প্রবা প্রতিবেদক
প্রকাশ : ১৭ এপ্রিল ২০২৪ ২১:৩৯ পিএম
আপডেট : ১৭ এপ্রিল ২০২৪ ২২:০১ পিএম
পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) প্রধান মোহাম্মদ আলী মিয়া। ছবি : সংগৃহীত
কক্সবাজারে ভয়ানক মাদক কারবার থেকে অর্জিত সাবেক সংসদ সদস্য আব্দুর রহমান বদির পরিবারের বিপুল সম্পদের খোঁজ পেয়েছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। সারা দেশ থেকে বাছাইকৃত ৩৫টি মামলার তদন্তে নেমে সিআইডি এমন তথ্য পেয়েছে। তা ছাড়া সিআইডি জেনেছে, দেশে প্রতিবছর প্রায় ৮০ হাজার মাদক মামলা হয়।
বুধবার (১৭ এপ্রিল) সিআইডিপ্রধান অতিরিক্ত আইজি মোহাম্মদ আলী সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান। তিনি বলেন, ‘সারা দেশে মাদকের ৩৫টি মামলা তদন্ত করতে গিয়ে ইয়াবার রাজধানীখ্যাত কক্সবাজারে ইয়াবা কারবারে যেসব গডফাদার রয়েছে, তাদের বিষয়ে তদন্ত করেছে সিআইডি। তদন্তে সাবেক সংসদ সদস্য বদির ভাইদের সংশ্লিষ্টতার তথ্য পাওয়া গেছে।’
তিনি বলেন, ‘ইতোমধ্যে বদির দুই ভাইয়ের নাম ইয়াবা কারবারে থাকার সুনির্দিষ্ট তথ্য মিলেছে। এর মাধ্যমে তারা কয়েক কোটি টাকার সম্পদ অর্জন করেছেন বলে জেনেছে সিআইডি। তাদের সম্পদ রাষ্ট্রের অনুকূলে বাজেয়াপ্ত করার আইনি প্রক্রিয়াও শুরু করেছে সিআইডি।’
সিআইডিপ্রধান জানান, ৩৫টি মামলার মধ্যে ইতোমধ্যে ১৩টির চার্জশিট দেওয়া হয়েছে। আরও ২২টির তদন্ত চলছে। এসব মামলা মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণের নতুন আইন হওয়ার পর করা হয়েছে। এগুলো নিয়ে সিআইডি কাজ শুরু করছে ২০২২ সাল থেকে।
তিনি বলেন, ‘মাদকের কারবার বা সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেলে কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না। সে যে-ই হোক। আমরা তদন্ত করতে গিয়ে টেকনাফের সাবেক এমপি আব্দুর রহমান বদির দুই ভাই আমিনুর রহমান ও আব্দুর শুক্কুরের সংশ্লিষ্টতা পেয়েছি।’
৩৫ মামলার আসামিদের ১৭৮ কোটি টাকার সম্পদ
সিআইডি জানিয়েছে, কক্সবাজার, চট্টগ্রাম, ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে দায়ের হওয়া ৩৫ মামলার তদন্ত করে সিআইডি। আসামিদের বাইরে তাদের গডফাদার কারা সেটা খুঁজে বের করা হচ্ছে। মাদকের গডফাদাররা অবৈধভাবে অর্থ উপার্জন করেছে। এসব অর্থ তারা বিভিন্ন ব্যাংকে রেখেছে। তা ছাড়া জমি, বাড়ি, ফ্ল্যাট, গাড়িসহ বিভিন্ন সম্পদ অর্জন করেছে। এর মধ্যে প্রায় ১৭৮ কোটি ৪৪ টাকার টাকার সম্পদ আদালতের মাধ্যমে বাজেয়াপ্ত করার প্রক্রিয়া চলছে। সিআইডিপ্রধান বলেন, ‘২০২১ সালে ৭৯ হাজার ৬৭৫টি, ২০২২ সালে ৮২ হাজার ৬৭২টি ও ২০২৩ সালে ৭৬ হাজার ৪০৩টি মাদকদ্রব্য-সংক্রান্ত মামলা হয়েছে। দেশে গড়ে প্রতিবছর প্রায় ৮০ হাজার মাদক উদ্ধারসংক্রান্ত মামলা হয়।’
তিন মামলায় সম্পদ ক্রোক
সিআইডি প্রতিবেদন অনুযায়ী ইতোমধ্যে ৩৫ মামলার মধ্যে তিনটির হোতাদের ৯ দশমিক ১৪ একর জমি ও দুটি বাড়ি (আনুমানিক মূল্য ৮ দশমিক ১১ কোটি টাকা) ক্রোক করেছেন আদালত। এ ছাড়া মাদকসংক্রান্ত মানি লন্ডারিংয়ের মামলায় ব্যাংকে গচ্ছিত ১ কোটি ১ লাখ ২৩ হাজার ৪২৫ টাকা জব্ধ হয়েছে। হোতাদের একজন কক্সবাজারের নুরুল হক ওরফে ভুট্টো। তা ছাড়া চট্টগ্রামের শফিক আলম ওরফে শফিক ওরফে শফি নামে একজন রয়েছেন। আরও রয়েছেন শাহজাহান হাওলাদার নামে একজন।
বদি ও তার পরিবার
সিআইডিপ্রধান বলেন, তারা বদির দুই ভাই আব্দুস শুক্কুর ও আমিনুর রহমানের ৬ একর ৪০ শতাংশ জমির সন্ধান পেয়েছেন। আরও সম্পদের খোঁজ নিচ্ছে সিআইডি। এসব সম্পদ বের করার পর আদালতের মাধ্যমে ক্রোক করার প্রক্রিয়া শুরু হবে। সিআইডিপ্রধান বলেন, ‘বদি ও তার পরিবারের যে বা যারা মাদকের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট, তাদের কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না। তারা কোন দল বা কোন মতের লোক, তা দেখা হবে না। অপরাধী যে দলেরই হোক না কেন, তার পরিচয় সে অপরাধী। মাদক ব্যবসায়ীর পরিচয় মাদক ব্যবসায়ী বলেই।’
৩৫ মামলায় আসামি ১২২ জন
সিআইডি জানিয়েছে, ৩৫ মামলায় সাবেক সংসদ সদস্য বদির দুই ভাইসহ আসামির সংখ্যা ১২২। তাদের মধ্যে সিআইডি বিভিন্ন সময় ৩৪ জনকে গ্রেপ্তার করেছে। গ্রেপ্তার ৩৪ জনের মধ্যে ২০ জন জামিনে আছেন। ১৪ জন এখনও কারাগারে আছেন। অন্যদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।
আরও যেসব মামলায় সম্পত্তি ক্রোক হচ্ছে
সিআইডি বলছে, ২০২৩ সালের ২২ মার্চ টেকনাফ থানায় করা মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনের মামলায় শফিক আলম ওরফে শফিক, সহযোগী আসামি মনির আলম, মো. রফিক আলম ও আব্দুল গফুর। তারা সবাই মূল আসামির পরিবারের সদস্য। তাদের পাচারকৃত অর্থের পরিমাণ প্রায় ৪ কোটি টাকা। তার মধ্যে ১ কোটি ১০ লাখ টাকা মূল্যের তিনটি বাড়ি ও ২৯ দশমিক ৩৩ শতাংশ জমি ক্রোক-প্রক্রিয়ায় রয়েছে।
পাবনার আতাইকুলা থানায় ২০২৩ সালের ১৪ মার্চ মানি লন্ডারিং মামলায় আসামি শাহিন আলম ও সহযোগী আসামিদের বিষয়ে তদন্ত চলছে৷ তাদের পাচারকৃত অর্থের পরিমাণ প্রায় ৬ কোটি ২০ লাখ টাকা। এর মধ্যে ক্রোক-প্রক্রিয়াধীন সম্পদ হলো একটি বাড়ি ও ১৯২ দশতিক ৬৭ শতাংশ জমি, যার মূল্য ৬ কোটি ২০ লাখ টাকা। ক্রোকের আবেদন করা হয়েছে। ২০২০ সালের ২০ মার্চ কক্সবাজারের টেকনাফে মানি লন্ডারিং মামলায় অভিযুক্ত ইয়াবা গডফাদার নুরুল কবির। তার পাচারকৃত অর্থের পরিমাণ ১১ কোটি ৫ লাখ টাকা। ক্রোকের প্রক্রিয়াধীন সম্পদের পরিমাণ এএনবি ব্রিকস নামে একটি ইটভাটা, একটি ডুপ্লেক্স বাড়ি, পোল্ট্রি খামার, লবণ চাষের ব্যবসা এবং ৩৮টি দলিল মূলে মোট ১৫ দশমিক ৫৬৫৩ একর জমি, যার আনুমানিক মূল্য ৫ কোটি টাকা। ২০২১ সালের ২০ অক্টোবর টেকনাফের আরেক মানি লন্ডারিং মামলায় অভিযুক্ত মাদক গডফাদার সিদ্দিক আহমেদ। সিদ্দিক ও তার সহযোগীদের বিরুদ্ধে ইয়াবা কারবারের মাধ্যমে দেড় কোটি টাকা পাচারের সন্ধান পেয়েছে সিআইডি এবং ৪৮.৩৩ শতাংশ জমি ও ২০ লাখ টাকার একটি নির্মাণাধীন বাড়ি ক্রোকের প্রক্রিয়াধীন।
২০২৩ সালের ২২ মার্চ ঢাকার আদাবর থানায় মানি লন্ডারিং মামলার আসামি মাদক গডফাদার নুরুল ইসলাম। তার পাচারকৃত অর্থের পরিমাণ প্রায় ১৩ কোটি টাকা। তার চারটি বাড়ি, ৮৮ শতাংশ জমি, একটি গাড়ি ও স্বর্ণালংকার ক্রোকের প্রক্রিয়াধীন। গাজীপুরের টঙ্গী পূর্ব থানায় ২০২৩ সালের ৩০ অক্টোবর মানি লন্ডারিং মামলার আসামি মাদক গডফাদার পারুল। তার ১ কোটি ৫৭ লাখ টাকার জমি ও বাড়ি ক্রোকের প্রক্রিয়ায় রয়েছে। এ ছাড়া টেকনাফ থানায় ২০২০ সালের ৩ সেপ্টেম্বর মানি লন্ডারিং আইনে দায়ের করা মামলার আসামি ফজর আলীর প্রায় ১ কোটি ৮০ লাখ টাকার জমি ক্রোকের প্রক্রিয়াধীন বলে সিআইডি জানিয়েছে।