× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

সিলেট সীমান্ত

চোরাকারবার থামাবে কে

কাওছার আহমদ, সিলেট

প্রকাশ : ১১ জুলাই ২০২৪ ১৬:৫৪ পিএম

ফাইল ফটো

ফাইল ফটো

সিলেট সীমান্তে কিছুতেই বন্ধ হচ্ছে না চোরাকারবারিদের তৎপরতা। বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) সদস্যদের চোখ ফাঁকি দিয়ে প্রতিদিন সীমান্তের অর্ধশতাধিক স্পট দিয়ে চিনি, ইয়াবা, গাঁজা, ফেনসিডিল, গরু, মহিষ, বিড়ি, পান, শাড়ি ও কসমেটিকসসহ নানা চোরাই পণ্য বাংলাদেশে প্রবেশ করছে। আবার বাংলাদেশ থেকেও পাচার হচ্ছে মটরশুঁটি, গৃহপালিত পশু হাঁস-মুরগিসহ দেশীয় নানা পণ্য। যদিও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা প্রতিদিন জেলার বিভিন্ন স্থান থেকে এসব চোরাচালান আটক করছেন এবং জড়িত অনেককে আইনের আওতায় এনেছেন। তবু বন্ধ হচ্ছে না এসব কর্মকাণ্ড। এ অবস্থায় সাধারণ মানুষের প্রশ্নÑ চোরাকারবারিদের থামাবে কে?

এসব চিনি চোরাচালানে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের নেতা থেকে শুরু করে যুবলীগ, ছাত্রলীগের নেতাকর্মী- এমনকি স্থানীয় সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ের জনপ্রতিনিধিদের নাম উঠে এসেছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একশ্রেণির অসাধু কর্মকর্তার সরাসরি মদদে আসছে একের পর এক চিনি চোরাচালান। সাম্প্রতিক সময়ে পুলিশ এসব চোরাচালানসহ বাহকদের গ্রেপ্তার করলেও মূল হোতারা রয়ে গেছে ধরাছোঁয়ার বাইরে। স্থানীয় পর্যায়ের লোকজনসহ বিভিন্ন সূত্রের সাথে কথা বলে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।

যেভাবে আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের নাম জড়ায়

চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত সিলেট জেলা ও মহানগর পুলিশের বিভিন্ন থানায় চিনি চোরাচালানের ঘটনায় মোট ৬১টি মামলা হয়েছে। এতে গ্রেপ্তার করা হয়েছে ১৪৭ জনকে। 

এ সবের মধ্যে বিয়ানীবাজারে ৪০০ বস্তা চিনি লুটের মামলা হয় উপজেলা ও পৌর ছাত্রলীগের শীর্ষ নেতাদের বিরুদ্ধে। বিয়ানীবাজার উপজেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক জাহিদুল হক তাহমিদ ও পৌর ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক আশরাফুল আলম শাকেলসহ চারজনকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে। চিনি লুটের ঘটনায় সিলেটজুড়ে তোলপাড় শুরু হলে সংগঠনটির কেন্দ্রীয় নেতারা তাৎক্ষণিক বিয়ানীবাজার উপজেলা ও পৌর ছাত্রলীগের কমিটি বিলুপ্ত করে। অথচ ৩৩ বছর পর গত ১১ মার্চ বিয়ানীবাজার উপজেলা ও পৌর ছাত্রলীগের কমিটি গঠন করা হয়েছিল। তখন জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক রাহেল সিরাজ তার নিজস্ব আইডি থেকে সামাজিক মাধ্যমে বিয়ানীবাজার ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের উদ্দেশে একটি আবেগঘন স্ট্যাটাস দিয়েছিলেন।

অভিযোগ ওঠে, জকিগঞ্জ উপজেলা ছাত্রলীগ সভাপতি সুলতান আহমদ ও তার সহযোগীরা গত ১৩ জুন জকিগঞ্জের কালীগঞ্জে চোরাই চিনি লুট করে নিয়ে যান।

জৈন্তাপুর থানায় চোরাই চিনিকাণ্ডে একটি মামলায় আসামি হন নিজপাট ইউনিয়ন পরিষদের প্যানেল চেয়ারম্যান ও স্থানীয় ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মনসুর আহমদ। তার শ্যালক আব্দুল কাদিরও এই মামলার এজাহারভুক্ত আসামি। 

এছাড়া গত বছর ‘ভারতীয় চিনিকাণ্ডে’ সিলেটজুড়ে তোলপাড় চলছিল। ক্ষমতাসীন সংগঠনের নেতাকর্মীদের কেউ কেউ চিনি চোরাচালানে জড়িয়ে পড়েছেন বলে অভিযোগ ওঠে গত বছরের মাঝামাঝি। এর মধ্যে গত আগস্ট মাসে ছাত্রলীগের সাবেক কেন্দ্রীয় সদস্য ও সহকারী কৌঁসুলি (এপিপি) অ্যাডভোকেট প্রবাল চৌধুরী পুজন সামাজিক মাধ্যমে পোস্ট দিলে বিষয়টি সামনে আসে। এরপর অভিযুক্তরা হামলা চালিয়ে তাকে মারাত্মক আহত করে। হামলার ঘটনায় তিনি জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক, মহানগর সাধারণ সম্পাদকসহ ছাত্রলীগের ৫৫ নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে মামলা করেন।

যেসব সীমান্ত দিয়ে দেশে প্রবেশ করে-

গোয়াইনঘাট

স্থানীয়দের সাথে আলাপকালে জানা যায়, গোয়াইনঘাট উপজেলার বিছনাকান্দি দেশের একটি অন্যতম সেরা পর্যটন স্পট। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে এর নাম ছড়িয়েছে চিনি চোরাচালানের নিরাপদ রুট হিসেবে। সিলেটের যে সকল সীমান্ত দিয়ে চোরাই চিনি আসে; এর মধ্যে বিছনাকান্দির নাম সবার শীর্ষে।

উপজেলার নকশিয়া পুঞ্জি পিয়াইন ও ডাউকি নদী, জিরো পয়েন্ট, লামাপুঞ্জি, গুচ্ছগ্রাম, লালমাটি, সংগ্রামপুঞ্জি, তামাবিল, নলজুরী ও তালাবাড়ী দিয়ে ভারতীয় চিনি নিয়ে আসা হয়। আর এর সাথে জড়িত বলে গোয়াইনঘাট উপজেলা আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক ও লেঙ্গুড়া ইউনিয়ন চেয়ারম্যান মুজিবুর রহমান, স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা সামসুল হক, মুজিব মেম্বার ও ফয়জুল হক, ইউপি যুবলীগ নেতা দেলোয়ার হোসেন লনিসহ অনেকের নাম উঠে এসেছে। 

কানাইঘাট

স্থানীয় সূত্রগুলোর সাথে কথা বলে জানা গেছে সুরইঘাট সুনাতনপুঞ্জি, বড়বন্দ, নুনছড়া, লুহাজুরি, ভালুকমারা ও ডনাসহ বেশ কয়েকটি সীমান্ত দিয়ে দেদার নিয়ে আসা হয় অবৈধ চিনি। অর্ধশতাধিক কারবারি এই চোরাচালান করে আসছে। প্রকাশ্যে এটি ঘটলেও কানাইঘাট পুলিশ কিংবা সীমান্তের প্রহরী বিজিবি এর কোনো কিছুই দেখছে না। এদের কারও রাজনৈতিক পরিচয় না থাকলেও শুধু আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রশ্রয়ে তারা বেপরোয়া হয়ে উঠছে।

সুরইঘাট সুনাতনপুঞ্জি সীমান্ত দিয়ে বাউরবাগ প্রথম খণ্ডের আহমদ মেম্বার, তোতা ও তার ছেলে মিজান, নাজিম, হোসেন, ফয়েজ, বুদন, সুনাতনপুঞ্জির জাকারিয়া, হারুন, বাউরবাগ দ্বিতীয় খণ্ডের জিল্লু এবং নয়াখেলের নাসির উদ্দিন চিনি চোরাচালানে জড়িত বলে জানা গেছে।

লোভা এলাকার বিভিন্ন সীমান্ত দিয়ে বড়গ্রামের নাহিদ, সাউদগ্রামের তেলি সুলতান, লালমাটির বিলাল এবং নুনছড়া আলুবাড়ী সীমান্ত দিয়ে কামরুল, নিহালপুরের মামুন ও নিহালপুর আমরতলের বিলাল; এছাড়া বড়বন্দ সীমান্ত দিয়ে হেলাল উদ্দিন, সেবুল আহমদ, নিজাম আহমদ, রুবেল আহমদ, রাহেল আহমদ ও হারুন মিয়াসহ বেশ কয়েকজন চিনি চোরাকারবার করে বলে তাদের নাম উঠে এসেছে।

জৈন্তাপুর

স্থানীয় বাসিন্দারা জানিয়েছেন, জৈন্তাপুর উপজেলার অন্তত ৩৫টি স্পট দিয়ে নিয়মিত ভারতীয় চিনির চোরাচালান আসে। এর মধ্যে আছেÑ মোকামপুঞ্জি, আলুবাগান, শ্রীপুর, আদর্শগ্রাম, মিনাটিলা, ছাগল খাউরী, মিনাটিলা সুপারি বাগান, কেন্দ্রী মন্দির, কেন্দ্রী কাটালবাড়ী, কেন্দ্রী রাবার বাগান, কেন্দ্রী লম্বাটিলা, ডিবির হাওর, আসামপাড়া, চার নম্বর বাংলাবাজার, মরিসমারা, ঘিলাতৈল, খলারবন্দ, ফুলবাড়ী, গৌরীশঙ্কর, টিপরাখলার, করিমটিলা, ভিতরগোল, গোয়াবাড়ী, জঙ্গীবিল, ইয়াংরাজা, বাইরাখেল ও হর্ণিসহ বেশ কয়েকটি স্পট।

এসব এলাকায় নিজপাট ইউনিয়ন পরিষদের প্যানেল চেয়ারম্যান ১নং ওয়ার্ড-এর সদস্য ও ১নং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মনসুর আহমদ, চারিকাটা ইউনিয়নের প্যানেল চেয়ারম্যান সামসুজ্জামান সেলিম, আসামপাড়া আদর্শ গ্রামের আব্দুল জব্বার, আহমদ রুবেল, শামীম আহমদ, পুলিশের বহিষ্কৃত সদস্য বিরাইমারা গ্রামের আব্দুল করিম ওরফে পুলিশ করিমসহ বেশ কয়েকজনের নাম এসেছে।

কোম্পানীগঞ্জ

চোরাকারবারে থেমে নেই সীমান্তবর্তী উপজেলা কোম্পানীগঞ্জও। উপজেলার উৎমা, লামাগ্রাম, মাঝেরগাঁও, তুরং, উত্তর রনিখাই ইউনিয়নের বরম সিদ্ধিপুর, ইসলামপুর পশ্চিম ইউনিয়নের নারাইনপুর, চিকাডহর ও ছনবাড়িসহ বেশ কয়েকটি স্পট দিয়ে চোরাচালানের চিনি আসে বলে স্থানীয় লোকজন জানিয়েছে। উপজেলা ছাত্রলীগের সভাপতি উমর আলীর নামও চিনি চোরাচালানে জড়িয়ে পড়েছে।

অভিযুক্তদের বক্তব্য

অভিযোগ সম্পর্কে জানতে চেয়ে প্রতিদিনের বাংলাদেশ থেকে অভিযুক্তদের সাথে যোগাযোগ করা হলে অনেকে ফোন রিসিভ করেননি। যারা করেছেন, তাদের বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়েছে।

গোয়াইনঘাট উপজেলা আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক ও লেঙ্গুড়া ইউনিয়ন চেয়ারম্যান মুজিবুর রহমান বলেন, ‘এটি সম্পূর্ণ মিথ্যা, জনপ্রিয়তায় ঈর্ষান্বিত হয়ে অপপ্রচার করা হচ্ছে।’ 

গোয়াইনঘাট উপজেলা যুবলীগ নেতা গোলাম কিবরিয়া রাসেল বলেন, ‘এসবে জড়িত নই। যাছাই করে দেখতে পারেন বলে দাবি তার।’

জৈন্তাপুরের চারিকাটা ইউনিয়নের প্যানেল চেয়ারম্যান সামসুজ্জামান সেলিম বলেন, একসময় চোরাচালানের সাথে জড়িত ছিলাম কিন্তু এখন বাদ দিয়ে দিছি। এক বছর আগে ছেড়ে দেওয়ার পরও বদনাম পিছু ছাড়ছে না।

আর কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা ছাত্রলীগ সভাপতি উমর আলীর দাবি, ‘তিনি ভদ্র পরিবারের সন্তান। কোম্পানীগঞ্জের সুশীল সমাজের সাথে তার সম্পর্ক। চোরাচালানের সাথে তার সম্পৃক্ততা নেই।’

বিজিবি সিলেট সেক্টরের অপারেশন শাখার অতিরিক্ত পরিচালক মেজর মো. মেজবাহ উদ্দীন রাসেল বলেন, চোরাচালানের বিষয়ে জিরো টলারেন্সে কাজ করছে বিজিবি। অবৈধভাবে দেশের ভেতরে কোনো কিছু যাতে ঢুকতে না পারে, সে বিষয়ে ২৪ ঘণ্টা সতর্ক দৃষ্টিতে টহল দিচ্ছে বিজিবি।

সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশের (এসএমপি) উপকমিশনার আজবাহার আলী শেখ বলেন, চোরাচালান প্রতিরোধে মেট্রোপলিটন পুলিশ কাজ করে যাচ্ছে। মেট্রো এলাকায় যখনই কোনো চোরাচালানের খবর পাই, সাথে সাথে অভিযান চালিয়ে মালামাল জব্দ ও জড়িতদের আটক করি। চোরাচালান নির্মূল না হওয়া পর্যন্ত আমাদের তৎপরতা অব্যাহত থাকবে। 

শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা