× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

বগুড়ায় ঈদের দিন জোড়া খুন, নেপথ্যে ‘প্রেস্টিজ’ ইস্যু!

মোহন আখন্দ ও অরূপ রতন, বগুড়া অফিস

প্রকাশ : ২০ জুন ২০২৪ ০৯:৩৭ এএম

আপডেট : ২০ জুন ২০২৪ ১০:৫৪ এএম

বগুড়ায় জোড়া খুনের প্রধান আসামি বগুড়া জেলা মোটর শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ কবির আহম্মেদ মিঠু। ফাইল ফটো

বগুড়ায় জোড়া খুনের প্রধান আসামি বগুড়া জেলা মোটর শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ কবির আহম্মেদ মিঠু। ফাইল ফটো

ঈদের পরদিন মঙ্গলবার (১৮ জুন) সকালে ও বুধবার (১৯ জুন) কয়েক দফা বৃষ্টিতেও মুছে যায়নি রক্তের দাগ। গলিপথে জমাটবাঁধা সেই রক্তের ওপর দিয়েই এলাকার লোকজন হাঁটা-চলা করছেন। মনজিলা খাতুন তার বাড়ির দরজা থেকে ১০ হাত দূরের ওই রক্তের দাগ দেখিয়ে বলছিলেন, ‘এখানে রোমান আর তার কয়েক হাত দূরে শরীফ পড়েছিল।’ গত সোমবার (১৭ জুন) ঈদের দিন রাতে মনজিলার বাড়ির কাছেই রোমান ও শরীফ শেখকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। পরে গুলি ছোড়া হলে হোসেন আলী বুলেট নামে তাদের অপর সহযোগী আহত হন।

বুধবার ওই জোড়া খুনের ঘটনাস্থল নিশিন্দারা চকরপাড়া এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, ৩-৪ ফুট সরু গলিপথের দুই পাশের প্রায় প্রতিটি বাড়ির সামনেই নারী-পুরুষরা কথাবার্তা বলছেন। সেখানে গিয়ে হত্যাকারীদের পরিচয় সম্পর্কে জানতে চাইলে মনজিলা খাতুন সতর্কতার সঙ্গে জবাব দিতে গিয়ে বলেন, আমি ঘুমিয়ে ছিলাম। ভোরে ঘুম ভাঙার পর আমি খুনের কথা জানতে পারি।’ নিশ্চয়ই চিৎকার চেঁচামেচি হয়েছিল? আপনি শুনতে পাননি? জবাবে মনজিলা খাতুন বলেন, ‘ঘুমিয়ে থাকার কারণে কিছুই শুনতে পাইনি।’

রোমান এবং শরীফের জোড়া খুনের ঘটনায় শহরে উৎকণ্ঠা ছড়িয়ে পড়েছে। কারণ চলতি মাসের শুরুটা হয়েছিল জোড়া খুন দিয়ে (মা ও এক বছরের শিশুকে গলা কেটে হত্যা)। আর ঈদের দিন পর্যন্ত ১৭ দিনে একে একে মোট ৮টি হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে। আর গত ১৪ মার্চ থেকে ৩ মাসে ঘটেছে ১৪টি হত্যাকাণ্ড। তবে সর্বশেষ গত ঈদের দিন রাতে জোড়া খুনের সময় গুলিবর্ষণের ঘটনাকে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হিসেবে দেখছেন সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা। হত্যাকাণ্ডের ঘটনা বেড়ে যাওয়ার পেছনে সামাজিক অবক্ষয়কে দায়ী করেছেন তারা। 

রোমান এবং শরীফ শেখ হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগে বগুড়া মোটর শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ কবির আহম্মেদ মিঠু, তার ছোট ভাই জেলা পরিষদ সদস্য আওয়ামী লীগ নেতা সৈয়দ সার্জিল আহম্মেদ টিপু এবং বগুড়া পৌরসভার ১ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর বগুড়া জেলা বিএনপির সাবেক প্রকাশনা বিষয়ক সম্পাদক শাহ্ মেহেদী হাসান হিমুসহ ১৩ জনের নাম উল্লেখসহ ২৮ জনের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। শরীফ শেখের মা হেনা বেগমের দায়ের করা মামলায় সৈয়দ কবির আহম্মেদ মিঠুসহ ৪ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। গ্রেপ্তার অন্য ৩ জন হলেন নিশিন্দারা খাঁ পাড়ার শেখ সৌরভ, পূর্বপাড়ার নাঈম হোসেন ও সুলতানগঞ্জপাড়ার আজবিন রিফাত। তবে ১ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ সার্জিল আহম্মেদ টিপু এবং তার ভায়রা শাহ মেহেদী হাসান হিমুসহ অন্য আসামিরা পলাতক রয়েছেন।

জোড়া খুন যেভাবে

নিশিন্দারা চকরপাড়া গ্রামের শফিকুল ইসলামের ছেলে রোমান এবং দুদু শেখের ছেলে শরীফ যে তুচ্ছ ঘটনায় খুন হয়েছেন এটা নিয়ে নিহত এবং অভিযুক্ত পরিবারের সদস্যদের কোনো ভিন্নমত নেই। শরীফের ভাই লেমন শেখের দাবি, শহরের গোয়ালগাড়ি এলাকায় সৈয়দ সার্জিল আহমেদ টিপুর ব্যবহৃত গাড়ির কারণে ঈদের দিন বিকালে নামাজগড়-বারপুর সড়কে যানজট সৃষ্টি হয়। এ সময় তার ছোট ভাইয়ের বন্ধু রোমান মোটরসাইকেল নিয়ে আটকা পড়ে। রোমান তখন টিপুর গাড়িচালককে দ্রুত গাড়ি চালিয়ে যেতে বলে। এতে চালক ক্ষিপ্ত হলে তার সঙ্গে বাগ্‌বিতণ্ডা হয়। ওই সময় গাড়িতে টিপু না থাকলেও পরে তিনি গোয়ালগাড়িতে এসে গোলাগুলি করতে থাকেন। রাত ১২টার পর আবার দলবলসহ এলাকায় এসে প্রথমে রোমানকে এবং তার মাধ্যমে ফোন করে শরীফ ও হোসেন আলীকে ডেকে নেন। এরপর এলোপাতাড়ি কুপিয়ে রোমান ও শরীফকে হত্যার পর এলোপাতাড়ি গুলি চালিয়ে চলে যায়। এতে আহত হন হোসেন আলী। বর্তমানে তিনি বগুড়া শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। 

ঘটনার সূত্রপাত যেখান থেকে সেই গাড়িতে থাকা টিপুর কন্যা তাজরিয়ান আহমেদ পুনম বলেন, সেদিন বিকালে তিনি বাবার গাড়িতে তার চাচাতো ভাই তৌহিদকে নিয়ে গোয়ালগাড়ি থেকে উপশহরে নিজেদের বাড়িতে ফিরছিলেন। গোয়ালগাড়ি পৌঁছার পর দুটি মোটরসাইকেলে কয়েকজন আরোহী হঠাৎ তাদের গাড়ির সামনে এসে বাউলি খেতে শুরু করে। তাতে চালককে বার বার গাড়ি থামাতে হচ্ছিল। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে চালক মোটরসাইকেল আরোহীদের সতর্ক করেন। তখন ওই যুবকরা মোটরসাইকেল থামিয়ে আমাদের গাড়ির কাছে এসে কাচের জানালায় জোরে জোরে আঘাত করে। এক পর্যায়ে তারা চাকু-ছুরি এনে আমাদের ওপর হামলার হুমকি দেয়। 

তিনি আরও বলেন, ‘তখন চালক আমাদের গাড়ি ঘুরিয়ে নিয়ে আবার গোয়ালগাড়িতে আমার চাচার গ্যারেজের ভেতরে রেখে দেয়। এরপর ওই যুবকরা আবার চাচার বাড়ির সামনে এসে চিৎকার চেঁচামেচি করতে শুরু করে। তখন আমার চাচা তাদেরকে শান্ত করে ফিরিয়ে দেন। এরপর রাতে শোনা যায় দুই যুবককে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে। ওই খবর পেয়ে আমার বাবা ও চাচাসহ অন্যরা ঘটনাস্থলে যান। 

পুনমের দাবি, অন্য কেউ হত্যাকাণ্ডটি ঘটিয়ে তার বাবা ও চাচাকে জড়ানোর চেষ্টা করছে।’ 

এদিকে ঘটনার বিষয়ে উপশহর পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ ইন্সপেক্টর জালাল উদ্দিন বলেন, ‘বাদী তার এজাহারে যা লিখেছেন সেটাকেই ঘটনার বর্ণনা হিসেবে ধরে নিতে হবে। সেটা ধরেই তদন্ত হবে।’

এদিকে রোমান ও শরীফের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পরেও তাদের এলাকা নিশিন্দারা চকরপাড়ায় এলাকায় দেখা গেছে জীবনযাত্রা একেবারে স্বাভাবিক। কারণ খুঁজতে গিয়ে জানা গেছে, রোমান রিকশা-ভ্যানে কাপড় এবং শরীফ চালের ব্যবসা করলেও এলাকায় তারা বখাটে হিসেবে পরিচিত। আকতারুজ্জামান নামে উপশহর এলাকার এক বাসিন্দা জানান, চকরপাড়ায় শরীফের ফুফাতো ভাই আব্দুর রহিমের নেতৃত্বে একটি বাহিনী আছে। সেই দলে শরীফ ও রোমানসহ তাদের ২০/২৫ জন সদস্যের সবাই মাদকাসক্ত। মাদকের টাকা জোগানোর জন্য তারা মেসের শিক্ষার্থীদের কাছে চাঁদাবাজি করত। চাঁদা না দিলে ভাঙচুর করা হতো। আকতারুজ্জামান বলেন, আব্দুর রহিম স্থানীয় এক যুবলীগ নেতার শেল্টারে রয়েছেন। আর তার ভাই শরীফ প্রথমে যুবদলের সঙ্গে থাকলে পরে টিপুর সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন। একসময় সেই সঙ্গও ত্যাগ করেন। ওই এলাকার স্থানীয় এক রিকশাচালক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, রোমান এবং শরীফসহ তাদের সহযোগীদের অত্যাচারে এলাকাবাসী অতিষ্ঠ ছিল। তারা সবাই মাদক সেবন করে, আবার ব্যবসাও করে। জোড়া খুনের পর থেকে মাদক ব্যবসা আপাতত বন্ধ রয়েছে।

অপরদিকে হত্যাকাণ্ডে অভিযুক্ত সৈয়দ কবির আহম্মেদ মিঠু ও তার ছোট ভাই সৈয়দ সার্জিল আহম্মেদ টিপু গোয়ালগাড়ি এলাকার প্রভাবশালী ‘আকিল আহমেদ’পরিবারের সদস্য। তাদের বাবা প্রয়াত সৈয়দ আকিল আহমেদ ৯০-এর দশকে জাতীয় পার্টির প্রভাবশালী নেতা ছিলেন। তার ৬ সন্তানের মধ্যে বড় প্রয়াত সৈয়দ শাহীন আহম্মেদ টুকু বগুড়া জেলা আওয়ামী লীগের কোষাধ্যক্ষ ছিলেন। অন্য ৫ ভাইয়ের মধ্যে মিঠু স্থানীয় পরিবহন সেক্টরে প্রভাবশালী শ্রমিক নেতা। টিপু ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে জড়িত হয়ে প্রথমে বগুড়া পৌরসভার ১ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর এবং পরে বগুড়া জেলা পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হয়ে ক্ষমতার বলয়ে যুক্ত হন। তার ভায়রা শাহ্ মেহেদী হাসান হিমুও ওই পরিবারের ছায়াসঙ্গী হিসেবে রয়েছেন। সৈয়দ আকিল আহমেদের অপর তিন ছেলে ঠিকাদারি ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত। 

বগুড়া উপশহর এলাকার বাসিন্দারা জানান, ঈদের দিন বিকালে টিপুর গাড়িতে তার মেয়ে এবং ভাতিজার সামনে স্থানীয় যুবকদের কর্মকাণ্ডকে তারা বাড়াবাড়ি হিসেবে নিয়েছিলেন। আকিল আহমেদের পরিবারের সদস্যরা ওই দুই যুবককে শায়েস্তা করার পরিকল্পনা করেন। শরীফের বড় ভাই লেমন শেখও মনে করেন আকিল আহমেদের পরিবারের সদস্যরা তাদের দাম্ভিকতা অটুট রাখতেই জোড়া হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে। তিনি বলেন, রোমানের সঙ্গে টিপুর গাড়িচালকের যে ঘটনা ঘটেছে সেটি খুবই তুচ্ছ। আলোচনার মাধ্যমেই সমাধান করা যেত। কিন্তু তারা তা করেননি। বরং পরিবারের দাপট দেখানোর জন্য হত্যার মতো জঘন্য কাজকে বেছে নিয়েছেন। তবে তারা যতই প্রভাবশালী হোক না কেন আমরা তাদের বিচার চাই।

সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) বগুড়া জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক হুমায়ুন ইসলাম তুহিন বলেছেন, জোড়া খুনের ঘটনায় প্রমাণ হয়, হরে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। জুন মাসে ৮টি হত্যাকাণ্ডের উদাহরণ টেনে তিনি বলেন, প্রতিটি ঘটনা বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে যে সামাজিক অবক্ষয় ও মাদকাসক্তির কারণে এসব হত্যাকাণ্ড ঘটছে। 

জোড়া হত্যাকাণ্ড তদন্তে নিয়োজিত বগুড়া সদর থানার ওসি (তদন্ত) শাহীনুজ্জামান জানিয়েছেন, গ্রেপ্তার ৪ আসামিকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য বুধবার আদালতে তুলে ৭ দিনের রিমান্ড চাওয়া হয়। তবে আদালত রিমান্ড আবেদন শুনানির জন্য পরবর্তী দিন ধার্য করে আসামিদের জেলহাজতে পাঠিয়েছেন। 

বগুড়ার পুলিশ সুপার সুদীপ কুমার চক্রবর্ত্তী জানিয়েছেন, বিগত মাসগুলোতে যেসব হত্যাকাণ্ড ঘটেছে তার কোনোটিতেই আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহার ছিল না। এবার তা হওয়ায় আমরা বিষয়টি খুবই সিরিয়াসলি নিয়েছি। যার প্রমাণ আসামিরা প্রভাবশালী হওয়া সত্ত্বেও আমরা তাদের গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হয়েছি। পলাতক অন্যদেরও খুব দ্রুত গ্রেপ্তার করা হবে।

শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা