রংপুর অফিস
প্রকাশ : ২৩ আগস্ট ২০২৪ ১৫:৪৩ পিএম
আপডেট : ২৩ আগস্ট ২০২৪ ১৬:৫৩ পিএম
গঙ্গাচড়া উপজেলার মহিপুর এলাকা থেকে তোলা তিস্তা নদীর চিত্র। প্রবা ফটো
পানি ধারণক্ষমতা কমে গেছে তিস্তা নদীর। উজানের পলিতে ভরাট হয়েছে নদীর বুক। ফলে বর্ষায় ভারতে ভারী থেকে অতি ভারী বৃষ্টিতে তিস্তায় বন্যা দেখা দিচ্ছে। ফসল, ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাটসহ অবকাঠামোর ব্যাপক ক্ষয়-ক্ষতি হচ্ছে। অপরদিকে শুস্ক মৌসুমে তিস্তা নদী শুকিয়ে মরা খালে পরিণত হচ্ছে। অনেক স্থানে হেঁটে নদী পাড়াপাড় হন স্থানীয়রা। পানি উন্নয়ন বোর্ড বলছে, প্রতি বছর দুই কোটি টনের বেশি পলি আনছে তিস্তা।
জানা যায়, বর্ষা মৌসুমে বেশি বৃষ্টি হলে গজলডোবা বাঁধের সবগুলো জলকপাট খুলে দেয় ভারত। এতে হু হু করে পানি ঢুকে পড়ে তিস্তা নদীতে। পানির চাপ বেশি হলে লালমনিরহাটের তিস্তা ব্যারেজের সব জলকপাট খুলে দিতে হয় কর্তৃপক্ষকে। এতে করে নীলফামারী, লালমনিরহাট, রংপুর, কুড়িগ্রাম ও গাইবান্ধায় জেলায় বন্যা দেখা দেয়। বন্যার ঘোলাটে পানির স্রোত ধেয়ে আসতে থাকে ভাটির দিকে। এর সঙ্গে বিপুল পরিমাণ পলি আসায় তিস্তা নদীর বুক ভরাট হয়ে এসেছে। ফলে প্রতি বছর নতুন নতুন চর জেগে উঠছে। বিদ্যামান চরগুলো আরও উঁচু হচ্ছে। পলিতে নদীর বুক উঁচু হওয়াতে স্বল্প পানিতেই নদী টইটম্বুর হয়। পানি ঢুকে পড়ে লোকালয়ে। পথ-ঘাট, ঘরবাড়ি সবকিছু ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে।
সেই সঙ্গে বর্ষা ও শৎরকালে বারবার ক্ষণস্থায়ী বন্যায় ভাসতে হয় তিস্তা পাড়ের মানুষকে। নষ্ট হয় তাদের জীবিকার একমাত্র পথ চরের কৃষি। নদীর বুকে চর জেগে উঠায় রংপুরের গঙ্গাচড়া উপজেলার লহ্মীটারী ইউনিয়নে তিস্তা নদী একাধিক চ্যানেল দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। নদী শাসন, ড্রেজিং না হওয়ায় প্রতি বছর নতুন নতুন করে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা বাড়ছে।
তিস্তার বুক পলিতে ভরে যাওয়ায় কাউনিয়া পয়েন্টে বিপদসীমা পরিবর্তন করেছে পানি উন্নয়ন বোর্ড। পূর্বে কাউনিয়া পয়েন্টে বিপদসীমা ছিল ২৮ দশমিক ৭৫ সেন্টিমিটার। গত জুন মাসে এ পয়েন্টে বিপদসীমা ৫৬ সেন্টিমিটার বাড়িয়ে ২৯ দশমিক ৩১ সেন্টিমিটার নির্ধারণ করা হয়েছে।
রংপুরের গঙ্গাচড়া উপজেলার লহ্মীটারী ইউনিয়নের মহিপুর এলাকায় সরেজমিনে দেখা যায়, ভারতে ভারী বৃষ্টিপাতের কারণে এখন ভরা যৌবনে ফিরেছে তিস্তা নদী। প্রবল বেগে নদীর পানি বয়ে চলেছে। ঘোলা পানির কারণে বোঝা যাচ্ছে উজান থেকে পলি বয়ে আনছে তিস্তা। শংকরদহ গ্রামের কিছু এলাকায় তিস্তা নদীর পানি ঢুকে পড়েছে।
এলাকার আসিফ মিয়া প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, ‘এই যে দ্যাখতোছেন তিস্তার পানি। সউগ কিন্তু ঘোলা। মানে নদীর পানির সাতে ম্যালা মাটিও আসতোছে। শুকানের সমায় এই মাটি দেখা যায়। নদী তো মাটিত ভরি গেইছে। হামরা নদীর মাঝোত সেই মাটিত আবাদ করি। নদী ভরাট হয়া গেইছে, সেই জন্তে অল্প একনা পানিতেই হামরা ভাসি যাই।’
এলাকার বাসিন্দা ধীরেন্দ্র নাথ বলেন, ‘আগোত নদী ম্যালা গভীর ছিল। বড় বড় নৌকা যাতায়াত করছিল। এ্যালা তো গভীরতা নাই। শুকানের দিনোত মানুষ হাঁটি নদী পাড় হয়। নদী পার হয়া ঘোড়া গাড়িত করি হামরা বাড়িত ফসল নিয়া যাই।’
শংকদরহের কৃষানী আমিনা বেগম বলেন, ‘দৌড়ি নদীত পানি বাড়ে, হামরা বাঁন্দোত দিন-আইত কাটাই। আবার পরের দিন পানি কমি গেইলে বাড়িত উঠি। আবার দেখা যায় আইতো ভারত পানি ছাড়ি দেয়। বৃষ্টির দিনোত হামাক দৌড়াদৌড়ির উপর থাকা নাগে।’
পানি উন্নয়ন বোর্ড জানায়, উজানের ঢলের সঙ্গে প্রতি বছর দুই কোটি টন পলি বয়ে আনে তিস্তা নদী। এতে করেই তিস্তা নদীর বুক ভরাট হচ্ছে এবং স্বল্প বৃষ্টিতেই বন্যা দেখা দিচ্ছে। গত বছর অক্টোবরে ভারতে বাঁধ ভেঙে যায়। ফলে তিস্তা নদীতে সেই বাঁধ ভাঙ্গা পানি প্রবাহিত হয়। ওই বছর ব্যাপক পরিমাণ পলি বয়ে আসে তিস্তা নদীতে।
রংপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী রবিউল ইসলাম বলেন, ‘পাহাড়ি ঢল থেকে তিস্তা নদী বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। প্রতি বছর তিস্তা নদী দুই কোটি টন পলি বয়ে আনে। গত বছর অক্টোবরে ভারতে বাঁধ ধসের কারণে বিপুল পরিমাণ পলি এসেছে। ফলে তিস্তা নদীর বুক উঁচু হয়েছে। তাই অল্প পানিতেই উত্তরের ৫ জেলায় বন্যা দেখা দিচ্ছে।’
রিভারাইন পিপলের পরিচালক অধ্যাপক ড. তুহিন ওয়াদুদ প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, ‘উত্তরের জীবন রেখা তিস্তা নদী। এটির বয়স ২৩৫ বছর। কিন্তু এই নদী নিয়ে এখন পর্যন্ত যৌথ কোনো সমীক্ষা হয়নি। তিস্তা ১০ হাজার কিউসেক পানি ধারণ করতে পারে। কিন্তু সেখানে ওই পরিমাণে পানি শুষ্ক মৌসুমে আসে না। তিস্তার বুক ভরাট হওয়ায় আধুনিক প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে নদী ড্রেজিং করতে হবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘তিস্তার পানি ভারত আটকে না রাখলে, তা বঙ্গোপসাগরে চলে যেত। একদিকে পানির প্রবাহ নেই, অপরদিকে সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ছে। তাই সাগরের লবনাক্ত পানি দিন দিন লোকালয়ে উঠে আসছে। লবনাক্ত পানির কারণে দক্ষিণবঙ্গে আমাদের ফসল আবাদ হচ্ছে না। এছাড়া পানির কারণে নানাবিধ সমস্যা দেখা দিচ্ছে। বাংলাদেশের উচিত আন্তর্জাতিক পানি কনভেনশনে স্বাক্ষর করে তিস্তার মতো যৌথ নদীগুলোর পানির ন্যায্য হিস্যা নিশ্চিত করা।’