রায়হানুল ইসলাম আকন্দ, শ্রীপুর (গাজীপুর)
প্রকাশ : ০৯ জুন ২০২৪ ১০:৩৮ এএম
কারখানার বিষাক্ত বর্জ্যে গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া লবলং খালটি এখন মৃতপ্রায়। পানির রঙ কালো ও দুর্গন্ধযুক্ত। দখল, দূষণ ও আবর্জনার ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে একসময়ের খরস্রোতা লবলং। সম্প্রতি তোলা। প্রবা ফটো
নদীর মতো বড় একটি খাল কীভাবে দিন দিন অস্তিত্ব হারিয়ে ফেলছে তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া লবলং খাল। কারখানার বিষাক্ত বর্জ্যে খালটি এখন মৃতপ্রায়। পানির রঙ কালো ও দুর্গন্ধযুক্ত। জনশ্রুতি আছে, লবলংকে একসময় অনেকেই সাগর বলত। পালতোলা নৌকা চলত। শোনা যেত মাঝির আকুল করা গান। দখল, দূষণ ও আবর্জনার ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে একসময়ের খরস্রোতা সেই লবলং। অনাবাদি হয়ে পড়েছে দুপাশের ফসলি জমি। বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হচ্ছে তীরবর্তী মানুষ।
এই নদী বা খালকে কেন্দ্র করে এলাকার কৃষিনির্ভর অর্থনীতি গড়ে উঠেছিল। নব্বইয়ের দশকে শ্রীপুরে শিল্পকারখানা গড়ে উঠলে খাল দূষণ শুরু হয়। শুধু লবলং নয়, দূষণ-দখলে একই অবস্থা শ্রীপুরের হল-ধাউর, টেংরার খাল, কাটার খাল, সেরার খাল, বৈরাগীরচালার খাল, তরুণের খাল ও সালদহ খালের।
শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের অধীনে কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের তথ্যমতে, শ্রীপুরে ৪৩৮টি শিল্পকারখানা সক্রিয় রয়েছে। তার মধ্যে মাওনা ইউনিয়নেই রয়েছে ৭৩টি। লবলং খালটি ময়মনসিংহের ভালুকার খিরু নদী থেকে গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার মাওনা হয়ে তুরাগ নদে এসে যুক্ত হয়েছে। নদীটি স্থানীয় মানুষ ও পরিবেশের জন্য আশীর্বাদ হওয়ার কথা থাকলেও উল্টো অভিশাপে পরিণত হয়েছে। গাজীপুর অংশের শিল্পকারখানাগুলোর বর্জ্য সরাসরি খালে পড়ছে। রিভার অ্যান্ড ডেল্টা রিসার্চ সেন্টারের (আরডিআরসি) গবেষণায় খালে ১৫টি পয়োনিষ্কাশন লাইন এবং ১১টি ডাম্পিং স্টেশন গড়ে উঠেছে। ওই সংস্থাটির গবেষণায় সবচেয়ে দূষিতের তালিকায় লবলং অন্যতম।
লবলং খালের মাওনা ইউনিয়নের মাওনা-ফুলবাড়িয়া সড়কের দুপাশে ক্রাউন কারখানা, তেলিহাটি ইউনিয়নের অংশে দখলে অস্তিত্ব হারিয়েছে ধাউরের খাল। শ্রীপুর পৌরসভার বৈরাগীরচালা খালটি শিল্পবর্জ্য ও দখলে সংকুচিত হয়ে পড়েছে। ওই খালের গড়গড়িয়া মাস্টারবাড়ি অংশে কয়েক মাস ধরে বর্জ্য ফেলায় পানির প্রবাহ বন্ধ হয়ে পড়ছে। গোসিঙ্গা ও রাজাবাড়ি ইউনিয়নের তরুণের খালটির বিভিন্ন অংশ দখল-দূষণে এখন মৃত।
মাওনা ইউনিয়নের চকপাড়ার গ্রামের সত্তরোর্ধ্ব কৃষক আব্দুল জব্বার বলেন, লবলং খাল দেখে মনে হতো জলে টইটম্বুর এক রাক্ষুসে নদী। সেই রাক্ষসরূপী খাল এখন অস্তিত্ব সংকটে হারিয়ে ফেলেছে তার চরিত্র। এখন কেউ বলে লবলং খাল আবার কেউ বলে লবলং নালা। লবলং ভরাট ও গতিপথ পরিবর্তন করে গড়ে উঠেছে শিল্পকারখানা। সরকারি এসব খাল দখল-দূষণে কোথাও কৃষক, কোথাও প্রভাবশালী এবং শিল্পকারখানার মালিকেরা জড়িয়ে পড়ছেন। শুধু দখল করেই থেমে নেই। বিভিন্ন জায়গায় পরিবর্তন করা হয়েছে এর গতিপথ। খালের কিছু দূরে যেসব জমিতে এখনও চাষাবাদ হচ্ছে, বর্ষা মৌসুমে পানির সাথে ওইসব জমিতে বর্জ্য গিয়ে ফলন কমে যাচ্ছে। উৎপাদিত ফসল মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য ঝুঁকি হয়ে পড়ছে। অতিমাত্রায় দূষণের কারণে এ খালে কোনো মাছ নেই। এমনকি সাপ বা ব্যাঙও পাওয়া যায় না।
স্থানীয়দের অভিযোগ, নদী দখলমুক্ত করতে ও ফসলি জমি রক্ষার জন্য বিভিন্ন দপ্তরে ধরনা দিয়েও কোনো ফল পাননি। পরিবেশ দূষণকারীরা প্রভাবশালী হওয়ায় প্রশাসন ব্যবস্থা নিতে চাইলে সহজে কুলিয়ে উঠতে পারছে না। স্থানীয় পরিবেশ অধিদপ্তরে মোটা অঙ্কের টাকা দিয়ে তারা ছাড়পত্র বা সনদ নিচ্ছেন এবং নবায়নও করছেন বলে অভিযোগ। তারা আগামী কয়েক বছর জমিতে চাষ করতে পারবেন না। তাদের অভিযোগ বিষয়ে কেউ গুরুত্ব দেয় না। গাজীপুর সদর উপজেলার বাঘেরবাজার থেকে সাফারি পার্ক যাওয়ার পথে লবলং খালে নির্মিত সেতুর গোড়ায় মাঝরাতে বাঘের বাজার থেকে ট্রাক ভরে বর্জ্য ফেলা হয়। আমরা এসব নিয়ে অভিযোগ দিলে কারখানার মালিকেরা স্থানীয় প্রতিনিধিদের ম্যানেজ করেন।
বাংলাদেশ রিভার অ্যান্ড নেচার ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান খোরশেদ আলম বলেন, বেশিরভাগ শিল্পকারখানায় ইটিপি সংযোগ কেবলই লোকদেখানো। পরিবেশ দূষণের প্রতিবাদে এবং দূষণকারীদের শাস্তির দাবিতে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করেও কোনো লাভ হয়নি। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ তাদের বিরুদ্ধে দৃশ্যমান কোনো ব্যবস্থাও নেয়নি।
শ্রীপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদাক অ্যাডভোকেট হারুন অর রশিদ ফরিদ বলেন, গাজীপুরে ডায়িং ও প্রিন্টিং কারখানা রয়েছে ১৪টি। বর্জ্য শোধনের জন্য ওইসব কারখানায় শোধনাগার বা ইটিপি থাকার কথা পরিবেশ অধিদপ্তর স্বীকার করলেও অধিকাংশ কারখানায় নিয়ম মেনে যথাযথভাবে ইটিপি স্থাপন হয়নি। কারখানা কর্তৃপক্ষ তাদের ইটিপিগুলো ঠিকমতো পরিচালনা করে না।
গাজীপুর জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক রফিকুল ইসলাম খান বলেন, জেলায় কারখানার বর্জ্যের কারণে ৩৮০ হেক্টর জমি আক্রান্ত। তবে পরিবেশ নিয়ে কাজ করেন এমন সংগঠন ও পরিবেশবিদদের দাবি, নষ্ট হওয়া জমির পরিমাণ আরও বেশি।
গাজীপুর পরিবেশ অধিদপ্তরের উপপরিচালক নয়ন মিয়া বলেন, খাল, বিল ও নদী দখল-দূষণের অভিযোগে বিভিন্ন সময় কারখানায় অভিযান চালিয়ে ক্ষতিপূরণ বা জরিমানা করা হয়েছে। এ ধরনের অভিযান অব্যাহত আছে। বর্জ্য পরিশোধনে ইটিপি ব্যবহার না করলে আমরা নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করছি। গাজীপুর জেলা প্রশাসক (ডিসি) আবুল ফাতে মো. সফিকুল ইসলাম জানান, খালগুলোর তালিকা তৈরি করা হয়েছে। পর্যায়ক্রমে তা দখলমুক্ত করে দখলদারদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে জেলা প্রশাসন সবসময় তৎপর।
এভাবে সরকারের সব দপ্তর বক্তব্য দিলেও খাল ও নদ-নদীগুলো প্রতিনিয়ত আগ্রাসনের শিকার হচ্ছে। হারিয়ে যাচ্ছে প্রাণপ্রবাহ।