বহ্নি ফারহানা
প্রকাশ : ১৬ অক্টোবর ২০২২ ১৪:২০ পিএম
আপডেট : ১৬ অক্টোবর ২০২২ ১৫:৪৬ পিএম
কড়া পাঠশালায় চলছে পাঠদান। ছবি : প্রবা
ভাদ্র মাসের চড়চড়ে রোদ মাথায় নিয়ে ছোটবড় সবাই জড়ো হয়েছিল সেদিন। কারও চোখে-মুখে ক্লান্তি আবার কেউ ঘামে সিক্ত; দাঁড়িয়ে আছে খোলা জায়গাটি ঘিরে। সবার মুখে আনন্দের ছাপ। নাকে নথ পরা আট বছর বয়সি অঞ্জলিও সবার সঙ্গে ভিড়ে দাঁড়িয়ে আছে, মুখে মিষ্টি হাসি। কী করছো এখানে? জানতে চাইলে হাত দিয়ে দেখিয়ে বলল, এখানে পাঠশালা হবে।
দেশের উত্তরের অঞ্চল দিনাজপুরে আদিবাসী কড়াদের ২৮টি পরিবার টিকে আছে। বাংলাদেশ সরকারের ‘ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান আইনে’ যে ৫০টি জনজাতিকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে, তাদের মধ্যে সংখ্যার দিক থেকে সবচেয়ে পেছনে কড়াদের অবস্থান। বর্তমানে তাদের সংখ্যা মাত্র ১০৬ জন। এর মধ্যে দিনাজপুরের বিরল উপজেলার হালজায় মৌজার ঝিনাইকুড়ি গ্রামেই বাস করে তাদের ২৪টি পরিবার। এ কড়া গ্রামেই সাত মাস ধরে এগিয়ে যাচ্ছে কড়াদের বাতিঘর ‘কড়া পাঠশালা’।
পাঠশালাটির জন্য তৈরি হচ্ছে স্থায়ী ঠিকানা। নিজের জমিতে নিজের ঘরেই এখন থেকে পাঠদান হবে তাদের। গোত্রপ্রধান জগেন কড়া ঘরকে কুলা, ঝাড়ু দিয়ে বরণ করে নির্মাণকাজের শুভারম্ভ করেছেন।
কড়া অর্থ মাটি খোঁড়া। এই আদিবাসীদের এমন নামকরণের কারণ হলো, কোনো একসময় দিঘি খননের সঙ্গে যুক্ত ছিল তারা, কড়ারা নিজেরাই এমনটা বলে থাকে। ইংরেজ আমলে ভারতবর্ষের বিভিন্ন জায়গায় বসেছে রেললাইন। পাহাড় কেটে, মাটি খুঁড়ে সেই রেললাইন বসানোর কাজটা মূলত এই আদিবাসীরাই করেছে। রেললাইনের কাজের সূত্র ধরে ভারতের ঝাড়খণ্ড থেকে কড়াদের আগমন ঘটেছিল দিনাজপুর অঞ্চলে।
শেষ পর্যন্ত দেশে টিকে থাকতে পারবে কি না, তা নিয়ে সংশয়ে আছে ঝিনাইকুড়ির শেষ কড়ারা। বিলুপ্ত হতে চলা এই জনগোষ্ঠীকে রক্ষা করতে হলে শিক্ষা-দীক্ষায় এগিয়ে আনতে হবে, এই চিন্তা থেকে উন্নয়ন সংস্থা ‘ভাবনা’ তৈরি করে কড়া পাঠশালা।
ভাবনার প্রধান নির্বাহী মুস্তাফিজুর রহমান রূপম জানান, নিত্যদিনের ক্ষুধার অন্ন সংস্থান করাই এখানে কঠিন লড়াইয়ের বিষয়। মূলধারার বিদ্যালয়ে গিয়ে প্রথমেই ভাষা বুঝতে না পারা এবং বোঝাতে না পারার একটা বড় সংকটে পড়তে হয় কড়া শিশুদের। বাংলা ভাষার সঙ্গে অভ্যস্ত হওয়ার আগেই ঝরে পড়ে কেউ কেউ। বাকিরা এক সময় বাংলায় কিছুটা অভ্যস্ত হয়ে পড়লেও বাড়িতে পড়াশোনায় সহযোগিতা করার মতো কেউ না থাকায়ও মানসম্পন্ন শিক্ষা পায় না।
নিজেদের তেমন শিক্ষা-দীক্ষা নেই বলে অভিভাবকরা শিশুদের পাঠে সহযোগীর ভূমিকা নিতে পারেন না। আর্থিক দৈন্যের কারণে গৃহশিক্ষক রাখার মতো সামর্থ্যও নেই এই অভিভাবকদের। তাই উন্নয়ন সংস্থা ভাবনা কড়াদের গ্রামে একটি বিকল্প পাঠশালা প্রতিষ্ঠা করেছে, যেখানে দুজন শিক্ষকের একজন প্রাক-প্রাথমিকের শিক্ষার্থীদের বিদ্যালয়ে পাঠানোর উপযোগী করে তোলার কাজ করছেন এবং অন্যজন ইতোমধ্যে যারা বিদ্যালয়ে যাচ্ছে, গৃহশিক্ষকের মতো তাদের শিক্ষাগ্রহণকে সহজ করে দেওয়ার কাজটি করছেন।
গ্রামটিতে বর্তমানে স্কুলগামী শিক্ষার্থীর সংখ্যা ১০ এবং স্কুলে যাওয়ার উপযোগী হয়ে উঠছে আরও ছয়জন। স্কুলগামী ১০টি ছেলেমেয়ের ছয়জন অষ্টম শ্রেণিতে পড়ছে। চতুর্থ শ্রেণিতে দুজন এবং পঞ্চম ও দশম শ্রেণিতে একজন করে শিক্ষার্থী রয়েছে।