সাইফুল হক মোল্লা দুলু, মধ্যাঞ্চল
প্রকাশ : ২০ জুন ২০২৪ ১০:২৭ এএম
আপডেট : ২০ জুন ২০২৪ ১৪:০৪ পিএম
সুমন মোল্লা এবং তৌফিকুল সাগর। ফাইল ফটো
কিশোরগঞ্জসহ আশপাশের এলাকার বাজারগুলো সয়লাব হয়ে আছে চোরাচালানের চিনিতে। বেশ কিছুদিন ধরে নতুন এই রুট দিয়ে ভারত থেকে চোরাচালানের মাধ্যমে চিনি এলেও সে কথা জানত না বলেই দাবি করছে স্থানীয় প্রশাসন। গত ৯ জুন জেলা আইনশৃঙ্খলা কমিটির সভায় তাড়াইল উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা মো. আল মামুন বলেন, ভারতীয় সীমান্ত হয়ে প্রথমে নেত্রকোণার কলমাকান্দা, পরে কেন্দুয়া হয়ে তাড়াইলে চোরাই চিনি আসছে ট্রাকে করে। তাড়াইলে চোরাই পথে আসা বেশ কয়েকটি চিনির ট্রাক ধরা পড়েছে এ মাসের প্রথম সপ্তাহে।
এই বক্তব্যের পর পুলিশ সুপার মোহাম্মদ রাসেল শেখ বলেন, ঘটনাটি ভয়াবহ। কারণ একবার একটি চোরাই রুট চালু হলে তা বন্ধ করা খুবই কঠিন। তিনি ময়মনসিংহ ও নেত্রকোণার পুলিশ সুপারদের সঙ্গে আলোচনা করে এ ব্যাপারে কঠোর ব্যবস্থা নেবেন বলে সভায় জানান। কার্যত ওই সভার পরপরই জেলাবাসীর নজরে আসে চোরাই চিনির বিষয়টি।
অনুসন্ধানকালে দেখা যায়, চোরাচালানের মাধ্যমে ভারত থেকে আসা চিনিতে সয়লাব হয়ে আছে কিশোরগঞ্জের সব পাইকারি বাজার। অভিযোগ উঠেছে, কিশোরগঞ্জ-২ (কটিয়াদী-পাকুন্দিয়া) আসনের স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য অ্যাডভোকেট মো. সোহরাব উদ্দিনের ছেলে কেন্দ্রীয় যুবলীগের সদস্য এসএম তৌফিকুল হাসান সাগরের নেতৃত্বে একটি সিন্ডিকেট এই চোরাচালান নিয়ন্ত্রণ করছে। সিন্ডিকেটে আরও রয়েছেন তার ঘনিষ্ঠ জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি মো. আনোয়ার হোসেন মোল্লা সুমন। মূলত সুমনই চোরাচালানের মাধ্যমে আসা ভারতীয় চিনির ট্রাক ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের মাধ্যমে পাহারা দিয়ে নিরাপদে বিভিন্ন স্থানে পৌঁছে দেন। এজন্য তাকে ট্রাকপ্রতি ১০ হাজার টাকা দিতে হয়। আর এ টাকা তিনি নিজের ব্যাংক হিসাব ও বিকাশের মাধ্যমে গ্রহণ করেন। তার এই টাকা নেওয়ার প্রমাণ হিসেবে হোয়াটসঅ্যাপ ও মেসেঞ্জারের স্ক্রিনশট গত শনিবার রাত থেকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। এ নিয়ে তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছে।
নির্ভরযোগ্য একটি সূত্র জানিয়েছে, পাকুন্দিয়া উপজেলা পরিষদের নবনির্বাচিত চেয়ারম্যান এমদাদুল হক জুটনের হাত ধরে এমপিপুত্র সাগর ও জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি সুমন এই চিনি চোরাচালান চক্রের সঙ্গে যুক্ত হন। এরপর থেকে তাদের নিয়ন্ত্রণ এবং নেতৃত্বে চিনি চোরাচালানের শক্তিশালী সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে এ জেলায়। এই সিন্ডিকেটে জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি শফিকুল গণি ঢালী লিমনের যুক্ত থাকার কথাও নানা সূত্রে জানা গেছে।
সম্প্রতি একটি ভারতীয় চিনিবোঝাই ট্রাক পুলিশের হাতে জব্দ হওয়ার পর চোরাচালান সিন্ডিকেটের বিষয়টি প্রকাশ্যে আসে। গত ১৪ জুন কিশোরগঞ্জ সদর উপজেলার নগুয়া বগাদিয়া তালতলা এলাকায় ভারতীয় চিনিভর্তি একটি ট্রাক জব্দ করে পুলিশ। এ সময় ট্রাকের চালক রাতুল ও তার সহকারী রাজিবকে আটক করা হয়।
এ ঘটনায় কিশোরগঞ্জ সদর মডেল থানায় এসআই মো. মারুফ কামাল বাদী হয়ে আটক হওয়া দুজন এবং শহরের নিউটাউন এলাকার জনি (৩৫) নামে এক যুবক ও জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সহসভাপতি আল জুবায়েদ খান নিয়াজ চারজনের নাম উল্লেখ এবং অজ্ঞাত ৫-৬ জনকে আসামি করে মামলা করেন। এতে ক্ষিপ্ত হন নিয়াজের লোকজন। ফেসবুকে তারা চিনি চোরাচালানের সঙ্গে জেলা ছাত্রলীগ সভাপতি মো. আনোয়ার হোসেন মোল্লা সুমন জড়িত দাবি করে পোস্ট দেওয়া শুরু করে। তাদের দাবি, সুমন চিনির চোরাকারবারিতে জড়িত থাকলেও তাকে বাদ দিয়ে তারই প্ররোচনায় নিয়াজকে মামলার আসামি করা হয়েছে। ফেসবুকে একই রকম পোস্ট দিয়েছেন জেলা ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক লুৎফর রহমান নয়ন। তিনি লিখেছেন, ‘কিশোরগঞ্জে ভারতীয় চোরাই চিনির ব্যবসা করে কে, আর মামলা হয় কার নামে! এই ক্ষমতার খেলা আর বেশি দিন দেখাইতে পারবেন না জনাব।’
এদিকে কেবল অভিযোগ করেই পোস্ট দেওয়া নয়, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অভিযোগের পক্ষে তথ্য-প্রমাণও উপস্থাপন করা হচ্ছে। চিনি চোরাকারবারিদের সঙ্গে হোয়াটসঅ্যাপে সুমনের কথোপকথন এবং ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ও বিকাশ অ্যাকাউন্টে টাকা লেনদেনের স্ক্রিনশট এখন ঘুরছে ফেসবুকের ওয়ালে ওয়ালে।
সরেজমিন বিভিন্ন বাজার ঘুরে দেখা গেছে, জেলা শহর থেকে উপজেলা, এমনকি ইউনিয়ন পর্যায়ের বাজার ও গ্রামের সাধারণ দোকানেও শুল্ক ফাঁকি দিয়ে চোরাই পথে আসা ভারতীয় চিনি ছাড়া অন্য কোনো চিনি মিলছে না। জেলা শহরের প্রধান পাইকারি বাজার বড়বাজারেই দিনে এক থেকে দেড় কোটি টাকার চোরাই চিনি কেনাবেচা হয় বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। জেলা শহরের বিভিন্ন বাজার, করিমগঞ্জ উপজেলার নিয়ামতপুর, মরিচখালী ও পাকুন্দিয়া উপজেলার বেশ কয়েকটি বাজার ঘুরে দেখা গেছে, এসব এলাকায় দেশীয় পরিশোধিত চিনি ক্রেতারা খুঁজেই পাচ্ছেন না। সবাইকে বাধ্য হয়ে ভারতীয় চিনি কিনতে হচ্ছে।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, চারটি উপজেলার ছয়-সাতটি রুট দিয়ে চোরাই পণ্য ঢুকছে কিশোরগঞ্জ জেলা শহরে। সবচেয়ে বেশি চিনি আসে করিমগঞ্জ উপজেলার চামড়া বন্দর দিয়ে। এছাড়া বর্তমানে সবচেয়ে নিরাপদ রুট হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে নেত্রকোণার কেন্দুয়া হয়ে তাড়াইল ও করিমগঞ্জ রুট।
অভিযোগ রয়েছে, বিভিন্ন পথে চোরাই চিনি ট্রাকে করে প্রথমে জেলা শহরে প্রবেশ করাচ্ছেন ছাত্রলীগের বর্তমান ও সাবেক কয়েক নেতা। এরপর এসব চিনির বস্তা পাল্টে ফেলে দেশীয় নানা ব্র্যান্ডের স্টিকারযুক্ত বস্তায় ভরে পাঠানো হচ্ছে বিভিন্ন উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে। এমনকি বিভিন্ন জেলা ও রাজধানী ঢাকায়ও এখান থেকে চিনি পাঠানোর কথা জানা গেছে।
এ বিষয়ে জেলা ছাত্রলীগের সাবেক গণশিক্ষা বিষয়ক সম্পাদক শাওন নিলয় ফেসবুকে এক পোস্টে লেখেন, ‘কিশোরগঞ্জ জেলা ছাত্রলীগের বর্তমান সভাপতি আনোয়ার হোসেন মোল্লা সুমন। ...ইদানীং ভারতীয় চিনি চোরাচালানের রমরমা বাণিজ্য করে আসছে। ...ছাত্রলীগের ভাবমূর্তি চরম সংকটে।’
স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কিছু সদস্যও এই চোরাচালান চক্রের সঙ্গে যুক্ত। তাদের সহযোগিতা ছাড়া চোরাচালানের চিনি কয়েকটি উপজেলা পার হয়ে জেলা শহরের বড়বাজার পর্যন্ত পৌঁছানো সম্ভব নয়।
ব্যবসায়ীসহ সংশ্লিষ্টদের ভাষ্য, আগে পুলিশ সদস্যদের ‘ম্যানেজ’ করে সড়কপথে ভৈরব ও নান্দাইল দিয়ে এবং নৌপথে চামড়া বন্দর দিয়ে ভারতীয় চিনি জেলা শহরে আনা হতো। তখন অল্প পরিমাণ চিনি আসত। ছয় মাস ধরে ছাত্রলীগের কয়েকটি পক্ষ এ প্রক্রিয়ায় যুক্ত হয়। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সীমান্ত দিয়ে চিনির ট্রাক ভৈরব-কিশোরগঞ্জ সড়ক দিয়ে তারা মোটরসাইকেলের পাহারায় কিশোরগঞ্জ জেলা শহরের বড় বাজারে নিয়ে আসে। একইভাবে নেত্রকোণা থেকে নান্দাইল দিয়ে আসা চোরাই চিনির ট্রাকগুলোর কিছু পাকুন্দিয়া, হোসেনপুর ও কিছু গাইটাল এলাকা হয়ে ছাত্রলীগের কিছু কর্মীর পাহারায় বড় বাজারে আসে।
এছাড়া সুনামগঞ্জ থেকে ভারতীয় চিনির ট্রাকগুলো নেত্রকোণার কেন্দুয়া থানা হয়ে কিশোরগঞ্জের তাড়াইল ও করিমগঞ্জ উপজেলা দিয়ে জেলা শহরের একরামপুরে ঢোকে। আর এই কাজে নেতৃত্ব দেন ছাত্রলীগ নেতা সুমন। সূত্র জানায়, সুনামগঞ্জ থেকে ভারতীয় চিনির ট্রাকগুলো কেন্দুয়া হয়ে তাড়াইলে আসে। সেখান থেকে তাড়াইল উপজেলা ছাত্রলীগের সভাপতি ঈসমাইল সিরাজী পাহারা দিয়ে করিমগঞ্জ উপজেলার মেইন রোড পর্যন্ত দিয়ে যান। আবার সেখান থেকে ট্রাকগুলোকে মাঝখানে রেখে সামনে এবং পেছনে দুই-তিনটি মোটরসাইকেল ও একটি প্রাইভেটকারে করে জেলা শহরের একরামপুর পর্যন্ত নিয়ে আসেন মোল্লা সুমন। একরামপুর থেকে সুমন এবং তার ভাগ্নে নাজমুল হীরা ও পাভেলসহ অন্য সহযোগীরা মোটরসাইকেলে পাহারা দিয়ে চৌদ্দশত ইউনিয়নের সামনে পর্যন্ত এগিয়ে দেন। এরপর পুলেরঘাট পৌঁছলে এমপিপুত্র সাগরের নির্দেশে ট্রাকগুলো সড়কপথে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে চলে যায়।
এছাড়া সাগরের ঘনিষ্ঠ হোসেন্দী ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক রুহুল আমিন হিমেল পাকুন্দিয়ায় চিনি চোরাচালানের বিষয়টি দেখভাল করেন। এ নিয়ে কিছুদিন আগে মারামারির ঘটনাও ঘটেছে। সাগর কেন্দ্রীয় যুবলীগের সদস্য ও এমপিপুত্র হওয়ায় স্থানীয়ভাবে প্রভাব খাটিয়ে ও ক্ষমতার অপব্যবহার করে এসব কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছেন।
বড়বাজারে কয়েকজন ব্যবসায়ীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রতিদিন ২০ থেকে ২৫টি ভারতীয় চিনির ট্রাক আসে। এর বাইরে শহরের কাচারিবাজার, পাকুন্দিয়া বাজারেও প্রতিদিন কমপক্ষে ১০ ট্রাক চোরাই চিনি আনা হয়।
জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি মো. আনোয়ার হোসেন মোল্লা সুমন এ বিষয়ে বলেন, রাজনৈতিক প্রতিহিংসা থেকে তার বিরুদ্ধে এসব অপপ্রচার চালানো হচ্ছে। ব্যাংক কিংবা বিকাশে তিনি কোনো চিনি ব্যবসায়ী কিংবা চোরাকারবারির কাছ থেকে টাকা নেননি। কেননা তিনি চিনি চোরাকারবারি কোনো সিন্ডিকেটের সঙ্গে যুক্ত নন।
এ বিষয়ে কিশোরগঞ্জ-২ আসনের স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য অ্যাডভোকেট মো. সোহরাব উদ্দিনের ছেলে কেন্দ্রীয় যুবলীগের সদস্য এসএম তৌফিকুল হাসান সাগর বলেন, চিনি চোরাকারবারির মতো ঘৃণ্য একটি কাজে আমি কেন যুক্ত হতে যাব? এগুলো আমার বিরুদ্ধে অপপ্রচার। যারা এমন অপপ্রচার চালাচ্ছে, তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেব।
অভিযোগের ব্যাপারে জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি শফিকুল গণি ঢালী লিমন বলেন, ‘এই শহরে কিছু ঘটলে আমার নাম ওঠে। আমি রাজনীতি করি বলেই আমার শত্রু আছে, শত্রুরা এসব বলে। অনেকেই চোরাচালানি করে, এখন তাদের কেউ যদি বিপদে পইড়া আমার কাছে আসে, আমি যদি দেন-দরবার কইরা দিই, ছোট্ট একটা শহর, সবাই পরিচিত, এর জন্য কি সম্পূর্ণ দোষ আমার?’
পাকুন্দিয়া উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান এমদাদুল হক জুটন বলেন, আমি চিনির ব্যবসা করি না, করার দরকারও নেই। অভিযোগ করলেই তো হবে না, তথ্য-প্রমাণ থাকতে হবে। চিনির ব্যবসা যারা করতেছে, তারা গ্রেপ্তার হইতেছে। তাদের জিজ্ঞেস করেন, কারা জড়িত?
কিশোরগঞ্জ সদর মডেল থানার ওসি মোহাম্মদ গোলাম মোস্তফা বলেন, চিনি চোরাচালানে যাদের সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে, তাদেরকেই মামলায় আসামি করা হয়েছে। এছাড়া মামলার তদন্তে যদি আরও নাম পাওয়া যায়, তাদেরও আসামি করা হবে। এখানে পুলিশ কারও দ্বারা কোনোভাবে প্রভাবিত হয়নি, আইন অনুযায়ী আমরা কাজ করছি।
কিশোরগঞ্জের পুলিশ সুপার মোহাম্মদ রাসেল শেখ বলেন, চিনি চোরাচালান নিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কঠোর অবস্থানে রয়েছে বলেই অভিযানে চিনি জব্দ হচ্ছে। চোরাচালানের সঙ্গে যাদের সম্পৃক্ততা পাওয়া যাবে, তাদেরকে আইনের আওতায় আনা হবে।