ফারহানা বহ্নি
প্রকাশ : ০৬ জানুয়ারি ২০২৪ ১২:১৯ পিএম
ভোটের দিন নানা কারণে নিজ নির্বাচনী এলাকায় থাকতে পারছেন না অনেকে। এসব ভোটারের মধ্যে রয়েছেন প্রায় এক কোটি প্রবাসী, নির্বাচনী দায়িত্বে নিয়োজিত ব্যক্তি, কারাবন্দি এবং অসুস্থ ও চলৎশক্তিহীন প্রবীণ ব্যক্তি। ফলে ধারণা করা হচ্ছে, এবার এমন ভোটারের সংখ্যা প্রায় দেড় কোটি। তা ছাড়া দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে পোস্টাল ব্যালটের মাধ্যমে ভোট দেওয়ার সুযোগ থাকলেও ভোটারদের কাছ থেকে এ বিষয়ে তেমন সাড়া মেলেনি।
এমনই একজন রংপুরের বাসিন্দা দুলাল মিয়া পেশায় রিকশাচালক। ভোট দিতে যাবেন কি না এ প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘ভোটটা দেব কীভাবে, যাইতে আইতে যে ভাড়া লাগব এইডি দেবে কে?’ রিকশা চালাতে চালাতে বলছিলেন, ‘সকালে নাশতা করতে পারিনি, মেয়ে অসুস্থ। টাকাও নেই। নিজে খাব, মেয়েরে বাঁচাব নাকি ভোট দেব?’
সবজি সাজিয়ে ভ্যান নিয়ে প্রতিদিনের মতো কাজে এসেছেন মো. আলামিন। তবে গাইবান্ধার বাসিন্দা আলামিনের ভোট দেওয়ার ইচ্ছা থাকলেও খালি হাতে বাড়ি যেতে চান না। তিনি বলেন, ‘হাতে কিছু টাকা হলে বাড়ি যাব। না হলে তো যেতে পারব না। বাড়িতে গেলে সবার আশা থাকে কিছু নিয়ে যাব। ভাড়ার খরচ মিলিয়ে হয় না।’
ঢাকার মোট জনসংখ্যার মাত্র ৫৫ শতাংশ স্থানীয় ভোটার আর বাকি ৪৫ শতাংশই ঢাকার বাইরের। যাদের ভোট নানা কারণে অনিশ্চয়তায় রয়েছে। সর্বশেষ জনশুমারি অনুযায়ী ঢাকার জনসংখ্যা ১ কোটি ২ লাখ ৪৯ হাজার ৮৮২ জন। এর মধ্যে ঢাকা দক্ষিণ সিটিতে রয়েছে ৪২ লাখ ৯৯ হাজার ৩৪৫ জন আর উত্তরে ৫৯ লাখ ৫০ হাজার ৫৩৭ জন। এ জনসংখ্যার প্রায় ৫৫ শতাংশ ভোটার অর্থাৎ দুই সিটি মিলিয়ে নির্বাচন কমিশনের হিসাব অনুযায়ী ঢাকা মহানগরীর ১৫টি আসনে ভোটার রয়েছে (যাদের বয়স ১৮ বছর ও তার বেশি) ৫৫ লাখ ৬০ হাজারেরও বেশি।
ভোট দিতে দুই দিনের জন্য বাড়ি গেলে সবকিছুই অচল হয়ে যাবে বলে মনে করেন মো. মঞ্জু হোসেন। পেশায় বাইক রাইডার মঞ্জুর সংসারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। তিনি বলেন, ‘কষ্ট করে যাব। দুই দিন ইনকাম বন্ধ থাকবে। সংসারের খরচ চালাতে হিমশিম খাব। কিন্তু এত কষ্ট করেও গিয়ে ভোটটা দেব কাকে?’
অনেকেই আবার হালকাভাবে নিচ্ছেন নির্বাচনকে। ভোট দিতে গ্রামে যাচ্ছেন কি না এমন প্রশ্নের জবাবে সিএনজিচালিত অটোরিকশাচালক রাশেদুল ইসলাম পাল্টা প্রশ্ন করলেন, ‘ভোট আছেনি, ভোট কি অইব?’ তার সঙ্গে কথা হচ্ছিল চলতি পথে। রাশেদুলের বাড়ি গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ উপজেলার শ্রীপুর ইউনিয়নের ধর্মপুর গ্রামে। এটি গাইবান্ধা-১ আসনের মধ্যে পড়ে। তিনি বলছিলেন, ‘লিটনের বইন জিতব। জাতীয় পার্টির ব্যারিস্টার শামীম ভালা লোক।’
রাশেদুল ইসলাম লিটনের বোন বলতে আফরোজা বারীর কথা বোঝাচ্ছিলেন। ওখানে জাতীয় পার্টির প্রার্থী শামীম হায়দার পাটোয়ারী। সুন্দরগঞ্জের বাসিন্দা রাশেদুল ইসলাম নির্বাচন নিয়ে এতটাই অনাগ্রহী যে তার জানা নেই যে আওয়ামী লীগ ২৬ আসনে জাতীয় পার্টিকে সমর্থন করে নিজেদের প্রার্থী সরিয়ে নিয়েছে, গাইবান্ধা-১ সেগুলোর একটি।
নিজেকে জাতীয় পার্টির একজন সমর্থক পরিচয় দিলেও সিএনজিচালক রাশেদুলের জাতীয় পার্টি নিয়েও সমালোচনা করে তিনি বলেন, ‘শামীম জিতলেও কী লাভ, সেও তো সরকারি দলের লোক। জাতীয় পার্টি তো এখন সরকারের বি-টিম। কাদের সাহেব (জিএম কাদের) চেষ্টা করছিল একটু আলাদা অইতে। পরে ভয় পাইছে।’
ভোট না দিলেও তিনি যে প্রার্থীকে ভোট দিতে চান তিনিই জিতবেন বলে মনে করেন ভৈরবের বাসিন্দা বাদাম বিক্রেতা মো. মহরম মিয়া। তিনি কিশোরগঞ্জ-৬ আসনের বাসিন্দা। কুলিয়াচর ও ভৈরব উপজেলা নিয়ে এই আসনে নৌকার প্রার্থী নাজমুল হাসান পাপনকে টক্কর দেওয়ার মতো তেমন কেউ নেই বলে মনে করেন তিনি। তাই তিনি কষ্ট করে ভোট দিতে না গেলেও চলবে।
হাসতে হাসতে তিনি বলেন, ‘বাকি প্রার্থীদের কেউ তেমন চেনে না। সেই অর্থে কোনো প্রতিদ্বন্দ্বিতা নেই। ভোটটা না দিতে গেলেও চলব।’
নিজের ভোট দেওয়ার প্রবল ইচ্ছা থাকলেও ভোটটা দিতে পারছেন না অনেকেই। ওষুধ কোম্পানির এক কর্মী ভোট দিতে গ্রামে যেতে না পারায় আক্ষেপ করছিলেন। কারণ তার এলাকার নৌকার প্রার্থী আওয়ামী লীগেরই স্বতন্ত্র প্রার্থীর সঙ্গে লড়াইয়ে একটু ঝুঁকিতে আছেন এবং তিনি তাদের আত্মীয়স্থানীয়। তাই ভোট দিতে যাওয়ার আগ্রহ ছিল একটু বেশি।’
কর্মক্ষেত্রে ছুটি চেয়ে না পাওয়া ওষুধ কোম্পানির ওই কর্মী নিজের নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘আমরা যারা ঢাকায় থাকি, তাদের কয়জন আর ঢাকার ভোটার? বিভিন্ন এলাকা থেকে এই ঢাকা শহরে কেউ এসেছি চাকরি করতে, কেউ কেউ করছেন ব্যবসা-বাণিজ্য। রিকশাচালক থেকে পোশাক শ্রমিক কত ধরনের মানুষ ঢাকায় আছেন। আমি নিজে এসেছিলাম পড়াশোনা করতে, এখন চাকরি করছি। কিন্তু ভোট তো গ্রামেই রয়ে গেছে।’
এর সমাধানে ই-ভোটিংয়ের ব্যবস্থা থাকলে ভালো হতো বলে মনে করেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বাসিন্দা ওয়ালিদ সিকদার রবিন। ঢাকায় অনেক বছর ধরে থাকলেও তিনি গ্রামের বাড়িতেই ভোট দিতে যান। তার নিজের প্রার্থী আছে বলে এবার এরই মধ্যে বাড়িতে চলে গেছেন। এতে কখনও কখনও বেগ পেতেও হয় তার। ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৩ (সদর ও বিজয়নগর) আসনের ভোটার রবিন বলেন, ‘সব সময় সমান উৎসাহ নিয়ে ভোট দিতে যেতে পারি নাই। স্মার্ট বাংলাদেশে এখনও ই-ভোটিংয়ের ব্যবস্থাটা হল না। পারলে ভালো হতো।’
এদিকে ই-ভোটিং কবে চালু করা যাবে তা নিশ্চিত করে বলতে পারেননি প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) হাবিবুল আউয়াল। গত ১২ নভেম্বর ‘স্মার্ট ইলেকশন ম্যানেজমেন্ট অ্যাপ বিডি’ চালু করার সময় প্রবাসী বাংলাদেশিসহ নিজ এলাকার বাইরে বসবাসকারী ভোটারদের ব্যাপক আগ্রহের কথা তুলে ধরে কবে নাগাদ ই-ভোটিং চালু সম্ভব হবে জানতে চেয়েছিলেন একজন প্রার্থী।
উত্তরের সিইসি বলেছিলেন, ‘এখনই ই-ভোটিং সম্ভব হবে না। পোস্টাল ভোটিং তো চালু রয়েছে। ঘরে বসে ভোট দেওয়ার ব্যবস্থা এখনও পৃথিবীর কোথাও চালু হয়নি। তবে ভারত চেষ্টা করছে ঘরে বসে মোবাইলের মাধ্যমে অনলাইনে ভোট নেওয়া যায় কি না সেই ব্যবস্থা করতে। ভারত সফল হলে আমরাও প্রবর্তন করতে পারব। তবে কবে চালু হবে তার নিশ্চয়তা এখন দিতে পারছি না।’