রেজাউল করিম, গাজীপুর
প্রকাশ : ১৫ আগস্ট ২০২৪ ১৭:১৮ পিএম
ফাইল ফটো
আয়তনে দেশের সর্ববৃহৎ সিটি করপোরেশন (গাসিক) হলেও প্রতিষ্ঠাকাল থেকেই ‘মেয়র’ সংকটসহ নানা সমস্যা বিদ্যামান গাজীপুরে। বর্তমান মেয়র জায়েদা খাতুন কার্যত তার ছেলে জাহাঙ্গীর আলমের মাধ্যমেই পরিচালনা করেন সকল কার্যক্রম। তবে পদত্যাগ করে শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালানোর পর থেকে আত্মগোপনে জাহাঙ্গীর আলম। ফলে অনেকটা বেকায়দায় পড়েছেন জায়েদা খাতুন। ঠিকমতো অফিস করেন না সিটি করপোরেশনের অনেক কর্মকর্তা।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, গত ১৯ জুলাই বিকালে গাজীপুর থেকে ঢাকার আওয়ামী লীগের সমাবেশে যোগ দেওয়ার জন্য নেতাকর্মী নিয়ে জাহাঙ্গীর রওনা দেন। তার গাড়িবহর উত্তরা হাউস বিল্ডিং এলাকা পার হওয়ার সময় আন্দোলনকারীরা গতিরোধ করে। এ সময় জাহাঙ্গীর আলমের নেতাকর্মীদের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের কথা কাটাকাটি হয়। ইটপাটকেল ছুড়তে থাকে আন্দোলনকারীরা। তাদের ইটের আঘাতে জাহাঙ্গীর আলমের মাথা ফেটে যায়। তার সঙ্গের নেতাকর্মীরাও আহত হন। তার সঙ্গে থাকা নেতাকর্মীরা প্রতিরোধ তৈরি করলে জাহাঙ্গীর আলমের কর্মী জুয়েল মোল্লাকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। এরপর শেখ হাসিনা দেশ ছাড়ার পর ৫ আগস্ট তার বাড়ি আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। তারপর থেকে আত্মগোপনে জাহাঙ্গীর আলম। তার মা মেয়র জায়েদা খাতুন কয়েকদিন অগোচরে থাকলেও গত মঙ্গলবার টঙ্গী ও পূবাইল সিটি করপোরেশনের আঞ্চলিক কার্যালয় পরিদর্শন করেছেন।
সরেজমিনে বুধবার বেলা ১১টার পর সিটি করপোরেশন বিভাগগুলোতে গিয়ে দেখা যায় অধিকাংশ দপ্তরের বড় কর্মকর্তারা অনুপস্থিত। কোনো শৃঙ্খলা নেই। যে যার মতো আসছেন, বের হচ্ছেন। দেখে মনে হচ্ছে অভিভাবকহীন একটি সিটি করপোরেশন। জাহাঙ্গীর যখন ছিলেন তখন যেসব লোকবলের নগর ভবনে দৌড়ঝাঁপ ছিল তাদেরকেও দেখা যাচ্ছে না। ফলে নাগরিক সেবার মান যেমন কমেছে, তেমনি অনিশ্চয়তায় ধুঁকছে সিটির ভবিষ্যৎ। ছুটিতে দেশের বাইরে রয়েছে প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ও প্রধান প্রকৌশলীসহ বেশ কয়েকজন। এ ছাড়াও দুর্নীতিগ্রস্ত অনেক কর্মকর্তাও আছেন পালিয়ে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা বলেন, উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম কোথায় আছে আমরা জানি না। সিটি করপোরেশন তার নির্দেশনা মোতাবেক চলে। এখন তিনি না থাকায় মেয়র মহোদয় কীভাবে সব সামলাবেন? জাহাঙ্গীর আলম ছাড়া সিটি করপোরেশন তার পক্ষে চালানো অনেকটা অসম্ভব।
২০১৩ সালের ১৬ জানুয়ারি ৩২৯ দশমিক ৯০ বর্গমিটার আয়তনের এ শিল্প এলাকা নিয়ে গঠিত হয় সিটি করপোরেশন । বর্তমানে নগরীতে বসবাস করে ৩০ লাখের বেশি মানুষ। বৃষ্টিতে জলাবদ্ধতা, খানাখন্দভরা রাস্তা, নেই নিষ্কাশনের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা। রাস্তার পাশের বৈদ্যুতিক লাইট নেই, ময়লার নির্দিষ্ট ডাম্পিং স্টেশন নাই।
বাড়তি ট্যাক্সের বোঝা চাপলেও স্বাস্থ্য খাতে নেই পর্যাপ্ত নাগরিক সুবিধা। গত এক বছরে বাড়েনি দৃশ্যমান কোনো সেবা। সেবা না বাড়লেও বেড়েছে নগরবাসীর দুর্ভোগ। বাসযোগ্য পরিকল্পিত নগরায়ণের যে লক্ষ্য নিয়ে গঠিত হয়েছিল রাজধানী লাগোয়া সিটি করপোরেশন, সেই প্রত্যাশা পূরণ হচ্ছে না দাবি নগরবাসীর।
তথ্যানুসারে, বিগত ১১ বছরের প্রায় ৩ বছরই ভারপ্রাপ্ত মেয়র দিয়ে চলেছে সিটি করপোরেশন। ২০১৩ সাল থেকে প্রথম নির্বাচিত মেয়র ছিলেন প্রয়াত বিএনপি নেতা অধ্যাপক এম এ মান্নান। তিনি রাজনৈতিক মামলাসংক্রান্ত হয়রানির ও জেলে থাকায় দীর্ঘ ২৩ মাস ছিলেন সিটির দায়দায়িত্বের বাইরে। তার অবর্তমানে ভারপ্রাপ্ত হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন কাউন্সিলর কিরণ । ২০১৮ সালে নির্বাচনে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী জাহাঙ্গীর আলম সিটি মেয়র নির্বাচিত হন। নির্বাচিত হওয়ার পর তার বিরুদ্ধে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বিতর্কিত মন্তব্য সংবলিত অডিও-ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। পরে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় তাকে মেয়র পদ থেকে সাময়িক বরখাস্ত করে। এতে আবারও মেয়রহীন হয়ে পড়ে নগরবাসী। তখন ভারপ্রাপ্ত মেয়রের দায়িত্বে আসেন আগের ২৩ মাস দায়িত্ব পালন করা সেই কাউন্সিলর অর্থাৎ প্যানেল মেয়র আসাদুর রহমান কিরন। সর্বশেষ ২০২৩ সালে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে জয়লাভ করেন জায়েদা খাতুন।
নগরবাসী বলছে, অনভিজ্ঞ ও বয়স্ক হওয়ায় ছেলে জাহাঙ্গীর আলমের কারণে জায়েদা খাতুনকে ভোট দিয়ে জয়যুক্ত করা হয়েছে। উদ্দেশ্য ছিল জাহাঙ্গীর আলমকে সঙ্গে নিয়ে নগরবাসীর জন্য কাজ করে যাবেন জায়েদা। নির্বাচনের আগে ও জয়লাভের পর সেই আশ্বাস বাণী শুনিয়েছেনও। কিন্তু নির্বাচনের ১ বছর পেরিয়ে গেলেও কোথাও কোনো দৃশ্যমান কাজ হয়নি। বরং নির্বাচনের আগে চলমান যে কাজগুলো ছিল সেগুলোও বিভিন্ন অজুহাতে বন্ধ করে রাখা হয়েছে। ইশতেহারে ট্যাক্স মওকুফের কথা বলা হলেও সেই কথা রাখা হয়নি। সিটি করপোরেশন এলাকার খানাখন্দে ভরা রাস্তাঘাট, জলাবদ্ধতা, অতিরিক্ত ময়লা বিল, বর্জ্যের অব্যস্থাপনা কিছুই উন্নয়ন করা হয়নি। এদিকে আওয়ামী লীগ ক্ষমতা হারিয়েছে, জাহাঙ্গীরও আত্মগোপনে। ফলে সিটি করপোরেশনের অবস্থা আরও বেহাল হতে যাচ্ছে।
গাজীপুর নাগরিক ফোরামের সভাপতি অ্যাডভোকেট জালাল উদ্দিন বলেন, গাজীপুর সিটি করপোরেশন শুধু নামেই চলছে। রাস্তাঘাট বেহাল অথচ তারা একে অন্যকে দোষারোপ করে শুধু। সিটি করপোরেশন হওয়ার জন্য যেসব নাগরিক সুবিধা থাকার দরকার, তার কিছুই গাজীপুর সিটিতে নেই। নাগরিক সেবা না বাড়ায় আমরা হতাশ হয়ে পড়েছি। নতুন মেয়র নির্বাচিত হওয়ার পরও কোনো কাজ করেননি। এখন সমস্যা আরও বাড়বে।
গাজীপুর সিটি করপোরেশনের সচিব মো. আব্দুল হান্নান বলেন, প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা দেশের বাইরে আছেন। তার অবর্তমানে রুটিন দায়িত্বগুলো আমিই দেখছি। কর্মকর্তাদের অনুপস্থিত থাকার বিষয়ে বলেন, জরুরি প্রয়োজনে বাইরে যেতে পারে। মেয়র নগর ভবনে না এলেও ফিল্ড ওয়ার্কের কাজ করছেন। তবে জাহাঙ্গীর আলম কোথায় আছেন সেটা আমি জানি না।
সার্বিক বিষয় জানতে গাজীপুর সিটি করপোরেশন মেয়র জায়েদা খাতুনের ব্যক্তিগত মোবাইলে একাধিকবার ফোন দিলেও পাওয়া যায়নি।