অমর একুশে বইমেলা
সেলিম আহমেদ
প্রকাশ : ০১ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ২১:৫৫ পিএম
আপডেট : ০১ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ২২:১৯ পিএম
অমর একুশে বইমেলার প্রথম দিনে পাঠকদের পদচারণায় মুখর ছিল বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণ। প্রবা ফটো
আকাশের মন খারাপ করা মাঘের বিকাল। যেকোনো সময় বৃষ্টি আসতে পারে। কিন্তু তাতে পাত্তা দেওয়ার সময় কই বইপ্রেমীদের! কারণ দীর্ঘ ১১ মাসের অপেক্ষা শেষে শুরু হয়েছে কাঙ্ক্ষিত অমর একুশে বইমেলা। তাই বিকালের আগে থেকেই জড়ো হচ্ছিল তারা। মেলার দুয়ার খুলে দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই তাদের পদচারণায় মুখর হয়ে ওঠে মেলা প্রাঙ্গণ। কিন্তু সন্ধ্যা নামতেই পাঠকদের আনন্দ থামাতে ধেয়ে আসে বৃষ্টি।
তবে মুষলধারে বৃষ্টি শুরুর আগে বইপ্রেমীদের পদচারণা ছিল চোখে পড়ার মতো। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি প্রাঙ্গণ থেকে দোয়েল চত্বর—সবখানেই ছিল উৎসবের আবহ। গোটা ফেব্রুয়ারি মাসব্যাপী বাঙালির প্রাণের এ মেলা মুখরিত থাকবে পাঠক, লেখক আর প্রকাশকদের চলাচলে। ছুটির দিন ছাড়া প্রতিদিন বিকাল ৩টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত মেলা চলবে। ছুটির দিন বেলা ১১টা থেকে রাত ৯টা এবং ২১ ফেব্রুয়ারি সকাল আটটা থেকে রাত সাড়ে ৮টা পর্যন্ত মেলা চলবে।
বৃহস্পতিবার (১ ফেব্রুয়ারি) বেলা ৩টায় মাসব্যাপী বইমেলার উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে মোট ২১ বার এবং টানা ১৬ বারের মতো মেলার উদ্বোধন করলেন তিনি। সরকারপ্রধান হিসেবে অন্য কেউ আর এতবার বইমেলার উদ্বোধন করেননি। বইমেলা উদ্বোধন করে বিকাল ৫টার দিকে প্রধানমন্ত্রী মেলা প্রাঙ্গণ ত্যাগের পর টিএসসি ও দোয়েল চত্বরে অপেক্ষমাণ বইপ্রেমীদের মেলায় প্রবেশ করতে দেওয়া হয়। এ সময় দর্শনার্থীদের ঢল নামে সেখানে।
এখনও অসম্পূর্ণ অনেক স্টলের কাজ
এদিকে অনেকটা প্রস্তুতি ছাড়াই শুরু হয়েছে এবারের বইমেলা। প্রথম দিন বন্ধ ছিল বলতে গেলে শতাধিক স্টল। আবার অধিকাংশ স্টলেই শেষ হয়নি গোছানোর কাজ। কোনো কোনো স্টলে এখনও চলছে সাজসজ্জার কাজ। ছাপা শেষ করে সব বই এখনও স্টলে তুলতে পারেননি প্রায় সব প্রকাশকরা। অন্যদিকে মেলার মাঠে ইট বিছানো, পানি ছিটানো, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতাসহ সব কাজ শেষ করতে পারেনি বাংলা একাডেমিও।
প্রকাশকরা বলছেন, এবার স্টল বরাদ্দ দেরিতে হওয়ায় সব কাজ শেষ করা যায়নি। এ বছর ২৩ জানুয়ারি লটারির মাধ্যমে স্টল ও প্যাভিলিয়ন বরাদ্দ দেওয়া হয়। এরপর স্টলের যাবতীয় কাজের জন্য প্রকাশকরা সময় পেয়েছে মাত্র এক সপ্তাহ।
মেলা প্রাঙ্গণ পুরোপুরি প্রস্তুত না হওয়া প্রসঙ্গে অন্বেষা প্রকাশনীর প্রকাশক শাহাদাত হোসেন বলেন, ‘আমরা এবার স্টল বরাদ্দ পেয়েছি অনেক দেরিতে। তাই আমার স্টলের সাজসজ্জার কাজ সব শেষ করতে পারেনি। আবার বুধবার রাতে বৃষ্টি হওয়ায় অনেক কাজ করা যায়নি।’
বৃষ্টিতে নষ্ট হয়েছে বই
এদিকে সন্ধ্যার বৃষ্টিতে বেশ ভোগান্তি পোহাতে হয়েছে মেলায় আগত মানুষদের। মেলার মাঠে ইট না বিছানোর ফলে পুরো মাঠ হয়ে ওঠে কর্দমাক্ত। পর্যাপ্ত ছাউনি না থাকায় বৃষ্টিতে ভিজতে হয়েছে অনেক পাঠককে। নষ্ট হয়েছে অনেক স্টলের বই।
ঐতিহ্য প্রকাশনির স্টল ব্যবস্থাপক আমজাদ হোসেন কাজল বলেন, রশীদ করিম রচনাবলি দুই সেট, সৈয়দ শামসুল হক রচনাবলি দুই সেট, রবীন্দ্র রচনাবলি দুই সেটসহ শতাধিক বই নষ্ট হয়েছে তাদের।
দিব্য প্রকাশের স্টল ব্যবস্থাপক সোহাগ হোসেন বলেন, আমাদের প্রকাশনির দেড় শতাধিক বই নষ্ট হয়েছে।
বাংলাদেশ পুস্তক, প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতির সভাপতি আরিফ হোসেন ছোটন বলেন, ‘বৃষ্টিতে মেলার মাঠ কর্দমাক্ত হয়েছে আমরাও দেখেছি। কাল বিষয়টি বাংলা একাডেমিকে জানাব। বলব, তারা যেন ইট বিছানোর কাজ শেষ করে। মাঠের গর্ত ও নিচু এলাকায় যেন বালু ফেলার ব্যবস্থা করে।’
যা বলছেন প্রকাশকরা
মেলার প্রথম দিনেই বইপ্রেমীদের ঢল নামায়, মেট্রোরেল চালু হওয়ায় ও রাজনৈতিক পরিবেশ ভালো থাকায় অতীতের রেকর্ড ভেঙে এবার বই বিক্রি ভালো হবে বলে মনে করছেন প্রকাশকরা।
দ্য জার্নিম্যান বুকসের প্রকাশক কবি তারিক সুজাত বলেন, ‘মেট্রোরেলের কারণে যাতায়াত সহজ হওয়ায় বইমেলায় পাঠক সমাগম হবে। তবে এই পাঠকের ভিড়ে কারা যে প্রকৃত পাঠক, সেটি আসলে বুঝে ওঠা মুশকিল। দেখা যাবে, বিশেষ দিনগুলোতে বইয়ের প্রকৃত পাঠকদের তাদের কাঙ্ক্ষিত বইটি সংগ্রহ করতে বেগ পেতে হবে।’
পাইরেসিমুক্ত বইমেলার প্রত্যাশা করছেন মেলা পরিচালনা কমিটির সদস্য ও আগামী প্রকাশনির প্রকাশক ওসমান গণি। তিনি বলেন, ‘বইমেলার উদ্দেশ্য যেন সফল হয় সেটাই আমার প্রধান চাওয়া। বইমেলা যেন হয় বাংলাদেশি লেখকদের প্রকাশিত বইয়ের পৃষ্ঠপোষক। এই মেলা অন্যসব মেলা থেকে আলাদা। এখানে আমরা কোনো পাইরেসি বই দেখতে চাই না।‘
যা বলছেন দর্শনার্থী লেখকরা
প্রথম দিনেই বইমেলায় ঘুরতে আসা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মজীবী নিশাত বিজয় বলেন, ‘কাজ শেষ করে বাঙালির প্রাণের মেলা বইমেলা ঘুরতে এসেছি। আজ বই কিনিনি। তবে বিভিন্ন স্টল ঘুরে বই দেখলাম। দুই-চার দিন পরে আরও নতুন বই আসার পর থেকে বই কেনা শুরু করব।’
অনেক লেখকও ছিলেন মেলায়। এর মধ্যে একজন দেশের প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গবেষক ও সাহিত্যিক মুনতাসীর মামুন। তিনি বলেন, ‘বইমেলা হচ্ছে সাংস্কৃতিক ঈদ। প্রচুর মানুষ আসবে এবারের বইমেলায়। তারাও সংস্কৃতির সঙ্গে যুক্ত হবে। দ্বিতীয়ত, মেট্রোরেলের কারণে এবার বইমেলায় দর্শনার্থীর সংখ্যা বাড়বে। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও ভালো আবহাওয়ার কারণেও আসবে অনেকে।’
তরুণদের জন্য পরামর্শ কী—এমন প্রশ্নের জবাবে মুনতাসীর মামুন বলেন, ‘সবাই একটি করে বই কিনলে বইমেলার সব বই বিক্রি হবে। সাংস্কৃতিক জিডিপি না বাড়লে দেশের সার্বিক স্থিতিশীলতা আসবে না।’
শুক্রবারের আয়োজন
শুক্রবার, বইমেলার প্রথম শিশু প্রহর। ছুটির দিন হিসেবে বইমেলার দুয়ার খুলবে বেলা ১১টায়। মেলা চলবে টানা রাত ৯টা পর্যন্ত। বেলা ১১টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত 'শিশুপ্রহর। ওই সময় টুকটুকি, হালুমসহ সিসিমপুরের সঙ্গে নাচ ও গানে মেতে উঠবে শিশুরা। প্রথম ছুটির দিনে ব্যাপক পাঠক সমাগম হওয়ার প্রত্যাশাও রয়েছে প্রকাশকদের।
এদিকে বিকাল ৪টায় বাংলা একাডেমির মূল মঞ্চে অনুষ্ঠিত হবে ‘দ্বিশত জন্মবার্ষিকী : শ্রদ্ধাঞ্জলি : মাইকেল মধুসূদন দত্ত’। এতে মূল প্রবন্ধ পাঠ করবেন রফিকউল্লাহ খান। বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক কবি মুহম্মদ নূরুল হুদার সভাপতিত্বে আলোচক হিসেবে থাকবেন খসরু পারভেজ ও হোসনে আরা। এ ছাড়াও মূল মঞ্চে রয়েছে কবিকণ্ঠে কবিতাপাঠ, কবিতা আবৃত্তি ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।