× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

আবু সাঈদ হত্যাকাণ্ডের সুষ্ঠু বিচার নিয়ে সংশয়

মেরিনা লাভলী, রংপুর

প্রকাশ : ১৭ আগস্ট ২০২৪ ১৭:১৫ পিএম

আবু সাঈদ। ফাইল ফটো

আবু সাঈদ। ফাইল ফটো

বৈষম্যের বিরুদ্ধে আত্মত্যাগী রংপুরের আবু সাঈদ। পীরগঞ্জের নিভৃত পল্লীর ছায়াঘেরা, কোলাহলমুক্ত পরিবেশে বেড়ে ওঠা এ তরুণ ন্যায্য দাবি আদায়ে রাজপথে বন্দুকের নলের সামনে দাঁড়িয়েছিলেন বুক চেতিয়ে। প্রকাশ্য দিবালোকে পুলিশের গুলিতে নির্মমভাবে প্রাণ হারান বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবু সাঈদ। তার এই আত্মত্যাগের বারুদ ছড়িয়ে পড়ে সারা দেশের ছাত্র-জনতার বুকে। অসহযোগ আন্দোলনে পতন হয় শেখ হাসিনার সাম্রাজ্যের।

কিন্তু গণঅভ্যুত্থানে প্রাণ দেওয়া সেই মহানায়কের হত্যাকাণ্ডের বিচার নিয়ে দেখা দিয়েছে সংশয়। মৃত্যুর এক মাসেও আবু সাঈদ হত্যাকাণ্ড নিয়ে হয়নি কোনো মামলা। কেবল পুলিশের করা তাজহাট থানার মামলায় আবু সাঈদ হত্যাকাণ্ডের অংশটি নিয়ে তদন্ত করছে পিবিআই। এরই মধ্যে কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময় পুলিশের দায়ের করা মিথ্যা ও হয়রানিমূলক মামলা প্রত্যাহারের ঘোষণা দিয়েছেন আইন উপদেষ্টা। সেই ঘোষণা অনুযায়ী তাজহাট থানার মামলাটি প্রত্যাহার হলে আবু সাঈদ হত্যাকাণ্ডের তদন্ত ও বিচার বন্ধ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা করছে সচেতন মহল। অবিলম্বে আবু সাঈদ হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় মামলা ও তদন্তের জন্য কমিশন গঠনের দাবি জানিয়েছেন তারা।

আবু সাঈদ হত্যায় সুনির্দিষ্ট মামলা হয়নি

আন্দোলন চলাকালে গত ১৬ জুলাই বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের (বেরোবি) এক নম্বর গেটের সামনে পুলিশের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের সংঘর্ষের সময় পুলিশের গুলিতে নিরস্ত্র আবু সাঈদের মৃত্যু হয়। পরদিন বিশ্ববিদ্যালয় ফাঁড়ির ইনচার্জ বিভূতিভূষণ রায় পরস্পর যোগসাজশে বেআইনি জনতাবদ্ধে সাধারণ ও মারাত্মক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে সরকারি কাজে বাধার সৃষ্টি করে গুরুতর জখম, চুরি, ভাঙচুর, ক্ষতিসাধন, অগ্নিসংযোগ ও নিরীহ ছাত্রকে হত্যার অপরাধে ১৪৩/১৮৬/৩৩২/৩৩৩/৩৫৩/৩৭৯/৪৩৫/৪২৭/৩০২/৩৪ ধারায় মেট্রোপলিটন তাজহাট থানায় একটি মামলা করেন। এতে আসামি করা হয় অজ্ঞতানামা উচ্ছৃঙ্খল দুই থেকে তিন হাজার আন্দোলনকারী ছাত্রনামধারী দুর্বৃত্তসহ বিএনপি, জামায়াত-শিবির সমর্থিত নেতাকর্মীদের। মামলার বিবরণের মাঝে এক জায়গায় উল্লেখ করা হয়Ñ ‘বিভিন্ন দিক থেকে আন্দোলনকারীদের ছোড়া গোলাগুলি ও ইটপাটকেল নিক্ষেপের একপর্যায়ে একজন শিক্ষার্থীকে রাস্তায় পড়ে যেতে দেখা যায়। সহপাঠীরা তাকে ধরাধরি করে জরুরি চিকিৎসার জন্য রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত বলে ঘোষণা করেন। মৃত ছাত্রের নাম আবু সাইদ (২৩)। পিতা-মকবুল হোসেন, সাং-জাফরপাড়া বাবনপুর, থানা-পীরগঞ্জ, জেলা রংপুর বলে মেডিকেল সূত্রে জানা যায়।’ সেসময় মামলার কপিটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে গেলে পুলিশ ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়ে। আবু সাঈদ হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় পুলিশ ও বেরোবির পক্ষ থেকে তদন্ত কমিটি গঠন করা হলেও কোনো কমিটিই প্রতিবেদন জমা দেয়নি। সেই সঙ্গে আবু সাঈদ হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় বেরোবি প্রশাসন কিংবা আবু সাঈদের পরিবারের পক্ষ থেকে কোনো মামলা করা হয়নি। আবু সাঈদ হত্যাকাণ্ডের মামলায় মাহিম নামে এক কিশোরকে গ্রেপ্তার করে ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়ে মেট্রোপলিটন পুলিশ। পরে আদালতের মাধ্যমে জামিনে মুক্তি পায় ওই কিশোর। 

এদিকে গত ৩ আগস্ট আবু সাঈদ নিহতের ঘটনায় অপেশাদার আচরণের অভিযোগে এএসআই আমীর হোসেন ও তাজহাট থানার কনস্টেবল সুজন চন্দ্রকে সাময়িক বরখাস্ত করে মেট্রোপলিটন পুলিশ। গত ১২ আগস্ট তাজহাট থানার মামলায় আবু সাঈদ হত্যাকাণ্ডের অংশটি তদন্তের ভার পায় পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই), রংপুর। পরদিন আবু সাঈদ হত্যাকাণ্ডের সময় দায়িত্বে থাকা রংপুর মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার মো. মনিরুজ্জামানকে প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। 

আবু সাঈদ হত্যার বিচার নিয়ে সংশয়

গত ১৪ আগস্ট অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল সংবাদ সম্মেলনে জানান, কোটা পদ্ধতি সংস্কার ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে সারা দেশে পুলিশের করা মিথ্যা, হয়রানিমূলক মামলা আগামী ৩১ আগস্টের মধ্যে প্রত্যাহার করা হবে। এর অংশ হিসেবে পুলিশের করা তাজহাট থানার মামলাটি প্রত্যাহার হলে আবু সাঈদের হত্যার ঘটনায় আর কোনো মামলই থাকবে না। সচেতন ব্যক্তিদের মতে, আবু সাঈদ হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় কোনো সুনির্দিষ্ট মামলা না হওয়ায় এ ঘটনার সঠিক বিচার নিশ্চিত হওয়া কঠিন হয়ে যাবে। পুলিশের দায়ের করা মামলা, পুলিশের একটি বিভাগ তদন্ত করায় এটির সঠিক তদন্ত নিয়েও জনমনে প্রশ্ন রয়েছে। একটি তদন্ত কমিশন গঠন করে আবু সাঈদ হত্যাকাণ্ডের তদন্ত পর্যবেক্ষণ করার দাবি জানিয়েছেন তারা। সেই সঙ্গে পরিবার কিংবা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে আবু সাঈদের হত্যার ঘটনায় মামলা না হলে তৃতীয় পক্ষ এ ঘটনায় মামলা করে বিভিন্ন মহলকে মামলায় জড়ানোর হুমকি দিয়ে বাণিজ্যে মেতে উঠতে পারে বলেও আশঙ্কা করা হচ্ছে।

রংপুরের মানবাধিকার কর্মী ও আইনজীবী জোবাইদুল ইসলাম বলেন, আইন উপদেষ্টার ঘোষণা অনুযায়ী পুলিশের করা সব মামলা প্রত্যাহার হলে আবু সাঈদ হত্যাকাণ্ড নিয়ে কোনো মামলা থাকছে না। ফলে পুলিশ কী দিয়ে তদন্ত করবে? আমরা আবু সাঈদ হত্যার বিচার কীভাবে পাব? তাই প্রশাসনের কাছ থেকে নিরাপত্তা নিয়ে আবু সাঈদের পরিবার একটি হত্যা মামলা দায়ের করতে পারে। পরিবারের সদস্যদের মামলা করার সক্ষমতা না থাকলে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ মামলা করতে পারে।

তিনি আরও বলেন, পুলিশের বিরুদ্ধে পুলিশ তদন্ত করবে, এর অতীত অভিজ্ঞতা খুবই খারাপ। সব জেলায় কোটা আন্দোলনে নিহতদের সঠিক বিচারপ্রাপ্তিতে সুষ্ঠু তদন্তের জন্য একজন আইনজীবী, অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ কর্মকর্তা, বিজ্ঞ বিচারকসহ সংশ্লিষ্টদের নিয়ে একটি তদন্ত কমিশন গঠন করতে হবে। এসব হত্যাকাণ্ডের বিচারে একটি ট্রাইব্যুনাল গঠন করতে হবে। ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোকে আর্থিক সহযোগিতা দিতে হবে।

পিবিআই যা বলছে 

আবু সাঈদ হত্যাকাণ্ডের অংশটুকুর তদন্ত করছে পিবিআই, রংপুর অফিসের এসআই জিল্লুর রহমান। পিবিআই বলছে, পুলিশের করা মামলাগুলো খারিজ হলেও আবু সাঈদ হত্যাকাণ্ডের মামলাটি থেকে যাবে। এ মামলায় আসামিদের নাম উল্লেখ না থাকা এবং আসামিরা ছাত্র না হওয়ায় খারিজ হওয়ার আশঙ্কা দেখছে না তারা। নির্ভরযোগ্য, বস্তুনিষ্ঠ ও বৈজ্ঞানিকভাবে তদন্ত করার কথাও জানিয়েছে সংস্থাটি। 

পিবিআই রংপুরের পুলিশ সুপার এবিএম জাকির হোসেন বলেন, আবু সাঈদের পরিবার কিংবা অন্য কোনো পক্ষ থেকে এখন পর্যন্ত কোনো মামলা দায়ের হয়নি। যদি বিজ্ঞ আদালত কিংবা অন্য কোনো মাধ্যমে আবু সাঈদ হত্যার ঘটনায় মামলা হয়, তবে আমরা অবশ্যই বস্তুনিষ্ঠতার সঙ্গে তদন্ত করব। তবে তাজহাট থানায় দায়ের করা মামলার আবু সাঈদের অংশের তদন্তভার পেয়ে আমরা তদন্ত শুরু করেছি। 

তিনি আরও বলেন, এই মামলার এজাহারে কোনো ব্যক্তির নাম নেই। এজাহার গর্ভে অনেক কথা রয়েছে। তবে এখানে কোনো শিক্ষার্থী আসামি নন। তাই আমি মনে করছি, এ মামলাটি খারিজ হবে না। 

আবু সাঈদ হত্যার বিচারে সোচ্চার শিক্ষার্থীরা

গত ১৪ আগস্ট থেকে চার দফা দাবিতে ‘প্রতিরোধ সপ্তাহ’ পালন করছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। প্রতিদিনের কর্মসূচিতে আবু সাঈদসহ কোটা আন্দোলনে নিহত শিক্ষার্থীদের সঠিক বিচার ও দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানিয়ে আসছে তারা। চার দফা দাবি আদায়সহ হত্যাকাণ্ডের বিচার না হওয়া পর্যন্ত রাজপথ ছেড়ে না যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন তারা। 

রংপুর সরকারি কলেজের ছাত্র মনিরুজ্জামান বলেন, দেশবাসী দেখেছে আবু সাঈদকে কীভাবে পুলিশ লীগ গুলি করে হত্যা করেছে। শেখ হাসিনা সরকারের আমলে ভাঙচুরের মামলার একটি অংশে আবু সাঈদকে আন্দোলনকারীরা গুলি করে হত্যা করেছে বলে উল্লেখ করা হয়। সেই ফ্যাসিস্ট সরকার চলে যাওয়ার পর পিবিআইয়ে মামলা স্থানান্তর করা হয়েছে। আশা করছি, তারা নিরপেক্ষভাবে তদন্ত করবে। 

শিক্ষার্থী তাসিন বলেন, আবু সাঈদ ভাইয়ের মৃত্যু স্বৈরাচার সরকারের পতন ত্বরান্বিত করেছে। আমরা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন, রংপুরের পক্ষ থেকে দাবি জানাচ্ছি যেন আবু সাঈদ ভাইয়ের পরিবার কিংবা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন একটি মামলা দায়ের করে। এর পরও কেউ মামলা করতে এগিয়ে না এলে ছাত্রদের পক্ষ থেকে আবু সাঈদ হত্যা মামলা দায়ের করে খুনিদের বিচারের মুখোমুখি করা হবে।

শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা