মিয়ানমার সীমান্ত
কক্সবাজার প্রতিবেদক
প্রকাশ : ০৯ জুন ২০২৪ ১১:০৩ এএম
মিয়ানমার সীমান্ত দিয়ে আনা হচ্ছে গরু। বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত সাড়ে ১২টার পর বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার সীমান্তবর্তী কালাচাইন্দা সড়ক থেকে তোলা। প্রবা ফটো
৬ জুন, বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে ১২টা। বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার সীমান্তবর্তী কালাচাইন্দা সড়কে দেখা মেলে সারি সারি গরু। পায়ে হেঁটে এসব গরু আনছে কিছু মানুষ। যাদের অনেকেই কাপড় দিয়ে মুখ ঢেকে রেখেছে। আবার অনেকেই বীরদর্পে হেঁটে যাচ্ছে। তাদের সবার হাতেই রয়েছে লোহা বা কাঠের লাঠি। আবার অনেককেই কৌশলে আগ্নেয়াস্ত্র বহন করতেও দেখা যায়। সারিবদ্ধ এসব গরু কিছু দূর এগিয়ে তুলে দেওয়া হচ্ছে অপেক্ষারত ট্রাকে। এ যেন মধ্যরাতে জমজমাট গরুর হাট। তবে এসব গরু বাংলাদেশের কোনো খামারির নয়। মিয়ানমার থেকে চোরাইপথে এসব গরু আনছে সংঘবদ্ধ চোরাকারবারি চক্র।
শুধু কালাচাইন্দা সড়ক নয়; সীমান্তের নাইক্ষ্যংছড়ির বাম হাতিরছড়া, ফুলতলী, চাকঢালা, লম্বাশিয়া, ভাল্লুক খাইয়া, দৌছড়ি, তমব্রু, বাইশফাঁড়ি, আশারতলী, জামছড়ি, বম্বনিয়া এবং রামু উপজেলার হাজিরপাড়া ও মৌলভীরকাটা দিয়েও একইভাবে চোরাইপথে গরু আনছে চক্রটি।
সীমান্ত এলাকার লোকজন জানিয়েছেন, চিহ্নিত ৯ ব্যক্তির নেতৃত্বে ২০০-এর বেশি চোরাকারবারি কোরবানির ঈদ সামনে রেখে বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। প্রতিদিনই সীমান্তের নানা পয়েন্ট দিয়ে ঢুকছে শত শত গরু-মহিষ। আর সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিবিকেও গুলি করতে চিন্তা করছে না চোরাকারবারিরা। আর ট্রাকযোগে এসব গরু পৌঁছানো হচ্ছে কক্সবাজারের বিভিন্ন উপজেলাসহ দেশের বিভিন্ন জেলায়।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন গরু ব্যবসায়ী বলেন, দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে বেপারিরা আসে গর্জনিয়া বাজারে। কারণ মিয়ানমার থেকে আসা গরু-মহিষ অনেক কম দামে পাওয়া যায়। পুলিশকে দুই হাজার টাকা দিলে বাজারে তুলে রসিদ নেওয়া যায়। এখানে পুলিশ, পুলিশের সোর্স ও ইজারাদারের সিন্ডিকেট রয়েছে।
তবে কক্সবাজারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন) মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, এই কাজে যদি পুলিশের কেউ জড়িত থাকে তাহলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
দুশ্চিন্তায় দেশীয় খামারিরা
রামুর খামারি খলিলুর রহমান বলেন, রামুর গর্জনিয়া, নাইক্ষ্যংছড়ি ও চকরিয়ার হাট থেকে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ছে মিয়ানমার থেকে অবৈধ পথে আসা এসব পশু। এভাবে গরু আসায় বড় লোকসানের আশঙ্কা তার। এসব বিদেশি পশুর সঙ্গে নানা ধরনের রোগবালাই ছড়িয়ে পড়তে পারে বলেও শঙ্কা। এ অবস্থায় সীমান্তপথে গরু আসা বন্ধে কঠোর নজরদারির দাবি জানিয়েছেন তিনি।
খামারি শামীম হোসেন বলেন, নাইক্ষ্যংছড়ির সীমান্ত হাটে তোলা বেশিরভাগ পশুই বিদেশি। এ অবস্থায় কোরবানির মৌসুমের ব্যবসা নিয়ে আতঙ্কে আছি। রামুর কচ্ছপিয়া ইউনিয়নের খামারি আব্দুর রশীদ বলেন, যত রাত গভীর হয় তত গরু বেশি আসে। আসলে মিয়ানমারের গরুগুলো আসাতে আমরা খামারিরা খুব বেশি ক্ষতিগ্রস্ত। মিয়ানমারের গরুগুলো সম্পূর্ণ রোগা। যার কারণে ওই সব গরুর দাম কম। এতে আমরা এমনভাবে ক্ষতিগ্রস্ত, আমরা ব্যাংকের লোন শোধ করতে পারছি না। গরুর খাবারের দাম বেশি কিন্তু আমরা গরুর ন্যায্য মূল্য পাচ্ছি না। বিভিন্নভাবে তারা সিন্ডিকেট করে, প্রশাসনকে ম্যানেজ করে গরুগুলো নিয়ে আসে এবং এগুলো আনার পরে তারা বিভিন্ন জায়গা দিয়ে, বিভিন্ন পথে নিয়ে যায়। গরুগুলো চকরিয়া, ঈদগাহ এবং গর্জনিয়া বাজারেও বিক্রি হয়। সরকারের কাছে আমাদের অনুরোধ থাকবে, যেন অবৈধভাবে মিয়ানমার থেকে গরু প্রবেশ বন্ধ করা হয়।
চোরাইপথে গরু আনতে গিয়ে অঘটন
সীমান্তের লোকজন বলছেন, মিয়ানমারের সীমান্ত এলাকার অভ্যন্তরে অবস্থানরত আরাকান আর্মির সদস্যরাই গরু-মহিষ ও মাদকদ্রব্য পাচারে চোরকারবারি চক্রের সঙ্গে জড়িত। ওপারের কিছু লোকের মাধ্যমে আনা গরু-মহিষপ্রতি তাদের গড়ে ৫০০ টাকা করে উৎকোচ প্রদান করলেই পাচারে সহায়তা মিলছে। আর এসব পাচার ঠেকাতে গিয়ে বিজিবির সঙ্গে গোলাগুলির ঘটনায় হতাহতও হয়েছে। একই সঙ্গে পাচারের সময় মাইন বিস্ফোরণেও হতাহতের ঘটনা ঘটেছে। চোরাকারবারের টাকা ভাগাভাগির দ্বন্দ্বে একাধিকবার সংঘর্ষও হয়েছে।
সর্বশেষ ২ জুন রাতে গর্জনিয়া সীমান্তে বিজিবির সঙ্গে গোলাগুলিতে নেজাম নামের এক ডাকাত ও চোরাকারবারি নিহত হওয়ার নেপথ্যে ছিল চোরাচালান।
বিজিবির দাবি, সীমান্তে চোরাচালান রোধে কাজ করতে গিয়ে ডাকাত দলের সদস্য নেজামের নেতৃত্বে বিজিবির টহল দলের ওপর গুলি ছোড়ে। পরে আত্মরক্ষার্থে বিজিবি পাল্টা গুলি ছুড়লে নেজাম ডাকাত নিহত হয়। এ ঘটনায় ৪ জুন রামু থানায় মামলা দায়ের করেছেন নাইক্ষ্যংছড়ি ১১ বিজিবির হাবিলদার মো. হুমায়ুন কবির। মামলায় নিহত নেজাম উদ্দিনকে প্রধান আসামি করে ১৬ জনের নাম উল্লেখসহ অজ্ঞাত আরও দেড়-দুইশ ব্যক্তিকে আসামি করা হয়েছে।
যা বলছে চোরাচালানবিরোধী টাস্কফোর্স
কক্সবাজারের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ও জেলা চোরাচালানবিরোধী টাস্কফোর্সের সদস্য মো. ইয়ামিন হোসেন বলেন, আমরা চেষ্টা করছি এটা কীভাবে বন্ধ করা যায়। যারা গরু-মহিষ নিয়ে আসছে তাদের ধরে প্রতিদিনই আইনি ব্যবস্থা করি, বিজিবির মাধ্যমে এটা করা হয়। যার ফলে তারা নিরুৎসাহিত হয়। এখানে কিছু আইনগত বিষয় আছে। আমরা চেষ্টা করছি সবকিছু কাটিয়ে উঠে এই চোরাকারবারিদের লাগাম টেনে ধরার জন্য।