আওয়ামী লীগে সংঘাত
এস এম রানা, চট্টগ্রাম
প্রকাশ : ০৯ জুন ২০২৪ ১০:০৪ এএম
ওয়াসিকা আয়শা খান ও সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদ। ছবি কোলাজ : প্রবা
চট্টগ্রামের আনোয়ারা উপজেলা আওয়ামী লীগে আখতারুজ্জামান চৌধুরী ও আতাউর রহমান কায়সারের দ্বন্দ্ব এখন পুরোনো গল্প। শুধু আনোয়ারা নয়, চট্টগ্রাম এবং কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগেও প্রভাবশালী এই নেতার মৃত্যুর পর এতদিন বিষয়টি অনালোচিত থাকলেও এক যুগের বেশি সময় পর বিষয়টি আবার সামনে এনেছেন তাদেরই দুই সন্তান।
এবার মুখোমুখি আখতারুজ্জামান চৌধুরীর ছেলে, সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদ এমপি এবং আতাউর রহমান কায়সার তনয়া, অর্থ প্রতিমন্ত্রী ওয়াসিকা আয়শা খানের অনুসারীরা। তাদের মধ্যে নতুন করে সংঘাত শুরু হয়েছে শুক্রবার। ওই দিন দুই বলয়ের সংঘাতে আহত হয়েছেন ১৮ জন। আহতদের মধ্যে রয়েছেন উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদের অনুসারী হিসেবে পরিচিত এম এ মান্নান চৌধুরীও। যিনি সদ্য শেষ হওয়া উপজেলা নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী ছিলেন। এই সংঘাতকে এখন আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতাকর্মীরাই বলছেন, ‘দ্বিতীয় প্রজন্মের প্রথম সংঘাত’।
আনোয়ারা আওয়ামী লীগে দ্বিতীয় প্রজন্মের গৃহদাহ শুরুর আগে প্রথম প্রজন্মের সর্বশেষ সংঘাত হয়েছিল ২০১১ সালে। ওই সময় আখতারুজ্জামান চৌধুরীর জীবদ্দশায় আতাউর রহমান কায়সারের ছোটভাই ও উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আনোয়ারুল ইসলাম খানকে পিটিয়ে আহত করা হয়েছিল। সেদিন হামলায় নেতৃত্ব দিয়েছিলেন আখতারুজ্জামান বাবুর অনুসারী হিসেবে পরিচিত নাসিরুল হক খান। এরপর প্রায় ১৩ বছর পর আবার সংঘাতের ঘটনা ঘটল গত শুক্রবার। এবারের ঘটনায় ঘায়েল আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবুর ছেলে জাবেদের অনুসারীরা।
সংঘাতের পরদিন গতকাল শনিবার বিকালে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এম এ মান্নানকে দেখতে যান অর্থ প্রতিমন্ত্রী ওয়াসিকা আয়শা খান এবং তার অনুসারী নবনির্বাচিত উপজেলা চেয়ারম্যান কাজী মোজাম্মেল হক। এই দুজনের সঙ্গে ছিলেন হামলায় নেতৃত্ব দেওয়া ব্যক্তিদের একজন মোজাম্মেল ওরফে গাছ মোজাম্মেল। এই মোজাম্মেলের বাবার নাম মো. সোলাইমান। শুক্রবার বিকালে সেন্টার বন্দর এলাকায় সংঘাতের সময় ধারণ করা একটি ভিডিও ফুটেজে দেখা গেছে অন্য নেতাকর্মীদের সঙ্গে গাছ মোজাম্মেলও মিছিলে ছিলেন। তার শারীরিক ভাষা আক্রমণাত্মক ছিল বলে পুলিশ চিহ্নিত করেছে।
হামলাকারীদের একজন গাছ মোজাম্মেলকে নিয়ে হাসপাতালে আহত আওয়ামী লীগ নেতাকে দেখতে যাওয়ার বিষয়ে জানতে চেয়ে গতকাল সন্ধ্যায় ফোন করে অর্থ প্রতিমন্ত্রী ওয়াসিকা আয়শা খানকে পাওয়া যায়নি। পরে নবনির্বাচিত উপজেলা চেয়ারম্যান কাজী মোজাম্মেল হক প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, ‘অর্থ প্রতিমন্ত্রী এখন গহিরা এলাকায় জনসংযোগে ব্যস্ত আছেন।’ উপজেলা চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী এম এ মান্নানকে দেখতে যাওয়ার সময় মোজাম্মেল নামের এক হামলাকারীকে নিয়ে যাওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এম এ মান্নান নিজেই বলেছেন, মোজাম্মেল তাকে (মান্নানকে) রক্ষা করেছেন। অন্যরা যখন মোজাম্মেলকে আঘাত করার চেষ্টা করেছিল, তখন মোজাম্মেল এগিয়ে গিয়ে মান্নানকে রক্ষা করে নিরাপদে একটি ভবনের গেট পার করে দেন। এই সময় কলাপসিবল গেটের ওপরের অংশের সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে নাকে আঘাত পান মান্নান। তাই মোজাম্মেলের উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি মান্নানকে আঘাত করার অভিযোগ সঠিক নয়।’
তিনি বলেন, ‘ মান্নান আমাদেরকে এক কথা বলার পর সাংবাদিকদের কেন ভিন্ন কথা বলছেন, সেটা আমি জানি না।’
আনোয়ারা উপজেলার বাসিন্দা এবং চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের একজন নেতা প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, আনোয়ারা উপজেলা আওয়ামী লীগের প্রবীণ আওয়ামী লীগ নেতা ও সাবেক সংসদ সদস্য আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু এবং মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক আতাউর রহমান কায়সারের মধ্যে বিরোধ ছিল। ফলে দুই নেতার আমলে উপজেলা আওয়ামী লীগে গৃহদাহ লেগেই ছিল। দুই নেতার মৃত্যুর পর এই গৃহদাহের অবসান হয়েছিল। এখন দেখছি, নতুন গৃহদাহ শুরু হয়েছে। এটা দলের জন্য ভালো লক্ষণ নয়।
প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, ২০১২ সালে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত চট্টগ্রামের প্রভাবশালী আওয়ামী লীগ নেতা ও সাবেক সংসদ সদস্য আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবুর দুর্দান্ত প্রভাব প্রতিপত্তি ছিল। সংসদ সদস্য পদে থাকা অবস্থায় তার মৃত্যুর পর উপ-নির্বাচনে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়ে বাবার উত্তরসূরি হিসেবে আবির্ভূত হন সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদ। পরবর্তীতে জাবেদকে প্রথমে ভূমি প্রতিমন্ত্রী ও পরে পূর্ণ মন্ত্রী নিয়োগ দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গত সংসদ নির্বাচনেও আনোয়ারা আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদ। কিন্তু এবার আর তিনি মন্ত্রিত্ব পাননি।
অন্যদিকে মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক আতাউর রহমান কায়সার ছিলেন আওয়ামী লীগের প্রচারবিমুখ ও নির্মোহ নেতা। প্রখ্যাত এই কূটনীতিকের বাড়িও চট্টগ্রামের আনোয়ারা উপজেলায়। ২০১০ সালের ৯ অক্টোবর তিনি মৃত্যুবরণ করেন। ২০১৪ সালে সংরক্ষিত নারী আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন তার কন্যা ওয়াসিকা আয়শা খান। প্রথম ও দ্বিতীয় মেয়াদে সংসদ সদস্য থাকাকালে ওয়াসিকা আয়শা খান আনোয়ারায় উল্লেখযোগ্য কোনো রাজনৈতিক কর্মসূচিতে অংশ নেননি। কিন্তু তৃতীয় মেয়াদে সংসদ সদস্য এবং অর্থ প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পাওয়ার পর তিনি আনোয়ারায় রাজনীতির পাদপ্রদীপে চলে আসেন। কারণ, তার প্রতিপক্ষ সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদ হারিয়েছেন মন্ত্রিত্ব।
প্রতিমন্ত্রী ওয়াসিকা আয়শা খান আনোয়ারা উপজেলাকেন্দ্রিক রাজনৈতিক কর্মসূচি বাড়ানোর শুরুতেই উত্তপ্ত হয় রাজনীতির মাঠ। সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদ রাজনীতির মাঠে উত্তপ্ত বাক্য ছুড়ে দেওয়ার পর দুই শিবিরে দূরত্ব বাড়তে থাকে। জাবেদের বিরুদ্ধে অর্থ প্রচারের অভিযোগ উত্থাপন এবং মন্ত্রিত্ব না পাওয়ায় তার বিপুল সংখ্যক অনুসারী রাতারাতি ওয়াসিকা আয়শার অনুসারী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। দুই পক্ষের শক্ত অবস্থান তৈরির পাশাপাশি বিরোধ চরমে ওঠে উপজেলা পরিষদের নির্বাচন ঘিরে। জাবেদ প্রথমে সদ্য সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান তৌহিদুল হক এবং এম এ মান্নানকে সমর্থন করেন। আর ওয়াসিকা সমর্থন দেন কাজী মোজাম্মেল হককে। দুই শিবির থেকে তিনজন শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী তৈরি হওয়ায় শেষ পর্যন্ত জাবেদ অনুসারী এম এ মান্নানকে নির্বাচনের আগ মুহূর্তে নিষ্ক্রিয় করে দেওয়া হয়। তারপর দ্বিমুখী প্রতিদ্বন্দ্বিতায় তৌহিদুল হক চৌধুরীকে হারিয়ে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন ওয়াসিকা বলয়ের কাজী মোজাম্মেল।
এর মধ্য দিয়ে উপজেলা পরিষদ থেকেও কার্যত কর্তৃত্ব হারান সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদ। বৃহস্পতিবার ঘোষিত হয় জাতীয় বাজেট। এদিন অর্থ প্রতিমন্ত্রীর এলাকায় তার সমর্থকরা এক দফা আনন্দ মিছিল করে। এই আনন্দ মিছিলের পরদিন শুক্রবার জাবেদ বলয়ের নেতারা বন্দর সেন্টার এলাকায় বাজেটকে স্বাগত জানিয়ে মিছিলের কর্মসূচি ঘোষণা করে। জাবেদ পক্ষের এমন ঘোষণার কথা জেনে একই স্থানে পাল্টা কর্মসূচি ঘোষণা করে ওয়াসিকা পক্ষ। এতে পরিস্থিতি ঘোলাটে হয়ে ওঠে। শেষ পর্যন্ত যা সংঘাতে গড়ায়।
মামলা প্রক্রিয়াধীন
শুক্রবার হামলার ঘটনায় ১৮ জন আহত হওয়ার পরদিন শনিবার সন্ধ্যা পর্যন্ত থানায় মামলা হয়নি।কেউ আটকও হয়নি। যদিও পুলিশের ধারণ করা ভিডিও ফুটেজে একাধিক নেতাকে চিহ্নিত করা সম্ভব হয়েছে। মামলার বিষয়ে জানতে চাইলে কর্ণফুলী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. জহির হোসেন প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, ‘এখনও পর্যন্ত কেউ মামলার এজাহার নিয়ে থানায় আসেনি। তবে আহত এম এ মান্নানের পক্ষ থেকে থানায় জানানো হয়েছে, তিনি মামলা করবেন। যদি এজহার নিয়ে কেউ আসে তাহলে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’