মনিরুজ্জামান বাবলু, চাঁদপুর
প্রকাশ : ১৬ জুলাই ২০২৪ ০৯:২৯ এএম
আপডেট : ১৬ জুলাই ২০২৪ ১০:৫৫ এএম
এখানে সেখানে থেকে কুড়িয়ে আনা গাছের পরিত্যক্ত শেকড়, গুঁড়ি বা কাঠÑ এসব দিয়েই চোখজুড়ানো আর্টপার্ক ‘মনবাগান’ গড়ে তুলেছেন চাঁদপুরের শাহরাস্তির শিল্পী সমীরণ দত্ত। সাধারণের চোখে যার কোনো মূল্য নেই; যা অকেজো, তা-ই তার হাতের ছোঁয়ায় হয়ে উঠেছে দৃষ্টিনন্দন শিল্প।
শাহরাস্তি উপজেলার ঘুঘুশাল গ্রামের সমীরণ দত্ত। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা শেষ করে একটি পোশাক কারখানায় হিসাবরক্ষক পদে যোগ দেন তিনি। একদিন রাস্তায় কুড়িয়ে পাওয়া কাঠের খণ্ড দিয়ে মনের খেয়ালে সৃজন করেন নতুন এক বিশেষ অবয়ব। এরপর থেকেই পরিত্যক্ত কাঠ, গাছের শেকড় ইত্যাদি হয়ে ওঠে তার মনন ও শিল্পচর্চার বিষয়।
পরিত্যক্ত এসব শিল্পকর্ম ও শিল্প উপকরণ নিয়ে কাজ করার জন্য সমীরণ দত্তকে জায়গা ভাড়া করতে হয়েছে। গড়ে তুলতে হয়েছে স্টুডিও। যার নাম রেখেছেন তিনি ‘মনবাগান’। এ বাগানের চারটি স্টলে রয়েছে তার নিজের তৈরি আসবাবসহ চার শতাধিক ভাস্কর্য। প্রায় ২৪ বছর ধরে এই শিল্পকর্মে জড়িত আছেন তিনি । এই পথচলায় তাকে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে এ দেশের প্রকৃতি, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রয়াত শিক্ষক মঞ্জুর করিম ও ভাস্কর্য শিল্পী ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিনী।
শিল্পী সমীরণ দত্ত প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, ‘এগুলো বাজারের পণ্য না। দৈনিক এসব বিক্রিও হয় না। যেসব শিল্পসমঝদার মানুষ এসব সংগ্রহ করেন, তারা ঠিক ক্রেতাও নন। বলা যায়, তারা পৃষ্ঠপোষক। শিল্পকর্মের মূল্য তো বাজারের সূত্রে পড়ে না। তা নির্ভর করে শৈল্পিক অবলোকনের ওপর।’
স্থানীয় বাসিন্দা ফয়েজ আহমেদ বলেন, ‘এমন শিল্পসত্তা অমূল্য। একবার যদি কেউ ‘মনবাগানে’র সৌন্দর্য উপলব্ধি করতে পারে, তাহলে তার পক্ষে কোনো অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড মনে আসার সুযোগ নেই।’
এলাকাবাসী ও দর্শনার্থীরাও মনে করে, ‘মনবাগানে’র মতো শিল্পকর্মকে পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে ধরে রাখতে হবে।’
আসবাব ও ভাস্কর্য বিক্রির অর্থ দিয়েই চলছে সমীরণ দত্তের সংসার। আসবাবের মধ্যে রয়েছে টেবিল, চেয়ার, সোফা, ডাইনিং টেবিল ইত্যাদি। আরও রয়েছে শিশুদের নানা খেলনা, কাঠের তৈরি হাতি, ঘোড়া, মাছ, পাখি ও অন্যান্য জীবজন্তুর অবয়ব আকৃতি দিয়ে নির্মিত নান্দনিক উপকরণ। কথায় কথায় তিনি বলেন, ‘তার এখানে গ্যালারিতে প্রদর্শিত ও অপ্রদর্শিত অবস্থায় এখনও চারশর মতো ভাস্কর্য রয়েছে। যেগুলোর শিরোনামÑ স্বাধীনতা, ঊনসত্তরের মিছিল, গন্তব্য, স্কুল গেট, গতি ও শৈশব, আজ হাটবার, কোথাও আমার হারিয়ে যাওয়ার নেই মানাÑ এরকম আরকি।’
তিনি বলেন, ‘আমার কাছ থেকে আমার পরিবার তেমন কিছু পায়নি। আমার সন্তানদেরও আমি বলিনি, তোমাদের জন্য ডাল-ভাত এবং শিক্ষাÑ এর বেশি কিছু আমি দিতে পারব না। এটুকু বলতে পারি, এই মনবাগানকে কেন্দ্র করে এই জগতে অন্তত তৃপ্তি নিয়ে বেঁচে আছি। পৃথিবী, রাষ্ট্র, সমাজÑ কারও প্রতি আমার কোনো অভিযোগ নেই। বরং আমি যা পাওয়ার তার চেয়ে বেশিও পেয়েছি।’
সমীরণের ‘মনবাগানে’ জেলা প্রশাসন থেকে গ্যালারি সংস্কার, উপজেলা থেকে রাস্তা সংস্কার ও পাকা আধুনিক শৌচাগারসহ বিভিন্ন সহযোগিতা করা হয়েছে। আরও সহযোগিতার আশ্বাসও দেওয়া হয়েছে।
শাহরাস্তি উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) রেজওয়ানা চৌধুরী বলেন, ‘মনবাগান’ আর্টপার্ক শাহরাস্তির এক চমৎকার দর্শনীয় স্থান। সমীরণ দত্ত নিভৃতে এই নিবিড় নিসর্গে কাজ করে চলেছেন। এই আর্টপার্ক ঘিরে পর্যটনের সম্ভাবনাও সৃষ্টি হয়েছে। আমাদের প্রশাসনের পক্ষ থেকে আর্টপার্কটিকে সার্বিক সহযোগিতা করা হচ্ছে।’
সমীরণ দত্ত তার ‘মনবাগানে’ পাখিদের খাবারদাবারের ব্যবস্থাও রেখেছেন। পার্কটিতে সাধারণের প্রবেশ মূল্য ১০ টাকা এবং শিক্ষার্থীদের জন্য ৫ টাকা। তবে মুক্তিযোদ্ধা, প্রতিবন্ধী ও প্রবীণরা আসতে পারেন বিনামূল্যে।