খোকন বিকাশ ত্রিপুরা জ্যাক, খাগড়াছড়ি
প্রকাশ : ২৭ জুলাই ২০২৪ ১৮:৪৩ পিএম
আপডেট : ২৭ জুলাই ২০২৪ ১৮:৫১ পিএম
দুই পা নেই, থাকার ঘর নেই, স্ত্রী-সন্তানকে নিয়ে চার সদস্যের অভাবী সংসার। কোনোমতে ঠাঁই হয়েছে সৎবাবার বাড়ির এক কোণে। বলছিলাম খাগড়াছড়ির পানছড়ি উপজেলার চেঙ্গী ইউনিয়নের ২ নং ওয়ার্ডের রত্নসেন পাড়ার বাসিন্দা সোহেল চাকমার কথা। তার নিজের ঘরবাড়ি, জায়গাজমি নেই। বাবা মারা যায় ২০০১ সালে। এরপর মা দ্বিতীয় বিয়ে করে স্বামীর সাথে রত্নসেন পাড়ায় সংসার পেতেছেন। মায়ের সাথেই সেখানে দুই ভাইসহ থাকেন তিনি। অন্য দুই ভাই প্রতিবন্ধী।
বাবাহারা এই ছেলেটি ২০১৮ সালে দীঘিনালার সাধকছড়া পাড়ার সূর্য্যপ্রভা চাকমাকে বিয়ে করেন। পরে শ্বশুরবাড়িতে ঘরজামাই হিসেবে বসবাস শুরু করেন। সেখানেও দিনমজুরি করে সংসার চালাতেন। কিন্তু ২০২২ সালে বর্ষা মৌসুমে প্রতিদিনের ন্যায় কাজ শেষে বিকালে গাড়ি করে বাড়ি ফেরার পথে সড়ক দুর্ঘটনায় দুটি পা হারিয়ে ফেলেন। এর কয়েক মাস পরে তাকে শ্বশুরবাড়িতে আর থাকতে দেওয়া হয়নি। চলে যান মা ও সৎবাবার বাড়িতে। আয়-রোজগার না থাকায় স্ত্রী-সন্তানকে নিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করতে শুরু করেন। এসব সহ্য করতে না পেরে তার স্ত্রীও তাকে ছেড়ে বাপের বাড়িতে চলে যান।
পরে তিনি প্রতিজ্ঞা করেন, যেমন করেই হোক, নিজে কিছু করবেন। প্রতিবন্ধিত্বকে পেছনে ফেলে স্বাবলম্বী হবেন। স্ত্রী-সন্তানের মুখে একদিন হাসি ফোটাবেন। এই প্রতিজ্ঞা আর ইচ্ছাশক্তি নিয়েই তার পথচলা শুরু।
সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, মানুষের সহযোগিতায় তিনি একটা চায়ের দোকান দিয়েছেন। খাগড়াছড়ি সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি প্রদীপ চৌধুরী বলেন, আমরা সক্ষম মানুষেরা লেখাপড়া করার পর চাকরির জন্য হন্যে হয়ে ঘুরি। সেই জায়গায় সোহেল প্রত্যন্ত জনপদ, পানছড়ির সীমান্তবর্তী এলাকায় এক অনন্য উদাহরণ সৃষ্টি করেছেন। সমাজের বিত্তমান মানুষদের সাধ্যমতো সোহেলের পাশে থাকার আহ্বান জানান প্রদীপ চৌধুরী।
খাগড়াছড়ি সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের সাবেক প্রধান শিক্ষিকা ত্রিনা চাকমা বলেন, সোহেল চাকমা একজন বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন ব্যক্তি এবং সে নিজেকে বোঝা না ভেবে নিজে নিজে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার অদম্য চেষ্টা করে যাচ্ছে। আমি সোহেলের বিষয়ে সবার সুদৃষ্টি কামনা করছি। তার ঘরবাড়ি নেই, সরকারিভাবে যেন একটা ঘর বরাদ্দ দেওয়া হয়। সে ব্যাপারে জেলা প্রশাসক, উপজেলা নির্বাহী অফিসারের সুদৃষ্টি দেওয়ার আহ্বান জানান তিনি।
স্বপ্ন প্রতিবন্ধী আশ্রমের প্রতিষ্ঠাতা কিশোর চাকমা বলেন, কয়েক মাস আগে সোহেল চাকমার বিষয়ে সেখানকার একজন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একটি স্ট্যাটাস দেন। পরে সেটা দেখার পর আমি তাকে নিয়ে লেখালেখি ও সকলের সহযোগিতা কামনা করি। আমার আশ্রমে নিয়ে এসে কয়েকদিন থাকতে দিয়েছিলাম। অসহায় অবস্থায় সংসার ও স্ত্রী-সন্তানের ভরণপোষণ দিতে না পারায় স্ত্রী সূর্য্যপ্রভাও অভিমান করে তাকে ছেড়ে বাবার বাড়িতে চলে যায়। পরে স্ত্রী-সন্তানকে নিয়ে পুনরায় সংসার করার পণ করেন সোহেল চাকমা। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তার আত্মকর্মসংস্থানের জন্য অর্থ সংগ্রহ শুরু করি। সংগৃহীত অর্থ দিয়ে ছোট্ট দোকান দাঁড় করিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছি।
পানছড়ি উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা মো. শামসুল আলম বলেন, সোহেল চাকমা প্রতিবন্ধিত্বকে জয় করে স্ব-উদ্যোগে এই অবস্থায় এসেছে। আমরা প্রতিবন্ধীদের জন্য যতগুলো সরকারি সুযোগ-সুবিধা আছেÑ দেওয়ার চেষ্টা করব। আমাদের এককালীন অনুদান ও বিশেষ অনুদান এলে সহযোগিতা দেওয়া হবে।
জেলা প্রতিবন্ধী কর্মকর্তা মো. শাহজাহান বলেন, সোহেল চাকমা প্রতিবন্ধিত্বকে জয় করে সমাজকে দেখিয়ে দিয়েছেন, তারাও একটু সহযোগিতা পেলে সমাজের বোঝা না হয়ে সম্পদে পরিণত হয়। প্রতিবন্ধীরা সমাজের বোঝা নয়, তারা আমাদেরই সম্পদ, সমাজেরই সম্পদ। তারা একেবারে পশ্চাৎপদ এরিয়াতেও দেখিয়ে দিতে পারে, প্রতিবন্ধীরাও অন্যান্য স্বাভাবিক মানুষের মতোই সমাজ ও দেশের জন্য ভূমিকা রাখতে পারে। সোহেল চাকমা সেই উদাহরণ। প্রতিবন্ধী কর্মকর্তাও সোহেলের পাশে থাকার আশ্বাস দিয়েছেন।