রাজশাহী সংবাদদাতা
প্রকাশ : ১৫ নভেম্বর ২০২২ ১২:৫৭ পিএম
আপডেট : ১৫ নভেম্বর ২০২২ ১৪:১৯ পিএম
ভোজনরসিকদের চাহিদার কারণে পদ্মার চর থেকে শহরের ফুটপাত হয়ে এখন অভিজাত রেস্তোরাঁয় ঠাঁই করে নিয়েছে ঐতিহ্যবাহী এই কালাই রুটি। ছবি : প্রবা
রাজশাহী গেছেন আর কালাই রুটির স্বাদ নেননি, খুঁজলে এমন মানুষ হয়তো পাওয়া দায়। রাজশাহীজুড়ে কালাইয়ের আটার রুটি ভোজনরসিকদের কাছে দারুণ জনপ্রিয়। মরিচ বাটা, পেঁয়াজ কুঁচি ও সরিষার তেলে ভেজানো পোড়া বেগুনের ভর্তার সঙ্গে গরম গরম কালাই রুটির কথা শুনলেও অনেকের জিবে জল এসে যায়।
বৈশিষ্ট্যগত কারণে পদ্মার চরাঞ্চল এবং বরেন্দ্র এলাকার কৃষি শ্রমিকদের জনপ্রিয় খাবার ছিল এটি। পদ্মার পলি মাটি মাষকলাই চাষের জন্য বিশেষ উপযোগী। কালাই আবাদে বাড়তি কোনো পরিচর্যার প্রয়োজন হয় না, উৎপাদনও ভালো। আর কালাইয়ের আটা বা রুটির বৈশিষ্ট্যগুলোর মধ্যে অন্যতম এটি খাবার পর হজম হতে দীর্ঘ সময় নেয়। ফলে খিদে লাগে কম, পাশাপাশি শক্তি জোগায়। সম্ভবত এসব কারণেই এই খাবার পদ্মা পাড়ের শ্রমজীবী মানুষের কাছে এত প্রিয়।
এক সময় শুধু রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জে চাহিদা সীমাবদ্ধ থাকলেও স্বাদ ও গুণের কারণে এখন দেশের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে পড়েছে কালাই রুটি। শুরুতে এই খাবার রাজশাহী অঞ্চলের ফুটপাতে শুধু মরিচ বাটার সঙ্গে বিক্রি হতো। তবে ভোজনরসিকদের চাহিদার কারণে কালাই রুটি পদ্মার চর থেকে শহরের ফুটপাত হয়ে এখন অভিজাত রেস্তোরাঁয় ঠাঁই করে নিয়েছে।
রেস্তোরাঁয় কাঁচা মরিচ ও বেগুন ভর্তার পাশাপাশি বিভিন্ন পদের ভুনা মাংসের সঙ্গে পরিবেশন করা হচ্ছে কালাই রুটি। যা এর স্বাদ আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। তাইতো সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে সেলিব্রিটি, রাজশাহীতে আসলে কেউ কালাই রুটির স্বাদ না নিয়ে ফেরে না।
বরিশাল থেকে হাবিব রাজশাহীতে এসেছেন তার এক আত্মীয়ের বাড়িতে। রবিবার রাতে উপশহরে অবস্থিত কালাই হাউসে হাবিবের সঙ্গে কথা হয় বাংলাদেশ প্রতিদিনের। তিনি বলেন, ‘টিভি এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে রাজশাহীর কালাইয়ের অনেক প্রশংসা শুনেছি। রাজশাহীতে এসে এই রুটি খাওয়ার লোভ সামলাতে পারলাম না। এ কারণেই বাসার সবাইকে নিয়ে স্বাদ নিতে এসেছি।’
তার পরের টেবিলে অফিস কলিগদের নিয়ে বসে ছিলেন প্রদীপ নামের এক যুবক। আলাপচারিতায় জানতে চাইলে বলেন, ‘কাজ শেষে বাড়ি ফিরছিলাম, রাতের খাবার হিসেবে কালাই রুটি খেয়ে বাড়ি ফিরব।’ রেস্তোরাঁ ব্যবসায়ীরা ঐতিহ্যবাহী এই খাবারের মান ও সুনাম অক্ষুণ্ন রাখবেন বলে প্রত্যাশা প্রদীপের।
কালাই রুটি বানানো মোটেও সহজ বিষয় নয়। মাষকলাইয়ের আটার সঙ্গে আনুপাতিক হারে আতপ চালের গুঁড়া মিশিয়ে তার সঙ্গে লবণ ও পানির মিশ্রণে তৈরি করা হয় আটার খামিরের বল। তারপর দুই হাতের তালুর চাপে ঘুরিয়ে কলাই রুটি বানাতে হয়। সাধারণ রুটির চেয়ে কালাই রুটি অধিক পুরু ও বড় আকারের হয়। এ রুটি মাটির পাত্রে (তাওয়া) সেঁকে বাদামি রঙের হলে নামিয়ে গরম গরম পরিবেশন করতে হয়। এই কাজটি বেশ পরিশ্রমসাধ্য বিষয়।
রাজশাহী নগরীর উপশহর নিউ মার্কেট এলাকা, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, সাহেববাজার-সংলগ্ন কুমারপাড়া, সিটি হাট, কোট এলাকা এবং লক্ষ্মীপুর এলাকায় কালাই রুটি চোখের সামনে বানিয়ে বিক্রি করেন বিক্রেতারা। উপশহর নিউমার্কেট এলাকার রেস্তোরাঁগুলোতে সন্ধ্যার পর রীতিমতো কালাই রুটিপ্রেমীদের আসর জমে। কেউ আসছেন সপরিবারে, কেউবা বন্ধুদের নিয়ে। এসব রেস্তোরাঁয় বসে বিদেশি কূটনীতিক, জাতীয় দলের খেলোয়াড় এবং সংস্কৃতি অঙ্গনের তারকারা কালাই রুটির স্বাদ নিয়েছেন।
উপশহর নিউমার্কেট এলাকায় অবস্থিত কালাই হাউসের স্বত্বাধিকারী রিপন জানান, ২৫ বছরের পুরোনো তাদের এই ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান। বাবার হাত ধরে এই ব্যবসা শুরু। তার বাবা মারা যাওয়ার পর এখন তিনিই এই ব্যবসা পরিচালনা করছেন।
তিনি আরও জানান, তার এই দোকানে বসে আমেরিকার সাবেক রাষ্ট্রদূত রবার্ট মিলার, জাতীয় ক্রিকেট দলের আশরাফুলসহ বিভিন্ন গণ্যমান্য ব্যক্তিরা খেয়ে গেছেন কালাই রুটি।
মানভেদে কালা রুটির দাম ৩০ টাকা থেকে ৬০ টাকা। এর সঙ্গে বেগুন মরিচ ভর্তা ১০ টাকা, গরু ভুনা ১২০ টাকা, কালা ভুনা দেড়শ টাকা, রাজহাঁস ভুনা ২০০ টাকা, পাতি হাঁস ভুনা ১০০ টাকা, বট ১০০ টাকা বাটি করে বিক্রি হয়।