× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

ধানমন্ডি

একেকটা ভবন যেন রেস্তোরাঁর হাট

জামশেদ নাজিম

প্রকাশ : ০৩ মার্চ ২০২৪ ০৮:৫০ এএম

আপডেট : ০৩ মার্চ ২০২৪ ১০:১৯ এএম

বহুতল ভবনের পুরোটা জুড়ে নানান নামের রেস্টুরেন্ট। ছবিটি রাজধানীর ধানমন্ডির সাত মসজিদ রোড থেকে তোলা। ছবি : আরিফুল আমিন

বহুতল ভবনের পুরোটা জুড়ে নানান নামের রেস্টুরেন্ট। ছবিটি রাজধানীর ধানমন্ডির সাত মসজিদ রোড থেকে তোলা। ছবি : আরিফুল আমিন

রাজধানীর সীমান্ত স্কয়ার থেকে মোহাম্মদপুর থানা অভিমুখী প্রধান সড়কের দুই ধারে অসংখ্য উঁচু ভবন। একটু ভালো করে দেখলেই টের পাওয়া যায়, প্রায় প্রতিটি ভবনেই রয়েছে একাধিক রেস্তোরাঁ। কোনো কোনো ভবনে তো দোতলা থেকে ১৬ তলা পর্যন্ত রেস্তোরাঁ ছাড়া আর কিছু নেই। অথচ বেশিরভাগ ভবন নির্মাণের শুরুতে সেগুলোতে রেস্তোরাঁ করার কোনো পরিকল্পনা ছিল না। তাই এগুলোর ডিজাউন এবং নিরাপত্তা সুবিধাও রেস্তোরাঁ-ভবনের মতো নয়। সামান্য কোনো ভুল কিংবা অসাবধানতায় এসব ভবনে অগ্নিকাণ্ড ঘটলে অসংখ্য মানুষের মৃত্যু ঘটতে পারে বলে আশঙ্কা এসব রেস্তোরাঁ-সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীদের। 

অগ্নিঝুঁকি নিয়েই এসব ভবনে পছন্দের খাবার খাচ্ছে হাজার হাজার মানুষ। ভবনের নামিদামি মার্কেটে কেনাকাটাও করছে জ্বলন্ত চুলার পাশে দাঁড়িয়ে। স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা ও মার্কেট পরিচালনা কমিটির অসাধু সদস্যের সঙ্গে আঁতাত করে ভয়াবহ ঝুঁকির মধ্যেও অনায়াসে খাবার দোকানিরা ব্যবসা করে যাচ্ছেন। অভিযোগ রয়েছে, তাদের এভাবে ব্যবসা চালানোর সুযোগ করে দিচ্ছেন সিটি করপোরেশনের ট্রেড লাইসেন্স বিভাগ ও ফায়ার সার্ভিসের আঞ্চলিক পরিদর্শকরাই। ধানমন্ডি এলাকার একাধিক খাবার দোকানের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সঙ্গে কথা বলে এমন তথ্য মিলেছে।

বাংলাদেশ বডার গার্ডের (বিজিবি) সদর দপ্তরের ৪ নম্বর গেইট-সংলগ্ন এরিয়ার সীমান্ত স্কয়ার মার্কেট অন্যতম একটি কেনাবেচার কেন্দ্র ধানমন্ডি এলাকার। বিজিবি পরিচালিত এ মার্কেটে রয়েছে নামিদামি বিভিন্ন ব্র্যান্ডের দোকান। রয়েছে দেশীয় বুটিক শপসহ নানা পণ্যের দোকান। গতকাল শনিবার সরেজমিন মার্কেটটি ঘুরে দেখা যায়, এখানে মূলত ফুচকা ও চটপটি তৈরি করা হয়। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত জ্বলে ফুচকা ও চটপটির দোকানিদের চুলা। মার্কেটের সিঁড়ির গোড়ায় উড়ছে ধোঁয়া। সামান্য ভুলে এখানে যেকোনো সময় বড় ধরনের দুর্ঘটনার আশঙ্কা প্রকাশ করেন দোকানদার জুয়েল। 

তিনি বলেন, মার্কেট পরিচালনা কমিটির কিছু লোকজনের সহায়তায় এখানে ৮-১০টি অস্থায়ী দোকান সাজিয়ে একমাত্র সিঁড়িটির চারপাশ ঘিরে রাখা হয়েছে। কোনো একটা দোকান থেকে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটলেই পুরো মার্কেটের দোকান কর্মচারী ও ক্রেতারা আটকা পড়বে। একসময় এ দোকানগুলো মার্কেটের বাইরে সীমানাপ্রাচীর ঘেঁষে বসত। এখন একদম মার্কেটের সিঁড়ির গোড়াতেই বসানো হয়েছে। মার্কেটের দোতলায়ও রয়েছে রেস্টুরেন্ট। সেখানে বৈদ্যুতিক চুল্লি ও গ্যাস সিলিন্ডার দিয়ে রান্নাবান্না করা হচ্ছে। 

এ বিষয়ে বিজিবির জনসংযোগ কর্মকর্তা মো. শরীফুল ইসলামকে একাধিকবার কল করা হলেও তিনি রিসিভ না করে মেসেজ করতে বলেন। সীমান্ত স্কয়ারের রেস্টুরেন্ট বিষয়ে তার সঙ্গে কথা বলা দরকার তাই মেসেজ পাঠানো হলে তিনি আর কোনো উত্তর দেননি। 

একটি ভবনের দারোয়ান জুলফিকারের কাছ থেকে জানা যায়, আবাসিক এলাকা হিসেবে লিখিত বা পরিচিত হলেও ধানমন্ডির প্রধান সড়কের পাশের কমার্শিয়াল ভবনগুলো এখন মূলত খাওয়ার দোকানের দখলে। এসব ভবনে অধিকাংশ মানুষজনই আসে ঘোরাফেরা করতে, খাওয়া-দাওয়া ও আড্ডা দিতে। স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া ছাত্রছাত্রীদের যাতায়াত ও বসবাস থাকায় এসব রেস্তোরাঁ অধিকাংশ সময় থাকে জমজমাট।

কোনো বাণিজ্যিক বিপণিবিতান নেই কেবি স্কয়ারে

সরেজমিন দেখা যায়, সাত মসজিদ রোডের ৯/এ ধানমন্ডির মূল সড়কেই অবস্থান ১৪ তলাবিশিষ্ট কেবি স্কয়ার ভবনের। ২০১৩ সালে নির্মিত এই ভবন। শুরুতে ভবনটিতে কেবল কমার্শিয়াল দোকানপাটই ছিল। ২০১৫ সালে এখানে প্রথম একটি রেস্টুরেন্ট হয়। তারপর এই ভবন থেকে ব্যাংক, কম্পিউটার দোকানসহ কমার্শিয়াল সব প্রতিষ্ঠান চলে গেছে বিভিন্ন স্থানে। অন্যদিকে পুরো ভবনে জমে উঠেছে রেস্তোরাঁ-ব্যবসা। 

অনুসন্ধানে জানা গেছে, কেবি স্কয়ার ভবনে রেস্টুরেন্টের ব্যবসা জমজমাট করতে ভবনটির পেছনে বড় আকারের ৩০টির মতো গ্যাস সিলিন্ডার রেখে পাইপ দিয়ে ফ্লোরে ফ্লোরে সরবরাহের ব্যবস্থা করা হয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, কলাবাগান এলাকার একজন প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতা এই ভবনের দ্বিতীয় তলায় একটা সিসা বার পরিচালনা করেন। 

সরেজমিন দেখা যায়, ভবনের ১১ তলায় ‘দ্য ডার্ক-২’ রেস্টুরেন্টে স্মোকিং জোনে আলাদা কেবিন করে থাইগ্লাস দিয়ে ছোট ছোট রুম করা হয়েছে। ভবনটিতে অগ্নিকাণ্ড ঘটলে এখানে অবস্থানরত ভোক্তাদের কানে কোনো শব্দ, চিৎকার বা কথাবার্তা পৌঁছানোর কোনো সুযোগই নেই। অবশ্য ভবনের একটি প্রধান সিঁড়ির পাশে ফায়ার এক্সিট রয়েছে। দেয়ালে অগ্নিনির্বাপক বোর্ডের মধ্যে রয়েছে পানির লাইন। এই ভবন ও রেস্টুরেন্ট বিষয়ে কেউ কোনো কথা বলতে রাজি নন।

গাউছিয়া টুইন পিকে না যাওয়ার আহ্বান স্থপতির

কেবি স্কয়ার ভবনের একটু সামনেই ১৬ তলার আলিশান ভবন গাউছিয়া টুইন পিক। এই ভবনটির যাত্রা শুরু ব্যাংক, বীমাসহ বিভিন্ন কমার্শিয়াল ও করপোরেট অফিস হিসেবে ভাড়া দেওয়ার উদ্দেশে। কিন্তু বর্তমানে প্রথম ও দ্বিতীয় তলায় কয়েকটি কাপড়ের দোকান এবং শোরুম বাদে পুরো ১৬ তলা পর্যন্তই ব্যবহার হচ্ছে অন্তত দেড় ডজন রেস্টুরেন্ট হিসেবে। এর মধ্যে ছয়টি বড় বুফে লাউঞ্জ। এই ভবনের স্থপতি মুস্তাফা খালিদ পলাশ। সম্প্রতি তিনি সামাজিক মাধ্যম ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে সবার প্রতি ওই ভবনে না যাওয়ার অনুরোধ করেছেন। কারণ হিসেবে তিনি বলেছেন, সেখানে ন্যূনতম নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেই। এর নকশা ও অনুমোদন বাণিজ্যিক ভবন হিসেবে হলেও কার্যত বড় রকমের ব্যত্যয় ঘটিয়ে এটিকে বর্তমানে অগ্নিঝুঁকিপূর্ণ রেস্তোরাঁ ভবনে রূপান্তর করা হয়েছে।

সরেজমিন দেখা যায়, ভবনটি নির্মাণের সময় সেখানে অগ্নিনির্বাপণের সব রকম ব্যবস্থা নেওয়া হয়। তবে একটা ভবনে এতগুলো রেস্টুরেন্ট নির্মাণের কোনো পরিকল্পনা তখন ছিল না। কিন্তু আর্থিকভাবে লাভবান হতে বর্তমানে ভবনটির বিভিন্ন ফ্লোর রেস্টুরেন্ট কোম্পানি ও মালিকদের কাছে ভাড়া দেওয়া হয়েছে। প্রতিটি ফ্লোরে চলছে রান্নাবান্নার কাজ। বড় আকারের চুলার জন্য ভবনের পেছন দিকে রাখা হয়েছে সারি সারি গ্যাস সিলিন্ডার।

ভবনটির একটি রেস্টুরেন্টের ম্যানেজার বলেন, ‘বেইলি রোডের অগ্নিকাণ্ডের পর অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্রপাতি এনে এ ভবনের বিভিন্ন স্থানে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। কয়েকদিন আগেও ছিল না এসব। ফায়ার এক্সিট সিঁড়িও পরিষ্কার করা হয়েছে ইদানীং।’ এই ম্যানেজার বলেন, ধানমন্ডি এলাকায় যত রেস্টুরেন্ট আছে, সেগুলোর অধিকাংশই ফায়ার সার্ভিসের অনুমতি নিয়ে গড়ে উঠেছে। ছোট-বড় খাবারের দোকান থেকে ১০ হাজার থেকে লাখ টাকা পর্যন্ত হাতিয়ে নিয়েছে ফায়ার সার্ভিসের লোকজন। এছাড়া পরিদর্শনের জন্য এলেই তারা রেস্টুরেন্টগুলো থেকে বিশেষ সম্মানী পান। ফলে ফায়ার সার্ভিসের তদারককারীরাই অনেক সময় অগ্নিঝুঁকি থাকা অনেক রেস্টুরেন্টকে তালিকাভুক্ত করেন না। মাঝেমধ্যে দায়সারা নোটিস করা হলেও কার্যত কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয় না বলে দাবি করেন এই ম্যানেজার।

তবে এসব অভিযোগ ভিত্তিহীন মনে করেন ধানমন্ডি এলাকার পরিদর্শক গোলাম মোস্তফা। তিনি বলেন, রেস্টুরেন্ট থেকে কোনো সুবিধা নেওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। কোনো ভবনের কোথাও সমস্যা হলে আমরা সরাসরি মালিকের সঙ্গে কথা বলি এবং পরামর্শ দিয়ে আসি। নিয়মিত পরিদর্শন করে জনস্বার্থে অগ্নিঝুঁকি এড়ানোর লক্ষ্যে কাজ করি।

রেস্টুরেন্টের সাইনবোর্ডে ভরা ইম্পেরিয়াল আমিন আহমেদ সেন্টার

গাউছিয়া টুইন পিকের ঠিক উল্টো পাশে ইম্পেরিয়াল আমিন আহমেদ সেন্টার। এই ভবনের গায়ে রেস্টুরেন্টের সাইনবোর্ড ছাড়া কিছুই চোখে পড়ে না। ভবনের ১৩ তলায় ‘দ্য ফরেস্ট লাউঞ্জ’- যেটি নগরবাসীর অনেক প্রিয়। টিকটক ভিডিও ক্রিয়েটাররা সবসময় এখানে ভিড় করে থাকেন। এই রেস্টুরেন্টে যাওয়ার জন্য লিফটে মানুষজন দীর্ঘ লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে বলে জানিয়েছেন পাশের চা-দোকানদার শহিদ। তিনি এ ভবনে ক্যাফে রিও সাইনবোর্ড দেখিয়ে বলেন, এই রেস্টুরেন্টও বেশ জনপ্রিয়। শুক্র ও শনিবার শত শত মানুষ ভিড় করে এখানে খাওয়া-দাওয়ার জন্য। 

ভবনটিতে বিকালের পর থেকে ভিড় জমতে শুরু হয়। দুটি লিফট ছাড়া রেস্টুরেন্টে যাওয়া-আসার কোনো ব্যবস্থা নেই। নিরাপত্তার অজুহাতে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে ফায়ার এক্সিট ও সাধারণ সিঁড়ি। এখানে কখনও অগ্নিকাণ্ড ঘটলে সহসাই কেউ বের হতে পারবে না বলে জানিয়েছেন জুনায়েদ নামের এক ব্যক্তি। তিনি জানান, তার বাসা মোহাম্মাদপুর এলাকায়। ব্যবসায়িক মিটিং ও পরিবারের সদস্যদের নিয়ে বিভিন্ন সময় ধানমন্ডির রেস্টুরেন্টে আসেন তিনি। বেইলি রোডের অগ্নিকাণ্ডের পর তিনি ধানমন্ডির প্রতিটি রেস্টুরেন্টেই দেখতে পাচ্ছেন ‘নিরাপত্তার ঝুঁকি’।

শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা