সরেজমিন চমেক হাসপাতাল
আবু রায়হান তানিন, চট্টগ্রাম
প্রকাশ : ২৭ জুলাই ২০২৪ ১১:৪৯ এএম
হকার আবুল বশার ১৮ জুলাই বিকালে ভ্যানে করে আম বিক্রি করতে গিয়ে চট্টগ্রম গিয়ে চট্টগ্রাম নগরীর বহদ্দারহাট মোড়ে পায়ে গুলিবিদ্ধ হন। ওই ঘটনায় খোয়া গেছে তার ভ্যানটিও। চট্টগ্রাম মেডিকেল থেকে শুক্রবার বিকালে তোলা। ছবি : নিপুল কুমার দে
‘ভ্যানে করে আম বিক্রি করি। বৃহস্পতিবার বিকালে বহদ্দারহাট ভোলা কাউন্টারের সামনে যাই। গণ্ডগোল শুরু হলে গাড়ি নিয়ে সামনে দৌড়ানো শুরু করি। হঠাৎ খেয়াল করলাম বাম পায়ে আর জোর পাই না। সড়কে পড়ে গেলাম। বাম পা থেকে ফিনকি দিয়ে রক্ত বের হচ্ছে। রাস্তায় শত শত মানুষ ছোটাছুটি করছে। একজনকে বললাম, ভাই আমাকে বাঁচান। তিনি কয়েকগজ দূরে নিয়ে আবার ফেলে চলে গেলেন। কিছুক্ষণ পর অচেতন হয়ে যাই। জ্ঞান ফিরে দেখি হাসপাতালে।’
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের ৭৯ নম্বর ওয়ার্ডের শয্যায় শুয়ে গুলিবিদ্ধ হওয়ার বর্ণনা দিচ্ছিলেন হকার আবুল বশার। কোটা সংস্কার ইস্যুতে সংঘর্ষের ঘটনায় বাম পায়ের হাঁটুর নিচে গুলিবিদ্ধ হন তিনি। বাম পায়ের হাড় ছেদ করে বের হয়ে গেছে বুলেট। তার বাড়ি চাঁদপুরের শাহরাস্তি উপজেলায়। দুই কন্যা সন্তান ও স্ত্রীকে নিয়ে বিবিরহাটে একটি ভাড়া ঘরে থাকেন। গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর ভ্যানেরও সন্ধান পাননি।
আবুল বশার প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, গ্রামে মা আর দুই ভাই থাকে। সবার সংসারে টানাটানি। মা খবর শুনে ছুটে এসেছেন। কিন্তু দৌড়াদৌড়ি করার লোক তো নেই, টাকাও নেই। একটু ধরে নিচে নিয়ে যাবে, এটার জন্যও ১০০-২০০ টাকা নিয়ে ফেলে। এত টাকা কই পাব? আয় রোজগার তো নেই। পড়েছি ভোগান্তিতে। কাল ড্রেসিং করাতে মিনি ওটিতে গেলাম বিকাল ৫টার দিকে। রোগীদের লম্বা সিরিয়াল। যে যেমনে পারছে ঢোকাচ্ছে। আমার ড্রেসিং করে ওয়ার্ডে আসতে আসতে ফজরের আজান দিয়েছে। পাশের ওয়ার্ডের আন্টি অনেক টেনশন করছে আমার জন্য। কোনো মানবতা নাই ভাই, কেউ কিছু বলেও না শুনেও না। বুঝতে পারছি না কী করব।
পাশ থেকে বৃদ্ধা বাসন্তী দাশ মাথা নেড়ে সায় দেন। স্বামী কমল দাশকে নিয়ে তিনিও কয়েক দিন ধরে আছেন পাশের শয্যায়। আবুল বাশারের জন্য আফসোস করে বললেন, বেচারা খুব বিপদে পড়ে গেছে। খাওয়া-দাওয়ারও কষ্ট করছে। তার জন্য খুব মায়া হয়। পরিচিত কি না জানতে চাইলে হেসে উত্তর দিলেন, আমি তো একজন মা। একজন মা পৃথিবীর সবার মা। যেকোনো সন্তানের ছেলের কষ্টে মায়ের কষ্ট হয়।
চট্টগ্রামে বহদ্দারহাট মোড়ের সংঘর্ষের ঘটনাসহ কোটা সংস্কার ইস্যুতে গুলিবিদ্ধ বাশারের মতো আরও চারজন চিকিৎসা নিচ্ছেন চট্টগ্রাম মেডিকেলের অর্থোপেডিক ওয়ার্ডে। এর মধ্যে দুজন ছাত্র, এক শিশু ও একজন শ্রমিক রয়েছে। যাদের কেউ আন্দোলনে গিয়ে গুলিবিদ্ধ হয়েছেন, কেউ জীবিকার তাগিদে রাস্তায় বের হয়ে গুলিবিদ্ধ হয়েছে। গতকাল শুক্রবার সরেজমিনে চট্টগ্রাম মেডিকেলের ২৬ ও ৭৯ নং ওয়ার্ড ঘুরে গুলিবিদ্ধ হওয়া এসব মানুষ ও তাদের স্বজনদের মধ্যে আক্ষেপ, হতাশা, শঙ্কার এক মিশেল দেখা গেল।
৭৯ নং ওয়ার্ডের তিন নম্বর শয্যায় আছে ১৪ বছরের শিশু মো. সুজন। বাবা দ্বিতীয় বিয়ে করার পর মানুষের ঘরে কাজ করে তাদের চার ভাইবোনকে লালনপালন করেন মা নূরনাহার বেগম। চার মাস আগে সুজনকে র্যাব-৭ এর চান্দগাঁও ক্যাম্পের মেসে চাকরিতে দেন। ঘটনার দিন কর্মস্থল থেকে খাজা রোডের বাসায় ফিরছিল সুজন। ওই সময় পায়ে গুলিবিদ্ধ হয়। সুজনের মা নূরনাহার বেগম বলেন, ড্রেসিংয়ের সময় ওর কান্নায় সবাই আঁতকে ওঠে। আমার বাচ্চা একটা ছেলে। সে গুলি খেল। অভাবের সংসার, কম দুঃখে তো তারে কাজে দিইনি। কাজের বয়সও হয়নি। সেই ছেলের এই অবস্থা। বলেই ফুঁপিয়ে কান্না শুরু করেন নূরনাহার। তবে এই বিপদের দিনে সবাই পাশে দাঁড়াচ্ছে, এটা তাকে অনেকটাই সাহস দিচ্ছে বলে জানান তিনি।
আহতদের মধ্যে সবচেয়ে গুরুতর অবস্থা নগরীর একটি বেসরকারি কলেজের একাদশ শ্রেণির ছাত্র মো. গিয়াসের। ২৬ নম্বর ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন গিয়াস বহদ্দারহাটে গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। এখন পর্যন্ত তাকে ১০ ব্যাগ রক্ত দিতে হয়েছে। এখনও কথা বলার শক্তি পাচ্ছেন না, বসতে হচ্ছে অন্যের সহায়তায়। হালিশহর বি ব্লকের বাসিন্দা গিয়াসের বাবা কেবল অপারেটরের লাইনম্যান। দুই মাস আগে তার মা মারা গেছে। এখন তার ফুফু গুলজার বেগম ভাতিজার দেখাশুনা করছেন।
প্রতিদিনের বাংলাদেশকে তিনি বলেন, বাবাকে ক্রিকেট খেলতে যাওয়ার কথা বলে ভাতিজা আমার আন্দোলনে চলে গেছে। দুই মাস আগে ছেলেটার মা মারা গেল। মাত্র কলেজে ভর্তি হইছে। আন্দোলনের সে কী বোঝে? গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর এখন পর্যন্ত ২০-২৫ হাজার টাকা খরচ হয়ে গেছে। ওর বাবা লাইনম্যানের চাকরি করে। এর থেকে ওর থেকে টাকা নিয়ে চিকিৎসা চলছে। খোঁজা ভাতে কী পেট চলে?
ভাতিজার বর্তমান অবস্থার কথা তুলে ধরে গুলজার বেগম বলেন, দুদিন আগে অবস্থা খারাপ হয়ে গেছিল। ডাক্তার বলেছে হয়তো বাঁচবে না। এর মধ্যে ১০ ব্যাগ রক্ত লাগছে। ছেলেটা শব্দ করে কথাও বলতে পারছে না। আরও রক্ত লাগতে পারে। এত রক্ত কোথায় পাব?
সঙ্গে ভয়ও তাড়া করছে অনেককে। তেমন একজন চটগ্রাম কলেজের ছাত্র জিয়াউল হক। চকরিয়ার একটি মসজিদের ইমামের তৃতীয় সন্তান জিয়াউল হক চট্টগ্রামের ওয়েল ফুডের কারখানায় কাজ করে নিজের পড়াশুনার খরচ চালান। চান্দগাঁও থানা এলাকায় গুলিবিদ্ধ হন তিনি। তার বাম পায়ের উরু ভেদ করে বের হয়ে যাওয়া বুলেট ওই অংশের হাড় চূর্ণবিচূর্ণ করে ফেলেছে। এরপর পুলিশ তার বাসায় গিয়ে খোঁজখবর নিয়েছে। গুলিবিদ্ধ হওয়ার ব্যথার সঙ্গে এখন ভয়ও তাড়া করছে জিয়াউল হক ও তার পরিবারকে।
তার মা খোরশেদা বেগম বলেন, ছেলে গুলি খেয়েছে শুনে মাটিতে গড়িয়ে কান্নাকাটি করেছি। একদিকে ছেলের জন্য কষ্ট, অন্যদিকে আশপাশের লোকজন ভয় দেখাচ্ছে। সবাই বলছে সে আন্দোলনে গেছে। তাই এখন পুলিশ মামলা দেবে, হয়রানি করবে। কিন্তু সে বলছে আন্দোলনে যায়নি। বড় ভাইয়ের বাসা থেকে তার বাসায় যাওয়ার পথে গুলি খেয়েছে।
খোরশেদা বেগমের চার সন্তানের সবাই লেখাপড়া করে। বড় ছেলে চট্টগ্রাম কলেজ থেকে এই বছর ইংরেজি সাহিত্যে অনার্স পরীক্ষা দিয়ে ফলাফলের অপেক্ষায় আছে। মেজো ছেলে কক্সবাজার পলিটেকনিক্যাল ইনস্টিটিউট থেকে ডিপ্লোমা শেষ করে ঢাকায় একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে বিএসসি পড়ছে। ছোটজন এবার দাখিল পরীক্ষা দেবে।
এই মুহূর্তে ছেলেকে নিয়ে কী ভাবছেন- এমন প্রশ্নের জবাবে খোরশেদা বেগম বলেন, তাদের বাবা ইমামের চাকরি করে। অনেক কষ্টে তারা লেখাপড়া করে। নিজেরা চাকরি করে, টিউশনি করিয়ে পড়ে। আমি শুধু চাই ছেলে সুস্থ হয়ে যাক। আর কোনো হয়রানি যেন না হয়। এর বাইরে কিছুই চাওয়ার নেই।