শহিদুল ইসলাম রাজী
প্রকাশ : ০৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ১২:০৪ পিএম
আপডেট : ০৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ১৪:১৭ পিএম
‘আমারে মা মাফ করে দিও। আমি বিটিএসের কাছে যাই। আমি কোরিয়া যামু; আর আমি গেলে তোমাদের তো খুব ভালো হবে তাই না। এখন থেকে অনেক দূরে যামু। আর আমারে খোঁজার চেষ্টা করো না। আমি বিটিএসএর সদস্য জাংকুকে বিয়ে করব।’ ঘর থেকে পলানোর সময় মায়ের কাছে এভাবে চিঠি লিখে লাপাত্তা হয়েছে রাজধানীর খিলগাঁও মেরাদিয়া এলাকার স্থানীয় এক স্কুলের ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্রী ১৩ বছর বয়সি কিশোরী রিজুয়না রিজু। নিখোঁজ রিজু মেরাদিয়ার নয়াপাড়ায় পরিবারের সঙ্গে থাকত।
শুধু রিজুই নয়, একই দিনে বাসা ছেড়েছে তার দুই বান্ধবী রুবিনা আক্তার মিম ও জান্নাতুল আক্তার বর্ষা। তারা তিনজনই ১০ দিন ধরে নিখোঁজ। তাদের পরিবার বলছে, দক্ষিণ কোরিয়ার ব্যান্ড দল বিটিএসের ভক্ত ছিল ১৩ থেকে ১৪ বছর বয়সি এসব কিশারী। অবসরে তারা টেলিভিশন বা ইউটিউবে বিটিএসের গান দেখত। কেউ কেউ বলছেন, বিটিএসের অন্ধমোহে ঘর ছেড়েছে তারা। তবে পরিবারের অভিযোগ, তারা কোনো পাচারকারী দলের খপ্পরে পড়েছে। বিটিএসের নাম ব্যবহার করে অপরাধী চক্র তাদের কৌশলে ঘর থেকে বের করেছে। তবে পুলিশ বলছে, শুধু বিটিএস নয় এই কিশোরীরা টিকটক ও ফেসবুক রিলে তৈরি করত। ধারণা করা হচ্ছে, তারা টিকটক, ফেসবুককেন্দ্রিক চক্রের খপ্পরে পড়েছে।
সাম্প্রতিক সময়ে দেশে কোরিয়ান ব্যান্ড দল বিটিএসের নাচ ও গান শিশু, তরুণ ও কিশোর বয়সিদের কাছে বেশ জনপ্রিয়। কিন্তু বিটিএসের জন্য ঘর থেকে পালানোর ঘটনা এবারই প্রথম শোনা গেল। নিখোঁজ তিন কিশোরীর পরিবার জানিয়েছে, ২৯ জানুয়ারি দুপুর দেড়টার পর থেকে ওই তিন বান্ধবীর খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। এ ঘটনায় ওইদিনই খিলগাঁও থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করে তাদের পরিবার। তবে বুধবার রাতে এ খবর লেখা পর্যন্ত তাদের কোনো হদিস পায়নি পুলিশ। এই তিন কিশোরীর পরিবার নিম্নবিত্ত আয়ের মানুষ। বেশিরভাগ সময়ে তাদের বাবা-মা জীবিকার প্রয়োজনে থাকতেন ঘরের বাইরে। বিটিএস সম্পর্কে কোনো ধারণাও নেই তাদের। জানা গেছে, নিখোঁজ তিনজনই বাবা-মায়ের একমাত্র কন্যাসন্তান। ১০ দিন ধরে মেয়েদের কোনো খোঁজ না পেয়ে দিশেহারা তাদের বাবা-মা ও স্বজনরা। তাদের ধারণা, তিনজন কোনো গ্যাংয়ের খপ্পরে পড়েছে। তারা বেঁচে আছে কি না বিষয়টিও সংশয় তাদের। পুলিশ জানিয়েছে, নিখোঁজদের খোঁজে তদন্ত করছেন তারা।
ঘটনার দিন ওই তিন কিশোরীর রাস্তায় থাকা একটি সিসিটিভির ফুটেজ এসেছে প্রতিদিনের বাংলাদেশের কাছে। ফুটেজে দেখা যায়, ‘২৯ জানুয়ারি দুপুরের দিকে বাসার সামনে রাস্তায় অপেক্ষা করছে বর্ষা। কিছুক্ষণ পর একটি রিকশায় সেখানে আসে মিম ও রিজু। তারপর একই রিকশায় চলে যায় তারা।’
রিজুর মা হনুফা বেগম বলেন, ‘ঘটনার দিন দুপুর থেকে বিকাল হলেও ওদের কোনো খোঁজ পাইনি। এরপর শুনি তিনজনই ব্যাগ নিয়ে চলে গেছে। তারপর বিভিন্ন স্থানে খোঁজাখুঁজি করেও কোনো খবর পাইনি। শুধু চিঠিতে লিখে গেছে বিটিএসের কাছে যাই। ওদের কাকে যেন বিয়ে করবে। বিটিএস কী, কোথায় থাকে, কী করে কিছুই জানি না। বিটিএসের কোনো ঠিকানাও নাই। কোনো ফোন নম্বরও নাই। কোথায় খুঁজব তাদের।’
রিজুর বাবা একটি ওষুধ কোম্পানিতে বিক্রয় প্রতিনিধি হিসেবে কর্মরত। আর মা গৃহিণী। রিজুর বাবা আসাদুজ্জামান প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, ‘আমার এক মেয়ে এক ছেলে। মেয়েটা বড়। প্রায় ৭ থেকে ৮ বছর ধরে এই এলাকায় ভাড়া থাকি। আমার স্ত্রী সব সময় ঘরে থাকে। কারও সঙ্গে আমাদের শত্রুতা নেই। কোনো মোবাইল নিয়ে যায়নি। শুধু সিম ও মেমোরি কার্ড মোবাইল থেকে আলাদা করে রেখে গেছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘গ্রামের বাড়িতে ঘর তোলার জন্য কিছু টাকা বাসায় রাখা ছিল; সেই টাকা আর ওর মায়ের কিছু গহনা নিয়ে গেছে।’ তিনি বলেন, যে চিঠিটা লিখে গেছে, তাতে ধারণা করছি হয়তো বিটিএস নামে কোনো অপরাধী চক্রের কাছে চলে গেছে তারা। মেয়ের চিন্তায় তার মা অসুস্থ হয়ে পড়েছে। এখন মেয়েটা আমার পৃথিবীতে আছে না মরে গেছে, কিছুই তো জানতে পারছি না।’
নিখোঁজ বর্ষা ও মিমের বাবা রিজুদের পাশের বাসায়। তাদেরও কোনো খোঁজ নেই ২৯ জানুয়ারি দুপুরের পর থেকে। বর্ষার মা গৃহপরিচারিকার কাজ করেন। বাবা রিকশাচালক। বর্ষার মা হোসনে আরা বলেন, ‘সব সময় টিভিতে এই বিটিএস দেখত। আমরা যদি কোনো সময় রিমোট চাইতাম, দিত না। অনেক রাগ করত। সারাক্ষণ বাড়ির মধ্যেই থাকত। বাড়ির বাইরে যাইত না। ঘরে বসে টিভি দেখত। আর কোনো চ্যানেল দেখত না। খালি ওই চ্যানেলটাই দেখত। অনেক সময় রাগ হয়ে বলতাম, এগুলো কী দেখো, এগুলো কি দেখার জিনিস? বলত, এইটা আমার ভালো লাগে।’
তিনি বলেন, ‘আমার ছোট ছেলে শুনছে বর্ষা বলছে, আমরা এক দিন হলেও ওই (কোরিয়া) দেশে যাব। আমার ছেলে বলত, হ, তোরা ওই দেশে যাবি, অনেক টাকা লাগব ওদের কাছে যেতে। বলত মাটির ব্যাংকে টাকা জমিয়ে হলেও ওদের কাছে যাব। এখন আমার মেয়ে কোথায় আছে, কীভাবে আছে। ও কোন জায়গায় ঘুমায়, কী খায় কিছুই কইতে পারি না।’
বর্ষার বাবা বশির বলেন, ‘আমি রিকশা চালাই। প্রতিদিনের মতো বের হওয়ার সময় মেয়েকে বাসায় দেখে গেছি। দুপুরের পর স্ত্রী ফোন দিয়ে জানায় বর্ষার খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। প্রথমে বুঝছিলাম হয়তো কোনো ছেলের সঙ্গে চলে গেছে। কিন্তু পরে শুনি ওরা তিন বান্ধবী একসঙ্গে চলে গেছে। এরপর বাসায় এসে তিন পরিবার মিলে থানায় জিডি করি।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমরা গরিব মানুষ। দিন আনি দিন খাই। না পারমু টাকা-পয়সা দিয়ে লড়তে। মূর্খ মানুষ। কোথায় যামু কী করমু জানি না।’
নিখোঁজ মীমের বাবা রুবেল মিয়া বলেন, ‘আমাদের সঙ্গে এলাকায় কারও শত্রুতা নাই। মেয়েরা কোনো গ্যাংয়ের খপ্পরে পড়েছে। বিটিএস নামধারী কোনো চক্রের প্রলোভনে পড়েছে। তারাই মেয়েকে অপহরণ করেছে।’
মীমের মা মুক্তা বেগম বলেন, ‘সব সময় টিভির নেশা ছিল। হাত থেকে রিমোট নিলে রাগ করে খাওয়া-দাওয়া করত না। শুধু সারা দিন বিটিএসের চ্যানেল দেখত। ৯ দিন চলে গেছে, মনে হচ্ছে ৯ বছর ধরে চলে গেছে। আমার মেয়েটাকে খুঁজে এনে দিবেন। একজন মায়ের কাছে সন্তান হারানোর কতটা কষ্টের, সেটা শুধু একজন মা-ই জানে।’
তিন কিশোরীকে উদ্ধারের বিষয়ে জানতে চাইলে খিলগাঁও থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সালাউদ্দিন মিয়া প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, ‘নিখোঁজ তিন কিশোরীর বিষয়ে এখন পর্যন্ত কোনো আপডেট নেই। আমরা কাজ করছি। পাশাপাশি র্যাব, ডিবিও তাদের উদ্ধারে কাজ করছে। কিন্তু কোনো ক্লু মিলছে না।’
ওসি বলেন, এক কিশোরী চিঠিতে লিখে গেছে, ‘বিটিএসএর সদস্য জাংকুকে বিয়ে করবে। এটা অসম্ভব। এই কিশোরীরা টিকটক করে। যেহেতু টিকটক করে এ ধরনের কোনো অপরাধী চক্রের কবলে পড়তে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। বাসা থেকে যাওয়ার সময় তারা দুই থেকে আড়াই লাখ টাকা নিয়ে গেছে। সবকিছু মিলিয়ে মনে হচ্ছে, তারা কোথাও আছে, টিকটক করে বেড়াচ্ছে। দেখা গেল টাকা-পয়সা খরচ হয়ে গেলে আবার ফিরে আসবে।’ তিনি বলেন, ‘আমরা নতুন করে কক্সবাজার, সেন্টমার্টিন ও সিলেটসহ বিভিন্ন জায়গায় খোঁজ নিচ্ছি।’