তেজগাঁও মোল্লাবাড়ি বস্তি
সাইফ বাবলু
প্রকাশ : ১৫ জানুয়ারি ২০২৪ ০৯:১০ এএম
আপডেট : ১৫ জানুয়ারি ২০২৪ ১০:৪৮ এএম
আগুনে বসতঘর পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। রেললাইনের পাশে খোলা আকাশের নিচে ত্রিপল লাগিয়ে পরিবার-পরিজন নিয়ে রাতযাপন করছেন বস্তির বাসিন্দারা। রবিবার সকালে রাজধানীর তেজগাঁওয়ের মোল্লা বাড়ি এলাকায়। প্রবা ফটো
কনকনে ঠান্ডা। রেললাইনের আশপাশে শোরগোল করছে আগুনে পুড়ে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষজন। আগুনে দগ্ধ তিন বছরের শিশু নজরুলকে কোলে নিয়ে দাদি ইয়ারুন নেছা বসে আছেন একটি ছোট কাঠের চৌকিতে। ওদিকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আইসিইউতে মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছেন নজরুলের অগ্নিদগ্ধ মা নাজমা। নজরুলও ছিল শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে। কিন্তু গতকাল রবিবার (১৪ জানুয়ারি) সেখান থেকে তাকে চলে আসতে হয়েছে দাদি ইয়ারুনের কাছে। টাকা-পয়সা না থাকায় তাকে সেখানে রাখতে পারেনি স্বজনরা। ওদিকে মা নাজমার চিকিৎসায় এক দিনেই চলে গেছে তাদের ৩০ হাজার টাকা। অবস্থাও অনেক সংকটজনক তার। কেউ না কেউ নিশ্চয় সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেবে এই আশায় আছেন ইয়ারুন নেছা।
শুধু ইয়ারুন নেছার পরিবারই নয়, আগুনে সব হারানো মোল্লাবাড়ি বস্তির বাসিন্দারা এখন তীর্থের কাকের মতোই তাকিয়ে আছে একটু সাহায্যের জন্য। আগুন লাগার পর একটি করে কম্বল আর এক প্লেট খিচুড়ি ছাড়া তাদের ভাগ্যে আর কিছুই জোটেনি গত দুই দিনে।
কথা হয় ইয়ারুন নেছার সঙ্গে। বললেন, নাতিকে চিকিৎসা করাব, টাকা কই পাই? চিকিৎসা করাতে টাকা লাগে না? এতদিন ধরে কাজকর্ম করে খেয়ে না-খেয়ে লাখখানেক টাকা জোগাড় করেছিলাম দেশের বাড়িতে ঘর তুলব বলে। কিন্তু সর্বনাশা আগুন তাও পুড়িয়ে ফেলেছে। এদিকে মেয়ে আইসিইউতে। তার পেছনে এর মধ্যেই গেছে তিরিশ হাজার টাকা। নাতিকে কোলে করে সারা রাত বার্ন হাসপাতালের সিঁড়িতে বসেছিলাম। কী আর করব! সকালে পোড়া বস্তিতেই চলে এসেছি।
ইয়ারুন নেছা জানালেন, আগুন লাগার পর এক কাপড়ে বেরিয়ে এসেছেন। ছেলের বউ পুড়েছে। নাতির মুখ আর হাত-পা পুড়েছে। পাঁচজনের জন্য একটি মাত্র কম্বল পেয়েছি। এখন চিন্তা করছি, কোথায় যাব, কী করব।
তীব্র শীতেও খোলা আকাশের নিচে
সরেজমিনে দেখা গেছে, শৈত্যপ্রবাহে বিপর্যস্ত অগ্নিদগ্ধ মোল্লাবাড়ি বস্তির বাসিন্দারা আশ্রয় নিয়েছে রেললাইনের আশপাশে খোলা আকাশের নিচে। যে যেমনভাবে পারে রাত কাটাচ্ছে। তাদের মধ্যে কিছু কম্বল বিতরণ করা হলেও তা পর্যাপ্ত নয়। কাউকে দেখলেই ক্ষতিগ্রস্তরা এগিয়ে আসছে নাম লেখাতে। তাদের ধারণা, নাম লেখাতে পারলে কিছু সহযোগিতা পাওয়া যাবে।
ইতোমধ্যে বস্তি এলাকা থেকে পোড়া টিন সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। পুরো ডোবাটিতে এখন কোনো স্থাপনা নেই। কে কোথায় মাথা গুঁজবে, তা নিয়ে এখন দুশ্চিন্তায় পড়ে গেছে বস্তিবাসীরা।
আগুনে পুড়েছে মাছবাজারের শ্রমিক জাকিরের সবকিছু। এক বছরের জন্য পরিচিত এক ব্যক্তির কাছ থেকে তিনি ব্যাংকে থাকা ডিপোজিট পেনশন স্কিমের (ডিপিএস) বিপরীতে আড়াই লাখ টাকা ঋণ নিয়েছিলেন। সেই টাকা দিয়ে নরসিংদীর রায়পুরা রাধানগর ইউনিয়নে ড্রামের বাড়িতে ঘর তোলার কথা ছিল তার। গত শনিবার সকালে গ্রামের বাড়িতে টাকা পাঠানোর কথা ছিল। অথচ ওই দিন ভোররাতে আগুন লেগে পুড়ে গেছে সব টাকা। এখন প্রতি মাসে ১০ হাজার টাকা সুদ দেওয়ার দুশ্চিন্তা পেয়ে বসেছে জাকিরকে।
জাকির জানালেন, অগ্নিদগ্ধ হয়ে আইসিউইতে থাকা নাজমা বেগম তার শ্যালক ফারুকের স্ত্রী। স্ত্রী নাজমা আর ছেলে নজরুলকে বাঁচানোর জন্য নিঃস্ব ফারুক এখন উদ্দেশ্যহীনভাবে উদ্ভ্রান্তের মতো ছুটোছুটি করছেন।
সাহায্য মিলছে না
আগুনে সঞ্চয় হারানো আব্দুল করিম মোল্লাবাড়ি বস্তিতে ইলিয়াস মোল্লার ঘরে ভাড়া থাকতেন। সব হারানো করিমের চোখ বেয়ে এখন মনের অজান্তেই অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে। গতকাল বেলা ৩টায় করিম যখন কাঁদছেন সব হারানোর কষ্টে, তখন বস্তির ক্ষয়ক্ষতি দেখতে আসেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল। এ প্রসঙ্গে আব্দুল করিম বলেন, ‘অনেকেই এসেছেন, তালিকা করেছেন। কিন্তু আমাদের কাছে এখনও কিছু আসেনি। এখন সরকার আমাদের থাকার কোনো ব্যবস্থা করে দিতে পারলে ভালো হয়। এভাবে তো আর থাকা যায় না।’
একই অভিযোগ করলেন অগ্নিকাণ্ডের কারণে নিঃস্ব হয়ে পড়া মৌসুমী বেগম। মৌসুমীর স্বামী আব্দুল হামিদ কাজ করেন কারওয়ান বাজারে। আগুনে তার সবকিছুই পুড়ে গেছে। ছোট দুই শিশুকে নিয়ে গত শনিবার সকাল থেকে গতকাল রবিবার বিকালে এই রিপোর্ট লেখা তিনি উদ্বাস্তু হয়ে ঘোরাফেরা করছেন। পরিবারের মোট সদস্য ৪, অথচ কম্বল পেয়েছেন মাত্র একটি। মৌসুমি বলেন, ‘আমাদের নাম নেওয়া হলেও কোনো সাহায্য জোটেনি। বাড়িতে ঋণ পরিশোধের জন্য মাছ কাটাকাটি করে ২০ হাজার টাকা জমিয়েছিলাম। সেই টাকাও আগুনে পুড়েছে।’
মৌসুমি বেগমের মতো আব্দুল হাই, রোকেয়া বেগম, সিরাজুল ইসলাম, জানু বেগম ও মো. ইলিয়াসসহ অনেকেই জানালেন, ক্ষতিগ্রস্তরা এখনও তেমন কোনো সহযোগিতা পাননি। দুয়েকজনের উদ্যোগে এক বেলা করে খাবার দেওয়া হয়েছে। এটাই এখন অনেক বড় সান্ত্বনা তাদের।
ক্ষতিগ্রস্তদের সাহায্য অন্যদের দেওয়ার অভিযোগ
ক্ষতিগ্রস্তদের অভিযোগ, সাহায্য করার জন্য যারা এগিয়ে এসেছিলেন, স্থানীয় নেতারা ক্ষতিগ্রস্তদের তাদের কাছে যেতে দেননি। নেতারা বলেছেন, ‘আমরা সবার তালিকা করে সহযোগিতা করব।’ কিন্তু এখন পর্যন্ত তাদের পক্ষ থেকেও সহযোগিতার উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। এমনকি বিশেষ উদ্যোগে পরিবারপ্রতি একটি করে কম্বল দেওয়ার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা থাকলেও সেটি সবাই পাননি।
ক্ষতিগ্রস্তদের অভিযোগ, অন্য এলাকার লোকজন এসে কম্বল নিয়ে গেছে। তারা জানান, মজিবর নামে এক নেতা তালিকা করেছে। কিন্তু তালিকাভুক্ত কাউকে সহযোগিতা করা হয়নি। বরং অভিযুক্ত মজিবর আগুনে ক্ষতি হয়নি এবং বস্তিতে থাকেন না এমন লোকজনকে ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য আসা কম্বল দিয়েছেন। আরও কয়েকজন নেতাও সাহায্য-সহযোগিতার তদারকি করছেন। কিন্তু প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্তরা কোনো সহযোগিতা পাচ্ছে না।
আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত মো. মুছা জানান, তিনি বস্তির দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে ইলিয়াস মোল্লার ঘরে ভাড়া থাকতেন। ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকায় তার নাম গেলেও তিনি কিছুই পাননি।
পুনর্বাসন করবে সরকার
গতকাল রবিবার বেলা ৩টায় পুড়ে যাওয়া মোল্লাবাড়ি বস্তি দেখতে যান স্থানীয় সংসদ সদস্য ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল। তিনি সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘আগুনে যারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তাদের পুনর্বাসনে সরকার উদ্যোগ নেবে। স্থানীয় কাউন্সিলরের মাধ্যমে একটি তালিকা তৈরি করা হয়েছে। সেই তালিকা অনুযায়ী ক্ষতিগ্রস্তদের সহযোগিতা এবং পুনর্বাসনের উদ্যোগ নেওয়া হবে।’
উল্লেখ্য, গত শনিবার ভোরে তেজগাঁও মোল্লাবাড়ি বস্তিতে ভয়াবহ আগুনে পুড়ে বস্তিবাসী শারমিন ও তার শিশুসন্তান নাফিসের মৃত্যু ঘটে। পুড়ে ছাই হয়ে যায় তিন শতাধিক ঘর। আগুনে দগ্ধ হয় আরও কয়েকজন। ঘটনার তদন্তে ফায়ার সার্ভিস পাঁচ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে।