অতিবৃষ্টি
প্রবা প্রতিবেদক
প্রকাশ : ০১ জুলাই ২০২৪ ২২:১৩ পিএম
আপডেট : ০১ জুলাই ২০২৪ ২২:৩৬ পিএম
পাহাড়ি ঢলের পানি সবচেয়ে বেশি তাহিরপুরে। এই উপজেলার যাদুকাটা নদী হয়ে পানি বিভিন্ন গ্রাম প্লাবিত করছে। সোমবার তাহিরপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের আঙিনায় পানি প্রবেশ করেছে। প্রবা ফটো
অত্যধিক বৃষ্টিতে তিন দিনের মধ্যে দেশের উত্তর ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বেশিরভাগ নদ-নদীর পানি বিপদসীমার ওপরে চলে গেছে। এসব এলাকায় বন্যার আশঙ্কা করা হচ্ছে। এর বাইরে মাত্র এক মাসের মধ্যে তৃতীয় দফা বন্যার কবলে পড়েছে সিলেট জেলা, যদিও দ্বিতীয় দফার বন্যার পানি এখনও নামেনি। এরই মাঝে অবিরাম বৃষ্টির কারণে নতুন করে বন্যা দেখা দিল। তবে সিলেট নগরীতে এবার এখনও বন্যার পানি ঢোকেনি।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আগামী চার দিন সিলেটে ও উজানে ভারী বৃষ্টিপাত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এভাবে টানা বৃষ্টিপাত হলে সিলেটে নতুন করে বন্যা পরিস্থিতি ভয়াবহ হবে।
সিলেটে গত ২৭ মে আগাম বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। দুই সপ্তাহব্যাপী স্থায়ী এ বন্যায় পানিবন্দি হয় ১০ লাখের বেশি মানুষ। প্রথম বন্যার পানি পুরোপুরি নামার আগেই ১৫ জুন থেকে ফের বন্যা হয় সিলেটে। বিশেষ করে ঈদুল আজহার দিন ভোররাত থেকে মাত্র কয়েক ঘণ্টার অতিভারী বর্ষণে মহানগরসহ সিলেটের সব উপজেলায় লাখ লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়ে। পরবর্তী এক সপ্তাহ সিলেটে বন্যা পরিস্থিতি ছিল ভয়াবহ। এরপর পানি নামতে শুরু করে। তবে সে গতি ছিল খুব ধীর। ফলে হাওরাঞ্চল ও নদীপারের ৭ লক্ষাধিক মানুষ এখনও বন্যাক্রান্ত রয়েছে।
দ্বিতীয় দফা বন্যা শেষ হওয়ার আগেই সোমবার (১ জুলাই) থেকে সিলেটে ধাক্কা দেয় তৃতীয় দফা বন্যা। রবিবার দিনভর সিলেটে থেমে ও উজানে ভারী বৃষ্টির ফলে নতুন করে বন্যা দেখা দিয়েছে। জেলার জৈন্তাপুর, কানাইঘাট ও গোয়াইনঘাট উপজেলার যেসব এলাকায় বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছিল সেসব এলাকা ফের প্লাবিত হয়েছে।
সিলেটের আবহাওয়া অফিসের সহকারী আবহাওয়াবিদ শাহ সজীব হোসাইন জানান, সোমবার সকাল ৬টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত ১৫৬.৮ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে। এর মধ্যে শুধু বেলা ৩টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত ৭৯ মি.মি. বৃষ্টি রেকর্ড হয়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড সিলেটের নির্বাহী প্রকৌশলী দীপক রঞ্জন দাস বলেন, ‘এভাবে আগামী চার দিন ভারী বৃষ্টিপাত অব্যাহত থাকলে বন্যা পরিস্থিতি সিলেটে আবারও ভয়াবহ হবে।’
পাউবো সূত্র জানায়, সোমবার সন্ধ্যা ৬টায় সিলেটে তিনটি নদীর পানি ৪ পয়েন্টে বিপদসীমার ওপরে ছিল। এর মধ্যে সুরমা নদীর পানি কানাইঘাট পয়েন্টে ১০২ সেমি, কুশিয়ারার পানি আমলশীদ পয়েন্টে ২৮ সেমি, এ নদীর ফেঞ্চুগঞ্জ পয়েন্টের পানি ৮৮ সেমি ও সারী নদীর পানি সারিঘাট পয়েন্টে ৩৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
সিলেটের জেলা প্রশাসক শেখ রাসেল হাসান বলেন, ‘টানা বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে কিছু এলাকায় নতুন করে প্লাবিত হচ্ছে। গত বন্যায় আক্রান্তদের মাঝে এখনও প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনায় শুকনো ও রান্না করা খাবার বিতরণ চলমান রয়েছে। জেলা প্রশাসন বন্যার বিষয়ে সতর্ক দৃষ্টি রাখছে।’
সুনামগঞ্জ : প্রথম দফার বন্যার রেশ কাটতে না কাটতেই ফের বন্যার মুখোমুখি হচ্ছে সুনামগঞ্জের নিম্নাঞ্চলের বাসিন্দারা। সোমবার দুপুর ১২টার তথ্যমতে, যাদুকাটা নদীর শক্তিয়ারখলা পয়েন্টে বিপদসীমার ৭০, সুরমা নদীর ছাতক পয়েন্টে ৩৬ ও সুনামগঞ্জ পয়েন্টে ১২ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। আগামী তিন দিন ভারী বৃষ্টি হতে পারে। এর পরের পাঁচ দিনও এই অঞ্চলে বৃষ্টিপাতের প্রবণতা অব্যাহত থাকতে পারে বলে জানিয়েছেন আবহাওয়াবিদরা।
বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র জানিয়েছে, আগামী ৪৮ ঘণ্টায় দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে ভারী থেকে অতিভারী বৃষ্টি হতে পারে। উজানে অর্থাৎ মেঘালয় চেরাপুঞ্জিতেও বৃষ্টি আছে। তাতে সুনামগঞ্জে নদীর পানি বৃদ্ধি পাবে। একই সঙ্গে নিম্নাঞ্চলে বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে।
সুনামগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মামুন হাওলাদার নিম্নাঞ্চলের বাসিন্দাদের সতর্ক থাকার আহ্বান জানিয়ে বলেন, ‘আবহাওয়ার পূর্বাভাস অনুযায়ী বৃষ্টি হলে নিম্নাঞ্চলে স্বল্পমেয়াদি বন্যা হতে পারে।’
রংপুর : উজানের পাহাড়ি ঢলে রংপুরে তিস্তা নদীর পানি বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এতে করে জেলার গঙ্গাচড়া, কাউনিয়া ও পীরগাছা উপজেলার নদীর তীরবর্তী নিম্নাঞ্চল, চর ও দ্বীপ চরের কিছু এলাকা প্লাবিত হয়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা যায়, সোমবার সকাল থেকে তিস্তা নদীর পানি বাড়তে থাকে। সকাল ৬টায় তিস্তা নদীর কাউনিয়া পয়েন্টে পানি বিপদসীমার ২ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হলেও বেলা ৩টায় পানি কিছুটা বেড়ে বিপদসীমার ৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। এদিকে তিস্তা নদীর পানি বাড়া-কমায় নদীর তীরবর্তী বিভিন্ন এলাকায় বন্যা ও ভাঙন দেখা দিয়েছে। এ নিয়ে রংপুর-১ আসনের সংসদ সদস্য আসাদুজ্জামান বাবলু পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ে ডিও লেটার দিলে সোমবার সকালে ভাঙন ও বন্যাকবলিত এলাকা পরিদর্শন করেন পানি উন্নয়ন বোর্ডের উত্তরাঞ্চলের প্রধান প্রকৌশলী মাহবুব রহমান। তিনি গঙ্গাচড়া উপজেলার কোলকোন্দ ইউনিয়নের বিনবিনার চর, মটুকপুর, চিলাখাল, নোহালী ইউনিয়নের চর নোহালী, মিনা বাজারসহ বিভিন্ন এলাকা পরিদর্শন করেন। এ সময় উপস্থিত ছিলেন পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী রবিউল ইসলাম ও স্থানীয় এমপি প্রতিনিধি আব্দুল মতিন অভি।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের উত্তরাঞ্চলের প্রধান প্রকৌশলী মাহবুব রহমান বলেন, ‘আমরা গঙ্গাচড়া উপজেলায় তিস্তা নদীর ভাঙন ও বন্যাকবলিত এলাকা পরিদর্শন করেছি। যেসব স্থানে ভাঙন দেখা দিয়েছে সেখানে দ্রুততার সঙ্গে কাজ করা হচ্ছে। ১৫ দিন ধরে উজানের পাহাড়ি ঢলে নদীর পানি বাড়া-কমায় গঙ্গাচড়ায় নদীর তীরবর্তী এলাকার মসজিদ, মাদ্রাসা, স্কুল ও ঘরবাড়ি ভাঙনের হুমকিতে পড়েছে।’
কুড়িগ্রাম : কয়েক দিনের টানা বৃষ্টিতে কুড়িগ্রামে তিস্তা, ব্রহ্মপুত্র, ধরলা, দুধকুমারসহ বিভিন্ন নদীর পানি দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। সোমবার (বিকাল) থেকে তিস্তা নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়ে কাউনিয়া পয়েন্টে বিপদসীমার সাত সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
আগামী ৭২ ঘণ্টার মধ্যে সব নদ-নদীর পানি বিপদসীমা অতিক্রম করতে পারে। এতে জেলায় স্বল্পমেয়াদি বন্যার আশঙ্কা করা হচ্ছে।
জেলার রাজারহাট কৃষি আবহাওয়া অফিসের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সুবল চন্দ্র সরকার জানান, গত ২৪ ঘণ্টায় জেলায় ৮২ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। আগামী ২৪ ঘণ্টায় হালকা ও মাঝারি বৃষ্টিপাত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
কুড়িগ্রাম পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী রাকিবুল হাসান বলেন, ‘উজানে বৃষ্টি হওয়ায় কুড়িগ্রামের তিস্তা, ব্রহ্মপুত্র, ধরলাসহ নদ-নদীগুলোর পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে। ইতোমধ্যে তিস্তার পানি বিপদসীমার পাঁচ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।’
নেত্রকোণা : টানা বৃষ্টি ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে ফের নেত্রকোণার উব্ধাখালী নদীর পানি কলমাকান্দা পয়েন্টে বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। তবে জেলার সোমেশ্বরী, কংস, ধনু ও অন্যান্য নদ-নদীর পানি বাড়লেও বিপদসীমার নিচে রয়েছে। এমন অবস্থা আরও কয়েক দিন অব্যাহত থাকলে বন্যার আশঙ্কা করছে জেলার বাসিন্দারা।
সোমবার বিকালে নেত্রকোণা পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) নির্বাহী প্রকৌশলী মো. সারোয়ার জাহান এ তথ্য নিশ্চিত করেন। তিনি বলেন, ‘সোমবার বিকাল পর্যন্ত উব্ধাখালী নদীর পানি কলমাকান্দা পয়েন্টে বেড়েছে। বর্তমানে উব্ধাখালীর পানি বিপদসীমার ২৮ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এর আগে রবিবার সকাল ৯টায় উব্ধাখালীর পানি কলমাকান্দা পয়েন্টে বিপদসীমার ২ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে বইছিল। কিন্তু ভারী বৃষ্টি হওয়ায় এবং উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে উব্ধাখালী নদীর পানি দ্রুত বাড়ছে। তবে জেলার সোমেশ্বরী, কংস, ধনুসহ অন্যান্য নদ-নদীর পানি বাড়লেও তা বিপদসীমার নিচে রয়েছে।’
লালমনিরহাট : লালমনিরহাটে টানা কয়েক দিনের বৃষ্টি আর উজান থেকে নেমে আসা ঢলে তিস্তা নদীর তীরবর্তী নিম্নাঞ্চলে সৃষ্ট স্বল্পমেয়াদি বন্যা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়েছে। তবে রবিবার তিস্তা নদীর পানি বৃদ্ধি পেলেও সোমবার সকাল থেকে জেলার পাঁচটি উপজেলার নদীর তীরবর্তী নিম্নাঞ্চল ও চরাঞ্চলে পানি কমতে শুরু করেছে। জেলায় রবিবার রাত থেকে থেমে থেমে বৃষ্টি হচ্ছে। আগামী দুই থেকে তিন দিন ভারী বর্ষণের পূর্বাভাস দিয়েছে বন্যা সতর্কীকরণ কেন্দ্র।
সোমবার বেলা ৩টায় লালমনিরহাটের হাতিবান্ধায় অবস্থিত তিস্তার ডালিয়া ব্যারাজ পয়েন্টে পানিপ্রবাহ রেকর্ড করা হয়েছে ৫২.১৫ মিটার, যা বিপদসীমার ৪৫ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এর আগে রবিবার তিস্তার পানি বিপদসীমার মাত্র ১০ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হয়েছিল। কাউনিয়া পয়েন্টে ২৮.৭৫ মিটার, যা বিপদসীমার ৫ সেন্টিমিটার ওপরে প্রবাহিত হয়েছিল।
বন্যার পানি কমে গেলেও প্লাবিত এলাকায় ভাঙনের কারণে বেড়েছে ভোগান্তি। ভেঙে গেছে গ্রামীণ কাঁচা সড়ক, ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ফসলের ক্ষেত। এ ছাড়া বন্যার পানি দ্রুত নেমে যাওয়ায় জেলার আদিতমারী উপজেলার মহিষখোঁচা ইউনিয়নের গরিবুল্লাহপাড়া, চণ্ডিমারী এবং সদর উপজেলার কালমাটি, রাজপুরে কয়েকটি পয়েন্টে দেখা দিয়েছে নদীভাঙন। এতে অন্তত তিন হাজার বসতভিটা, একাধিক মসজিদ ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ভাঙনের হুমকিতে রয়েছে।
ডালিয়া পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আসাফউদ্দৌলা বলেন, ‘সোমবার সকাল থেকে তিস্তার পানি কমতে শুরু করছে। পানি নিয়ন্ত্রণে তিস্তা ব্যারাজের সব জলকপাট খুলে দেওয়া হয়েছে। তবে আবারও বন্যার আশঙ্কা রয়েছে।’
(প্রতিবেদন তৈরিতে সহযোগিতা করেছে সিলেট অফিস, রংপুর অফিস, সুনামগঞ্জ, কুড়িগ্রাম, নেত্রকোণা ও লালমনিরহাট প্রতিবেদক)