সাইফুল হক মোল্লা দুলু, মধ্যাঞ্চল
প্রকাশ : ১৩ জুলাই ২০২৪ ১৬:৩৫ পিএম
কিশোরগঞ্জ জেলা শহরে অবাধে ট্রাক্টর চলার কারণে তীব্র যানজটে জনজীবন বিপর্যন্ত হয়ে পড়েছে। শহরের ট্রিনপট্রি এলাকা থেকে তোলা। প্রবা ফটো
জেলা আইনশৃঙ্খলা কমিটির সভার সিদ্ধান্তকে উপেক্ষা করে কিশোরগঞ্জ শহরে অবাধে ট্রাক্টর চলছে। সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত ট্রাক্টর চলার কারণে জনজীবন অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছে। তা ছাড়া শহরে তীব্র যানজট ও শব্দদূষণের অন্যতম কারণ এই ট্রাক্টর। সরেজমিনে দেখা গেছে, জেলা শহরসহ আশপাশের এলাকায় অবাধে ট্রাক্টর চলছে। এতে করে শহর ও শহরতলির মানুষ অস্বস্তিতে রয়েছে। ট্রাক্টরের বিকট শব্দের কারণে শব্দদূষণে অসংখ্য নারী, শিশু, প্রবীণ ও রোগী বিপাকে পড়েছে। সকাল থেকে অসংখ্য ট্রাক্টরের চলাচলে শহরজীবনে অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়ে পড়ছে। শিশু ও বৃদ্ধরা ট্রাক্টরের দাপটে ঘর থেকে সড়কে আসতে ভয় পায়। ট্রাক্টরের বিকট শব্দ আর কালো ধোঁয়ায় পরিবেশ-প্রতিবেশের ওপর বিরূপ প্রভাব তাদের অক্সিজেনের ঘাটতিতে ফেলে দেয়।
জেলা আইনশৃঙ্খলা কমিটির একাধিক সভায় শহরে সকাল ৮টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত ট্রাক্টর, ভটভটি, লরি প্রবেশ নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে। কিন্তু জেলা পুলিশ, পৌর কর্তৃপক্ষ কোনো কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ না করায় অবস্থা অসহনীয় পর্যায়ে পৌঁছেছে বলে অভিযোগ পৌরবাসীর। শহরের স্টেশন রোড ও ঈশা খাঁ রোড়ের বাসিন্দারা জানান, ট্রাক্টরের কারণে সারা শহরে তীব্র যানজট সৃষ্টি হওয়ায় লোকজনের হেঁটে চলাচল করতে হতে হয়। এজন্য তাদের দীর্ঘ সময় ব্যয় করতে হয়। তা ছাড়া ট্রাক্টরের বিকট শব্দ শিশুদের মধ্যে এক ধরনের আতঙ্ক বিরাজ করে। এই ভয় ও আতঙ্ক শিশুদের স্বাভাবিক জীবনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে বলে চিকিৎসকরা জানান।
শিশু শিক্ষার্থীর অভিভাবকরা জানান, তাদের সন্তানরা স্কুল ছুটির পর ট্রাক্টরের প্যাঁচে পড়লে বাড়ি ফিরতে তাদের এক ঘণ্টা সময় বেশি ব্যয় করতে হয়। এ সময় বাবা-মা সন্তানের দুশ্চিন্তায় থাকেন। তাদের মধ্যে মানসিক ও স্নায়ুবিক চাপ বেড়ে যায়। ফলে সারা দিনই তাদের খারাপ লাগে। ট্রাক্টর চলাচল সমস্যার দ্রুত সমাধানের জন্য প্রশাসন ও পৌর কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন।
কিশোরগঞ্জ সচেতন নাগরিক কমিটির সহসভাপতি স্বপন কুমার বর্মণ বলেন, শহরে দিনের বেলায় ট্রাক্টর চলাচল নিষিদ্ধ থাকলেও তারা স্থানীয় প্রশাসনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে দাপটের সঙ্গে ট্রাক্টর চালিয়ে যাচ্ছেন। ফলে শহরে স্বাভাবিকভাবে চলাফেরা করা যাচ্ছে না। অ্যাম্বুলেন্সে করে কোনো রোগীকে যথাসময়ে হাসপাতালে নেওয়া যাচ্ছে না। এ ব্যাপারে তিনি প্রশাসনে কঠোর নজরদারি ও হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন।
সম্প্রতি কিশোরগঞ্জ সরকারি মহিলা কলেজ সড়কে একটি ট্রাক্টর ঢুকে চরম যানজটের সৃষ্টি করে। ফলে ওইদিন অসংখ্য এইচএসসি পরীক্ষার্থীকে পরীক্ষার এক মিনিট আগে হলে প্রবেশ করতে দেখা যায়। এইচএসসি পরীক্ষার্থী তাইফা সাইফ বলেন, ট্রাক্টরের কারণে বিলম্বে হলে প্রবেশ করায় তার পরীক্ষা অনেকটাই খারাপ হয়েছে। কারণ সে মানসিকভাবে কিছুটা ভেঙে পড়েছিল।
জেলা মহিলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বিলকিস বেগম বলেন, সড়কে মালবাহী ট্রাক্টর ঢুকে এক অস্বাভাবিক পরিস্থিতির সৃষ্টি করে। রিকশা, অটোরিকশাসহ সব যান আটকা পড়ায় পরীক্ষার্থীদের ১৫ মিনিট সময় নষ্ট হয়। এতে অনেক পরীক্ষার্থী মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
অভিভাবকরা জানান, শহরে ট্রাক্টর চলার কারণে শিশু শিক্ষার্থীরা স্কুল থেকে সড়কের ওপারে পৌঁছাতে পারে না। কারণ ট্রাক্টর তাদের আটকিয়ে দেয়। এ অবস্থায় সড়কের ওপারে দাঁড়িয়ে থাকা অভিভাবকরা বিপাকে পড়েন। ফলে কমপক্ষে ২০-৩০ মিনিটি দাঁড়িয়ে থেকে একসঙ্গে বাড়ি ফেরেন ছাত্রী ও তার অভিভাবকরা। একটি সড়কে ট্রাক্টর ঢুকে পড়লে অসংখ্য ইজিবাইক, রিকশা ও অন্যান্য যান আটকে অসহনীয় যানজটের সৃষ্টি করে।
শহরের শোলাকিয়া এলাকার বাসিন্দা আমিনুল হকসহ একাধিক পৌরবাসী বলেন, ২০ বছর আগে এত বেশি ট্রাক্টর ছিল না। এখন নির্মাণসামগ্রী পরিবহন থেকে সবকিছুতেই ট্রাক্টরকে ব্যবহার করা হচ্ছে। পৌর শহরে নিয়ন্ত্রণহীনভাবে ট্রাক্টর চলাচলের কারণে সড়কগুলো নির্ধারিত মেয়াদের আগেই ভেঙে যাচ্ছে। এসব পৌর কর্তৃপক্ষ যথাযথ তদারকি করছে না। ফলে শহরে নির্বিঘ্নে ট্রাক্টর চলছে।
পরিবেশ রক্ষা মঞ্চের (পরম) সভাপতি অধ্যক্ষ শরীফ মো. সাদী বলেন, ট্রাক্টর শহরে শব্দদূষণের যানজটের অন্যতম কারণ। পরমের পক্ষ থেকে দিনের বেলায় ট্রাক-ট্রাক্টর বন্ধ করার দাবিতে একাধিকবার মানববন্ধনসহ বিভিন্ন কর্মসূচি হয়েছে। কিন্তু এসব বন্ধে উল্লেখযোগ্য কোনো উদ্যোগ নেয়নি প্রশাসন কিংবা পৌর কর্তৃপক্ষ।
কিশোরগঞ্জ ট্রাফিক ইন্সপেক্টর মো. শাহজাহান বলেন, দিনের বেলায় ট্রাক্টর বন্ধ করা না গেলে শহরে যানজট নিয়ন্ত্রণ ও স্বাভাবিক চলাফেরা করা কঠিন হয়ে পড়বে। তা ছাড়া পরিবেশ নষ্ট হওয়ার পাশাপাশি দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে। শহরে যান চলাচলের বিষয়ে একটি নীতিমালা প্রণয়ন করা অত্যন্ত জরুরি বলেও তিনি অভিমত ব্যক্ত করেন।
পৌর মেয়র মাহমুদ পারভেজ জানান, ট্রাক্টর, ট্রাক, ভটভটির আধিক্য শহরের বহমান স্বাভাবিক সৌন্দর্যকে নষ্ট করে দিচ্ছে। পাশাপাশি তীব্র ও অসহনীয় যানজটের সৃষ্টি হচ্ছে। জেলা প্রশাসন, জেলা পুলিশ ও জনগণকে সঙ্গে নিয়ে এসব নিয়ন্ত্রণ করতে পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
পরিবেশ অধিদপ্তরের শব্দদূষণ প্রতিরোধ প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক মো. ফজলে এলাহি বলেন, ট্রাক্টর চলার কারণে যে শব্দদূষণ হয় তা শিশুর স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। প্রশাসনকে সঙ্গে নিয়ে সচেতন নাগরিক সমাজ ট্রাক্টর সীমিত পর্যায়ে চলাচলের ব্যবস্থা নিতে পারে। আগামী প্রজন্মকে রক্ষা করার জন্য এর কোনো বিকল্প নেই।