এতে রাতের মধ্যে ওইসব এলাকার ঘরবাড়ি ৮ থেকে ১০ ফুট পানির নিচে তলিয়ে যায়। এখনও একই অব্স্থায় রয়েছে। তবে সকাল থেকে বৃষ্টিপাত না হওয়ায় এখন পানি কিছুটা কমতির দিকে। সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত ৬ ঘণ্টায় ৫-৬ ইঞ্চি পানি কমেছে বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা।
এদিকে ঘরবাড়ি পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় বন্যাদুর্গত এলাকার মানুষজনের কাছে এখন সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন হয়ে দেখা দিয়েছে বিশুদ্ধ পানি ও খাদ্যসামগ্রী। স্থানীয় প্রশাসন, স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলো শুকনো খাবার, স্যালাইন ও বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ করলেও সেটি চাহিদার তুলনায় কম। বিশেষ করে দূরবর্তী এলাকায় যারা আটকা পড়েছে তাদের কাছে এখনও কোনো ত্রাণ পৌঁছয়নি।
হাটহাজারী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এবিএম মশিউজ্জামান প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, বন্যায় উপজেলার ১২ ইউনিয়ন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ফরহাদাবাদ ইউনিয়ন। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় হালদা নদীর বাঁধ ভেঙে পানি প্রবেশ করায় ওই ইউনিয়নের অধিকাংশ ঘরবাড়ি ৮ থেকে ১০ ফুট পানির নিচে। সেখানকার বাসিন্দাদের উদ্ধার করে আশ্রয়কেন্দ্রে আনা হয়েছে। প্রশাসনের পাশাপাশি স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তি, স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন এবং ব্যক্তি উদ্যোগেও অনেকে দুর্গতদের উদ্ধার করে নিরাপদ আশ্রয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। এখন পর্যন্ত নিহত অথবা নিখোঁজের কোনো খবর পাওয়া যায়নি।
অন্যদিকে ফেনী নদীর পানি বিপদসীমা অতিক্রম করায় প্লাবিত হয়েছে মিরসরাই উপজেলার বিভিন্ন এলাকা। স্থানীয়রা জানিয়েছেন, করেরহাট, হিংগুলি, জোরারগঞ্জ, ধুম, ওচমানপুর, ইছাখালী, কাটাছড়া এসব ইউনিয়নের বাসিন্দারা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এসব এলাকার ঘরবাড়ি ছাদ পর্যন্ত পানিতে তলিয়ে যায়। সড়কগুলো পানিতে ডুবে রয়েছে। নৌকা ছাড়া অন্য কোনো মাধ্যমে উদ্ধার তৎপরতা চালানো যাচ্ছে না। ঘরবাড়ি তলিয়ে যাওয়ায় অনেকে আশপাশের দালান ঘরের ছাদ বা দোতলায় অবস্থান করছেন। যাদের এ রকম উঁচু ভবনে যাওয়ার সুযোগ নেই, তারা প্রশাসনের তত্ত্বাবধানে খোলা আশ্রয়কেন্দ্রে অবস্থান নিয়েছেন।
মিরসরাই উপজেলা নির্বাহী অফিসার মাহফুজা জেরিন বলেন, ফেনী নদীসংলগ্ন যেসব ইউনিয়ন আছে; সেগুলোর প্রায় সবই বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে। বিশেষ করে এক থেকে সাত নম্বর ইউনিয়নের ঘরবাড়িগুলোতে বেশি পানি উঠেছে। তবে বন্যায় এখন পর্যন্ত কোনো হতাহতের ঘটনা ঘটেনি। স্থানীয় প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের পাশাপাশি বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন উদ্ধার তৎপরতা চালাচ্ছে। মহামায়া লেকে থাকা নৌকাগুলো নিয়ে স্থানীয়রা প্লাবিত এলাকা থেকে মানুষজনকে আশ্রয়কেন্দ্রে নিয়ে আসছেন। উপজেলার সব সরকারি অফিস, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো আশ্রয়কেন্দ্র ঘোষণা করা হয়েছে। এখন পর্যন্ত বিভিন্ন আশ্রয়কেন্দ্রে সাত হাজার দুর্গত মানুষ আশ্রয় নিয়েছে। তাদের প্রশাসনের পক্ষ থেকে শুকনো খাবার, পানি সরবরাহ করা হচ্ছে।