শহিদুল ইসলাম রাজী
প্রকাশ : ০৩ নভেম্বর ২০২৩ ১৬:০৮ পিএম
আপডেট : ০৩ নভেম্বর ২০২৩ ১৬:২৩ পিএম
রবিউল ইসলাম রবি।
‘জানডা বাইর হইয়্যা যাইতাছে। আমারে ধৈর্য দাও আল্লাহ। আমারে শক্তি দাও আল্লাহ।’ শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে পোস্ট অপারেটিভ বিছানায় শুয়ে এমন বিলাপ করছিলেন রবিউল ইসলাম রবি। হরতালে নাশকতার আগুনে ঝলসে বীভৎস হয়ে গেছে তার গোটা মুখ। পুড়ে গেছে দুই হাতসহ শরীরের অনেকটা অংশ। শরীরজুড়ে পোড়া যন্ত্রণা নিয়ে বার্ন ইউনিটের পোস্ট অপারেটিভের ৮ নম্বর বিছানায় কাতরাচ্ছেন বাবা-মায়ের একমাত্র ছেলেটি। পাশে দাঁড়িয়ে বৃদ্ধ বাবা হযরত আলী। চোখ তার ছলছল। ছেলের এমন কষ্ট দেখে বুকটা তার ভেঙে যাচ্ছে। অর্থসংকট তো আছেই। ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তা ভিড় করেছে ৬৫-ঊর্ধ্ব এ বৃদ্ধের। যন্ত্রণায় ছেলের কঁকিয়ে ওঠা দেখে একসময় কেঁদে ফেলেন তিনি।
একই সময় ওয়ার্ডের বাইরে ছেলের অপেক্ষায় ছিলেন মা ইয়াসমিন বেগম। ‘পোড়া মুখ দেইখা ছেলেটাকে চেনা যায় না। আমরা বাবা গরিব মানুষ। ডাক্তার বলছে ছেলেকে ভালো ভালো খাবার খাওয়াতে। এখন ছেলেকে খাওয়াব নাকি ওষুধ কিনব, না আমরা খাব। কিছুই ভেবে পাই না। এত টাকা কই পাব, কে দেবে।’ কথা বলতে বলতে আঁচল টেনে চোখের পানি মুছছিলেন রবির মা। গতকাল বুধবার তিনি বলেন, ‘দুপুর পর্যন্ত অর্ধবেলায়ই তিন হাজার টাকার ওষুধ, এই পরীক্ষা, সেই পরীক্ষায় চলে গেছে। চোখে শুধু অন্ধকার দেখতে পাই।’
রবির স্বজনরা জানিয়েছেন, রবির বাবা রিকশাচালক। রবির তিনি বোন। ছয় সদস্যের পরিবার তাদের। সংসারে নুন আনতে পানতা ফুরায় অবস্থা। অর্থাভাবে ছেলেকে
লেখাপড়াও করাতে পারেননি তার বাবা। তাই ছোট সময় থেকেই জীবন-সংগ্রামে বাবার সঙ্গী হন রবি। বাসের হেলপারি করতেন তিনি। বন্ধু নাঈমের সঙ্গে গত শনিবার ডেমরা স্টাফ কোয়ার্টার থেকে গাবতলী রুটের অছিম পরিবহনের একটি বাসে ঘুমাচ্ছিলেন। বাসটি ডেমরার দেইল্লা এলাকায় রাস্তার পাশে পার্ক করা ছিল। শেষ রাতে দুর্বৃত্তরা বাসে আগুন ধরিয়ে দেয়। আগুন থেকে প্রাণে বাঁচতে বাসের জানালা দিয়ে লাফ দিলেও শেষ রক্ষা হয়নি রবিউলের। দগ্ধ শরীরে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। আর ঘুমের মধ্যেই পুড়ে অঙ্গার হয়ে মারা যান আরেক হেলপার নাঈম।
ডেমরা থানার ওসি মোহাম্মদ জহিরুল ইসলাম প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, বিএনপি-জামায়াতের সকাল-সন্ধ্যা হরতালের আগের দিন রাতে বাসের দুই হেলপার বাসটিতে ঘুমাচ্ছিলেন। ভোররাত ৩টার দিকে বাসটিতে আগুন দেয় দুর্বৃত্তরা। খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিস ঘটনাস্থলে গিয়ে আগুন নেভায়। নাঈমের মরদেহ উদ্ধার করে স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ ও মিটফোর্ড হাসপাতালের মর্গে পাঠানো হয়। সেখানে ময়নাতদন্ত শেষে পরিবারের কাছে মরদেহ হস্তান্তর করা হয়। রবির পাশের বেডে রয়েছেন ট্রাকচালক ফিরোজ কবির। তিনিও গুরুতর দগ্ধ হয়ে যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছিলেন।
বার্ন ইউনিটের আবাসিক সার্জন মো. তরিকুল ইসলাম বলেন, রবিউলের শরীরের ১৭ শতাংশ পুড়ে গেছে। তার অবস্থা খুবই খারাপ ছিল। তাকে তিন দিন নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) রাখার পর মঙ্গলবার বিকালে পোস্ট অপারেটিভ ওয়ার্ডে স্থানান্তর করা হয়েছে। তার অবস্থা আগের চেয়ে কিছুটা ভালো।
তাদের গ্রামের বাড়ি নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ উপজেলার তারাইল বিরাবতে। গ্রামে তাদের কোনো জমিজমা নেই। তাই ডেমরা এলাকায় ভাড়া বাসায় থাকে পরিবারটি। ডেমরা এলাকায়ই বেড়ে উঠেছেন রবিউল। রবির বাবা বলেন, ‘আমি রিকশা চালাই। একটা রুম ভাড়া নিয়ে পরিবারের সবাইকে নিয়ে থাকি। ছেলেটা আমার রাতে বাসে ঘুমাইত। বয়স হয়েছে। তাই এখন আর বেশি খ্যাপ মারতে পারি না। গড়ে প্রতিদিন ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা আয় হয়। এই টাকা দিয়ে এই বাজারে কী হয় বলেন?’ তিনি বলেন, ‘এর মধ্যে ধারদেনা করে কিছুদিন আগে একটা মেয়ের বিয়ে দিয়েছি। ছেলের দুর্ঘটনার খবর শুনে হাসপাতালে এসেছিলাম ২৫০ টাকা হাতে নিয়ে। প্রতিদিন অনেক টাকা লাগে। কই পাব এত টাকা?’ তবু এ পর্যন্ত ২০-২৫ হাজার টাকা ধার করে ফেলছেন জানিয়ে তিনি কাঁদতে কাঁদতে বলেন, ‘কী অপরাধ ছিল আমার ছেলের? ক্যান আমার ছেলের এই ভয়াবহ পরিণতি হলো। চোখের সামনে ছেলেটা এমন ছটফট করতাছে। সহ্য করি ক্যামনে?’
চরম অনিশ্চয়তার আতঙ্ক পোড়া যন্ত্রণাকে বাড়িয়ে দিয়েছে অনেক। একদিকে একমাত্র ছেলে পোড়া যন্ত্রণা, অন্যদিকে চিকিৎসার খরচ মেটাতে হিমশিম খাচ্ছে পরিবারটি। ছেলের চিকিৎসার জন্য দেশের বিত্তবানদের এগিয়ে আসার অনুরোধ জানিয়েছেন রবিউলের বাবা।