শফিকুল ভূঁইয়া, সরিষাবাড়ী (জামালপুর)
প্রকাশ : ০১ জুলাই ২০২৪ ২১:১২ পিএম
আপডেট : ০১ জুলাই ২০২৪ ২১:৪০ পিএম
জামালপুরের সরিষাবাড়ীতে যমুনা ও শাখা নদীগুলোর দেড় শতাধিক পয়েন্ট থেকে ড্রেজার দিয়ে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করছে প্রভাবশালী সিন্ডিকেট। ড্রেজার দিয়ে বালু উত্তোলনের কারণে নদ-নদী যেমন প্রাকৃতিক গতি হারাচ্ছে তেমনি হুমকির মুখে পড়েছে শতকোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত বিভিন্ন সেতু ও নদীর তীর সংরক্ষণ বাঁধসহ নদীর তীরবর্তী মানুষের বসতবাড়ি। সব দেখেও রহস্যজনক কারণে নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করছে প্রশাসন।
স্থানীয়দের অভিযোগ, বর্ষা মৌসুমে এমনিতেই নদীভাঙন শুরু হয়। নদীভাঙনের ফলে প্রতিবছর যমুনার তীরের মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অবৈধ ড্রেজার মেশিন লাগিয়ে বালু উত্তোলন করায় নদীর গতিপথ পরিবর্তন হচ্ছে এবং নদীভাঙনের মাত্রা বেড়ে যাচ্ছে। এতে করে নদীর তীরবর্তী মানুষের ঘরবাড়ি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। অনেক সময় বালু দস্যুরা ব্রিজ ও সরকারি স্থাপত্য প্রাথমিক বিদ্যালয়, স্কুল, কলেজের আশপাশে ড্রেজার বসায়। এতে করে হুমকির মুখে পড়ে সরকারি স্থাপনা। এ ছাড়াও অবৈধ ড্রেজার মেশিনের মাধ্যমে বালু উত্তোলনে বন্যায় হুমকির মুখে পড়তে পারে শতকোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত সেতু, তীর সংরক্ষণ বাঁধ। বালু বহনকারী ট্রাফে ট্রাক্টর অতিরিক্ত মাত্রায় বালু বোঝাই করে চলাচল করায় গ্রামীণ রাস্তাঘাটের ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে। শনিবার উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় সরেজমিনে ঘুরে স্থানীয়দের অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেছে।
সরেজমিনে দেখা যায়, উপজেলার পিংনা ইউনিয়নের যমুনা নদী থেকে শুরু করে তারাকান্দি সারখানা এলাকা, পৌগলদিঘার বয়ড়া বাজার এলাকা, শাখা ঝিনাই নদীর ভাটারা, পৌরসভার মাইজবাড়ী, চরবালিয়াসহ যমুনা ও শাখা নদীর দেড় শতাধিক পয়েন্টে ড্রেজার মেশিন বসানো হয়েছে। ব্রিজ ও স্কুলের আশপাশেও ড্রেজার বসানো হয়েছে।
স্থানীয় কৃষক তারা মিয়া। উপজেলার পৌর এলাকার মাইজবাড়ীতে ঝিনাই নদীর পাড়ে তার বাড়ি। তিনি বলেন, ‘দুই-তিন মাস ধরে বেশ কয়েকটি ড্রেজার মেশিন লাগিয়ে বালু তোলা হচ্ছে। এতে করে নদীর পাড় বিভিন্ন জায়গায় ভেঙে পড়ছে। আমরা ভয়ে ভয়ে আছি কখন যেন নদীর পাড় ভেঙে আমাদের বাড়িতে পানি চলে আসে।’ এক প্রশ্নের জবাবে তিনি আরও বলেন, ‘আমরা বাধা দেওয়ার চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু তারা মানে না, মারতে আসে, মেরে ফেলার হুমকি দেয়।’
পাশের বালিয়া গ্রামের রফিকুল ইসলাম ছোট একজন মুদি দোকানি। দোকানের জন্য কেনাকাটা করতে বালিয়া ব্রিজ দিয়ে আরামনগর বাজারে যাচ্ছিলেন। এ সময় কথা হয় তার সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘দেখতেই তো পারছেন বালিয়া ব্রিজের আধা কিলোমিটারের মধ্যে থেকে ড্রেজার মেশিন দিয়ে বালু উত্তোলন করা হচ্ছে। এতে করে ব্রিজটি ভেঙে পড়বে। আমি শুনেছি এর আগে কামরাবাদের শুয়াকৈর গ্রামের ঝিনাই নদীর ওপরের ব্রিজটি ভেঙে গিয়েছিল বালু তোলার জন্য। সেই রকম এই ব্রিজটিও ভেঙে পড়বে হয়তো।’
এলজিইডি উপজেলা প্রকৌশলী জাহিদুল ইসলাম বলেন, ‘কোনো ব্রিজের ১ কিলোমিটারের মধ্যে যদি কোনো ড্রেজার বসানো হয় তাহলে ওই ব্রিজটি ঝুঁকিতে পড়বে। অতিরিক্ত মাত্রায় বোঝাই করে যদি ট্রাফে ট্রাক্টর দিয়ে বালু বহন করা হয়, তাহলেও গ্রামীণ রাস্তাগুলোর ব্যাপক ক্ষতি হবে। আমি ইউএনও মহোদয়ের সঙ্গে বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা করব এবং তাকে এ ব্যাপারে পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য অনুরোধ করব।’
এ ব্যাপারে উপজেলা নির্বাহী অফিসার শারমিন আক্তার বলেন, ‘সরিষাবাড়ী যেহেতু যমুনা নদীর তীরে তাই এখানে অবৈধ ড্রেজারের প্রকোপটা একটু বেশি। যখনি যে অভিযোগ আসে আমরা ব্যবস্থা নিই। যেমন আমার এখন যদিও এসিল্যান্ড নেই কিন্তু গত মাস পর্যন্ত ছিল। আমি তাকে পাঠিয়েছি এবং আমি নিজেও গেছি। আমাদের কাছে যখন অভিযোগ আসে তখনোই আমরা যাই। তবে দুঃখের বিষয় হচ্ছে, যে ড্রেজার আমরা ভেঙে দিয়ে আসি বা ধ্বংস করে দিয়ে আসি, আবার দেখা যায় কিছু দিনের মাথায় অসৎ চক্রকারীরা আবার শুরু করে।‘
তিনি আরও বলেন, ‘গতকাল আমার কাছে একজন অভিযোগ করেন ভাটারাতে অবৈধভাবে ড্রেজার মেশিন চলছে। আমি সঙ্গে সঙ্গে আমার গ্রামপুলিশ পাঠিয়েছি। তিনি গিয়ে আমাকে রিপোর্ট পাঠিয়েছেন।’
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি আরও বলেন, ‘আমরা যখন যাই তখন আমরা ওই ড্রেজার যে চালাচ্ছেন ওই রকম কোনো লোক ধরতে পারি না। কারণ তারা মোবাইল কোর্ট করার আগে চলে যায়। তাদের ধরতে পারলে আর্থিক যে জরিমানা মোবাইল কোর্টে করার সুযোগ আছে, তা করতে পারি। গতকাল একটি অভিযোগ এসেছে। আজকেও একটি অভিযোগ এসেছে । আপনারাও ঘুরে আসেন, এটা আমাদের জন্য পজিটিভ দিক। আমরা যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করব।’
নদীর তীর সংরক্ষণ বাঁধ ও নদীর পাড় ভাঙার বিষয়ে জামালপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী রফিকুল ইসলাম সরেজমিনে পরিদর্শন করে স্থানীয় প্রশাসনের সমন্বয়ে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন বলে জানান।