প্রবা প্রতিবেদক
প্রকাশ : ১৩ ডিসেম্বর ২০২৩ ১৬:১২ পিএম
আপডেট : ১৩ ডিসেম্বর ২০২৩ ১৭:০৮ পিএম
বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা থেকে গ্রেপ্তার জঙ্গি। ছবি : প্রবা
কথিত নিরাপত্তার চাদরে ঢাকা রাজধানীর ভাটারা থানাধীন বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় আবার জঙ্গি আস্তানার সন্ধান মিলেছে। সেখান থেকে দুর্ধর্ষ এক জঙ্গিকে গ্রেপ্তার করেছে ঢাকা মহানগর পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিট (সিটিটিসি)।
সংস্থাটির ইন্টেলিজেন্স অ্যানালাইসিস ডিভিশন গোয়েন্দা অনুসন্ধানে বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার জে ব্লকের ২ নম্বর সড়কের ৫৯ বাসায় এ জঙ্গি আস্তানার সন্ধান পায়। এর পরই আস্তানা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে ইমতিয়াজ সেলিম ওরফে ইমাদুল আমিনকে। তিনি নিষিদ্ধ সংগঠন হিযবুত তাহরীর ও উলাইয়া বাংলাদেশের অন্যতম নেতা। বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় আস্তানা বানিয়ে দীর্ঘদিন উগ্রবাদী কার্যক্রম পরিচালনা করছিলেন।
সিটিটিসির দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা জানান, বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় জঙ্গি আস্তানা নতুন নয়। এর আগে হলি আর্টিজান বেকারিতে হামলাকারীদেরও আস্তানা ছিল বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায়। তারা বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার আস্তানা থেকেই প্রস্তুতি নিয়ে হলি আর্টিজান বেকারিতে হামলা করে। ওই সময় বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা থেকে আসা পাঁচ জঙ্গির ব্রাশফায়ারে নিহত হয়েছিল ১৭ বিদেশিসহ মোট ২২ জন। এর আগে ২০২২ সালের ১৩ ডিসেম্বর বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় আত্মগোপনে থাকা অবস্থায় গ্রেপ্তার করা হয়েছিল জামায়াতের আমির ডা. শফিকুর রহমানকে।
একই বছরের ১২ ডিসেম্বর কেরানীগঞ্জে বসুন্ধরা রিভারভিউ এলাকা থেকে নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের অপারেশনাল টিমের সক্রিয় সদস্য আবদুল ওহাবকে গ্রেপ্তার করে র্যাব। র্যাব কর্মকর্তারা জানান, বসুন্ধরা রিভারভিউ এলাকায় অভিযান চালিয়ে ওহাবকে গ্রেপ্তার করা হয়।
বাংলা ভাইয়ের ঘনিষ্ঠ সহযোগী ওহাবের বাড়ি রাজশাহীর বাগমারায়। ২০১১ সালে তিনি জসীমউদ্দিন রাহমানীর আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে আনসারুল্লাহ বাংলা টিমে যোগ দেন এবং রাহমানীর ঘনিষ্ঠ সহযোগী হিসেবে কাজ শুরু করেন। এ ছাড়া বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা থেকে বিভিন্ন সময় বিপুলসংখ্যক জঙ্গিকে গ্রেপ্তার ও জঙ্গি আস্তানার সন্ধান পায় র্যাব-পুলিশ।
কথিত নিজস্ব নিরাপত্তার চাদরে ঢাকা বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় একের পর এক জঙ্গি গ্রেপ্তার ও জঙ্গি আস্তানার সন্ধান মেলায় বাসিন্দাদের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে। অনেকে নিজেদের ও সন্তানদের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন। তারা নিরাপদ বাসস্থানের সন্ধানে এলাকা ছাড়ার চিন্তাভাবনা করছেন। তারা বলছেন, বসুন্ধরা আবাসিক এলাকাটিকে বলা যায় মাফিয়া সাম্রাজ্য। এখানে বসুন্ধরা গ্রুপের নিজস্ব সিকিউরিটি বলয় রয়েছে। তাই এলাকায় আইন প্রয়োগকারী সংস্থার নজরদারি কম। তা ছাড়া আইন প্রয়োগকারী সংস্থা এখানে অভিযান চালাতে গেলে নানা বাধার সম্মুখীন হয়। আর এ সুযোগ নিচ্ছে জঙ্গি ও সন্ত্রাসীরা। তারা বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় আস্তানা গেড়ে নির্বিঘ্নে জঙ্গি কার্যক্রম পরিচালনা করছে। যেমনটি হয়েছিল হলি আর্টিজান হামলার ক্ষেত্রে। এসব কারণে বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার বসবাসের পরিবেশ নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন অনেকে। এ ছাড়া গত ২৩ নভেম্বর বসুন্ধরা গ্রুপের নিরাপত্তাকর্মীরা কুরআনে হাফেজ ও স্কুলছাত্র তৌহিদুল ইসলামকে অপহরণের পর গলা কেটে হত্যা করে। এতে বাসিন্দারা চরম আতঙ্কে আছেন। বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার ডি ব্লকের বাসিন্দা তৌহিদুল ইসলামের গলা কাটা লাশ পি ব্লকের একটি ঝোপ থেকে ২৬ নভেম্বর উদ্ধার করে পুলিশ। হত্যাকারী সন্দেহে গ্রেপ্তার করা হয়েছে বসুন্ধরা গ্রুপের বিশ্বস্ত নিরাপত্তাকর্মী জুয়েল রানাকে।
ভয়ানক জঙ্গি ইমতিয়াজকে গ্রেপ্তারের পর বুধবার (১৩ ডিসেম্বর) সিটিটিসির প্রধান আসাদুজ্জামান সংবাদ সম্মেলনে জানান, ২০০৯ সালে বাংলাদেশ সরকার হিযবুত তাহরীরকে নিষিদ্ধ করে। তার পরও সংগঠনের সদস্যরা দেশের সার্বভৌমত্বে আঘাত ও মানুষের জানমালের নিরাপত্তা বিঘ্নিত এবং বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির প্রয়াসে একটি নিষিদ্ধ সংগঠনের সদস্য হিসেবে সক্রিয়ভাবে অনলাইনে দেশবিরোধী প্রচারে অংশ নেয়।
এরই ধারাবাহিকতায় তারা কয়েক বছর ধরে অনলাইন সম্মেলন আয়োজনের মাধ্যমে নিষিদ্ধ সংগঠনকে সমর্থন করে এর কর্মকাণ্ড গতিশীল করার উদ্দেশ্যে বিভিন্ন প্রচার অব্যাহত রাখে। চলতি বছরের এপ্রিলে একটি অনলাইন সম্মেলনের পর ৩০ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যা ৭টায় তারা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ‘জালিম’ আখ্যা দেয়। ‘উপনিবেশবাদী মার্কিনিদের কবল থেকে মুক্তির উপায়’ শীর্ষক কনফারেন্স করে। সম্মেলনটি লেবাননভিত্তিক আল-ওয়াকিয়া টিভি নামক ইউটিউব চ্যানেলে সরাসরি প্রচার করা হয়।
এ সম্মেলনে অংশগ্রহণ করার জন্য তারা ঢাকাসহ সারা দেশে পোস্টার লাগায় এবং অনলাইনে প্রচার চালায়। সম্মেলনে দুজন বক্তা এবং একজন উপস্থাপক অংশ নেন। যেখানে সবাই ছদ্মনাম ব্যবহার করেন। এ সম্মেলনে বক্তারা সরকারের বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মকাণ্ড ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং বিভিন্ন দেশের সঙ্গে সরকারের সম্পর্কসহ নানা বিষয়ে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে ভুল তথ্য উপস্থাপন করে। তারা ধর্মের অপব্যাখ্যা দিয়ে দেশের সাধারণ মানুষকে হিযবুত তাহরীরের নেতৃত্বে শাসনব্যবস্থা কায়েমের মাধ্যমে ইসলামী রাষ্ট্র তথা খেলাফত প্রতিষ্ঠার জন্য উস্কানি দেয়।
হিযবুত তাহরীরের অন্যতম নেতা ইমতিয়াজ সেলিম ওরফে ইমাদুল আমিন। তার বাবার নাম সেলিম উল্লাহ চৌধুরী। গ্রামের বাড়ি চট্টগ্রামের হাটহাজারী উপজেলার কঠিরহাট ফরহাদাবাদ এলাকায়। তিনি আরও কয়েক সহযোগী নিয়ে বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার জে ব্লকে বাসা ভাড়া নিয়ে আস্তানা গাড়েন।
ইমতিয়াজ সেলিম জানান, তিনি নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিবিএ ও ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ বিভাগ থেকে মাস্টার্স করেছেন। বর্তমানে বনানীতে একটি মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে কর্মরত আছেন। ২০১০ সালের ১২ মে তিনি হিযবুত তাহরীর করার অভিযোগে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে গ্রেপ্তার হয়ে ছয় মাস জেল খাটেন। জেলে অবস্থানের সময় ইমতিয়াজ হিযবুত তাহরীরের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যাপক ড. সৈয়দ গোলাম মাওলা ও প্রফেসর মহিউদ্দিনের সান্নিধ্য পান। জামিনে মুক্তি পেয়ে পরিবারসহ অস্ট্রেলিয়া গিয়ে এক বছর অবস্থান করে দেশে এসে হিযবুত তাহরিরের সদস্য হিসেবে কার্যক্রম অব্যাহত রাখেন।
ইমতিয়াজ সেলিম মার্শাল আর্টে ব্ল্যাক বেল্টধারী এবং বাংলাদেশ জাতীয় কারাতে ফেডারেশনের তালিকাভুক্ত প্রশিক্ষক ও আন্তর্জাতিক রেফারি। তা ছাড়া তিনি জাপান কারাতে অ্যাসোসিয়েশনের লাইসেন্সধারী প্রশিক্ষক। তারা সংগঠনের জন্য তৈরি বিশেষ অ্যাপস এবং অপ্রচলিত ইনক্রিপ্টেড অ্যাপসের মাধ্যমে অন্য সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে চলেন। ফলে বেশিরভাগ সময় তারা ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকেন। ইমতিয়াজ সেলিম ওরফে ইমাদুল আমিনকে রমনা মডেল থানার একটি মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতে পাঠানো হয়েছে।