ফয়সাল খান
প্রকাশ : ১৭ জুন ২০২৩ ১২:৩৪ পিএম
আপডেট : ১৭ জুন ২০২৩ ১২:৩৫ পিএম
মুক্ত বাতাসে শ্বাস নেওয়ার অবারিত সুযোগ থাকলেও প্রবহমান পানির দুর্গন্ধের কারণে হাতিরঝিলের ব্যাপারে ক্রমশই আগ্রহ হারাচ্ছে নগরবাসী। এমনকি বর্ষাকালেও এ ঝিলের পানির অস্বাভাবিক চেহারা বিশেষজ্ঞদেরও চিন্তিত করে তুলেছে। এরই মধ্যে গত তিন দিন ধরে ঝিলের সোনারগাঁও অংশে মরা মাছ ভাসতে দেখা গেছে। খবর পেয়ে রাজউক কর্মীরা মরা মাছ তুলে মাটিচাপা দিয়ে গেছে। কিন্তু পানির অসহনীয় দুর্গন্ধ এখনও ভোগাচ্ছে স্থানীয় অধিবাসী, দর্শনার্থী ও পথচারীদের।
অনেক দিন ধরেই পানির দুর্গন্ধ ভাসছে রাজধানীর এই জনপ্রিয় অবসর কেন্দ্রের বাতাসে। এর পানি দূষিত, নোংরা ও অস্বাভাবিক কালচে রঙের। হাতিরঝিলের দুর্গন্ধ দূর করতে পানিতে কলাবতীসহ বিভিন্ন ঘাসজাতীয় ভাসমান গাছ লাগানো হয়েছে। এতে সুফল না পাওয়ায় এখানকার পানি শোধন করতে প্রায় ৫৬ কোটি টাকার একটি প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়। কিন্তু কোটি কোটি টাকা খরচ করে এ প্রকল্প বাস্তবায়ন করেও হাতিরঝিলের পানি জীববৈচিত্র্য ও পরিবেশের জন্য কোনো সুফল বয়ে আনতে পারেনি।
মরা মাছ ও পানির দুর্গন্ধে গত কয়েক দিন ধরে হাতিরঝিলের পরিবেশ এমন হয়ে আছে যে, এখনও পথচারীদের চলাচল করতে হচ্ছে নাক-মুখ চেপে। প্রশ্ন উঠেছে, ঝিলে যদি মাছ বাঁচতে না পারে, যদি দুর্গন্ধ দূরই না হয় আর পানির স্বাভাবিক রঙ ফিরে না আসে, তাহলে অর্ধশত কোটি টাকা কোথায় খরচ করা হলো? কেনইবা খরচ করা হলো।
এমন প্রেক্ষাপটে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শুধু পানি শোধন করলেই হবে না, হাতিরঝিলের প্রাকৃতিক পরিবেশ সংরক্ষণ করতে হবে। বিশেষ করে আশপাশের এলাকায় পরিকল্পিত বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ও স্যুয়ারেজ ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট গড়ে তুলতে হবে। তা না হলে প্রতি বছর শত শত কোটি টাকা খরচ করেও কোনো সুফল মিলবে না।
স্টর্ম ও স্যুয়ারেজ লাইন পৃথক নয়
২০১৮ সালের জুলাইয়ে ‘হাতিরঝিল লেকের পানি পরিশোধন’ প্রকল্প হাতে নেয় রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক)। প্রাথমিক পর্যায়ে বছর মেয়াদি এ প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছিল ৪৮ কোটি ৯০ লাখ টাকা। কিন্তু দুই দফায় মেয়াদ বাড়িয়ে ২০২১ সালের জুলাই পর্যন্ত চলা এ প্রকল্পে খরচ হয় ৫৫ কোটি ৮৯ লাখ টাকা।
প্রকল্প নেওয়ার সময় সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলেছিলেন, হাতিরঝিলকে একটি স্টর্ম ওয়াটার রিটেনশন বেসিন হিসেবে তৈরি করার পরিকল্পনা ছিল। কিন্তু লেকের ক্যাচমেন্ট এরিয়াগুলোতে স্টর্ম ও স্যুয়ারেজ লাইন পৃথক না থাকায় পয়ঃবর্জ্য মিশ্রিত পানি হ্রদে চলে আসে। তা ছাড়া আশপাশের কারখানা বর্জ্যও লেকে চলে আসে। বর্ষাকালে জলাবদ্ধতার কারণে ওভার ফ্লো কন্ট্রোল গেট খুলে দেওয়ায় নানা বর্জ্য এসে লেকের পানিতে মেশে।
এসব কারণে প্রতি বছর হাতিরঝিলের লেকের পানি খারাপ হতে থাকে। সোনারগাঁও হোটেলে আসা দেশি-বিদেশি অতিথিদের বিরক্তির কারণও হয়ে দাঁড়ায় রাজধানীর ফুসফুসখ্যাত এ ঝিলের পানি। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য একটি অ্যাকশন প্ল্যান তৈরি করা হয়।
১০ পথে বর্জ্য আসছে ঝিলে
এর আগে ২০১৩ সালের ২ জানুয়ারি হাতিরঝিল প্রকল্পের উদ্বোধন করা হয়। প্রকল্পে ব্যয় হয় প্রায় দুই হাজার কোটি টাকা। তবে আশপাশের এলাকার স্যুয়ারেজ ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনার কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। যার ফলে প্রতিদিনই নানা ধরনের বর্জ্য এসে মিশছে হাতিরঝিলে।
রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, হাতিরঝিলের সঙ্গে মহাখালী, মগবাজারের টঙ্গী ডাইভারশন রোড, মধুবাগ, বেগুনবাড়ি, নিকেতন, তেজগাঁও, বাড্ডা ও রামপুরা এলাকায় ১০টি সংযোগ আছে। যেগুলো দিয়ে আশপাশের এলাকার বৃষ্টির পানিসহ ময়লা পানি, পয়ঃবর্জ্য ও শিল্পবর্জ্য এসে ঝিলে পড়ছে। পান্থপথ, কারওয়ানবাজার ও কাঁঠালবাগান এলাকার পানির ড্রেন এবং স্যুয়ারেজ লাইনও যুক্ত একই সঙ্গে। তাই এসব এলাকার শিল্পবর্জ্য, বাসাবাড়ির ময়লা পানিসহ সব ধরনের পচা-বাসি পানিও হাতিরঝিলের জলে মিশছে। যার কারণে পানির মান ঠিক রাখা যাচ্ছে না।
প্রকল্প শেষ হওয়ার সময় এর পরিচালক ছিলেন রাজউকের প্রধান প্রকৌশলী রায়হানুল ফেরদৌস। তিনি জানান, প্রকল্পটি হাতিরঝিলের পানির মান ফিরিয়ে আনার জন্য বাস্তবায়ন করা হয়েছিল। কিন্তু বেশকিছু সমস্যার কারণে পানির মান কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে আনা যাচ্ছে না।
তিনি বলেন, কারওয়ান বাজারের কাঁচাবাজার ও মাছ বাজারের ময়লা আসছে হাতিরঝিলে। আশপাশের এলাকার ময়লা ঢুকছে। বৃষ্টি হলে হোটেল সোনারগাঁও প্রান্তের গেট খুলে দিতে হচ্ছে। ফলে কাঁঠালবাগান এলাকার সব ময়লা-আবর্জনা ঝিলে ঢুকছে। অন্যান্য এলাকারও একই অবস্থা। এগুলো বন্ধ না করতে পারলে হাতিরঝিলের পরিবেশ ঠিক রাখা কঠিন হবে বলে মনে করেন তিনি।
মারা যাচ্ছে মাছ
গত সোমবার সরেজমিনে দেখা গেছে, হোটেল সোনারগাঁওয়ের পেছনে হাতিরঝিলের পাড়ে নাকে হাত দিয়ে হাঁটছেন পথচারীরা। আশপাশের বাসাবাড়িতে দরজা-জানালা বন্ধ রাখা হয়েছে। লেকের পাড়ে কচুরিপানা ও ঘাসের ফাঁকে মাছ মরে ভেসে আছে।
তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত শনিবার থেকে শত শত মরা মাছ ভেসে উঠতে দেখেন তারা। খবর পেয়ে রাজউকের কর্মীরা এসে মরা মাছ তুলে লেকের পাড়ে মাটিচাপা দেন। কিন্তু এতেও দুর্গন্ধ ছড়ানো বন্ধ হয়নি। সোমবারও লেকে মাছ মরে ভেসে থাকতে দেখা গেছে।
রাজউকের হাতিরঝিল প্রকল্পের পরিচালক আবুল কালাম আজাদ বলেন, হাতিরঝিলে আমরা কোনো মাছ ছাড়িনি। এমনিতে জন্ম নেওয়া কিছু মাছ মারা গেছে। কারণ হিসেবে তিনি বলেন, কাঁঠালবাগান ঢাল থেকে ময়লা পানি আসায় মাছ মারা গেছে। খবর পেয়ে রাজউক কর্মীরা তা পরিষ্কার করেছেন।
বিশেষজ্ঞ অভিমত
ইনস্টিটিউট ফর প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আইপিডি) নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক ড. আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, শুধু প্রকল্প দিয়ে হাতিরঝিলের পানির মান ঠিক করা যাবে না। এ জন্য কঠোর হতে হবে। ইমারত নির্মাণ বিধিমালা অনুযায়ী কেউ এখানে ময়লা ফেলতে পারেন না। যেকোনো মূল্যে এই ঝিলে আশপাশের বর্জ্যমিশ্রিত পানি আসা বন্ধ করতে হবে। তিনি বলেন, যে প্ল্যান্টগুলো আছে, সেগুলোর কার্যকারিতা কতটুকু- তা খতিয়ে দেখতে হবে। প্ল্যান্ট নষ্ট থাকার কারণেই শিল্পবর্জ্যসহ নানা বর্জ্য হাতিরঝিলের পানিতে মিশছে।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সভাপতি পরিকল্পনাবিদ মোহাম্মদ ফজলে রেজা সুমন বলেন, হাতিরঝিলের যেদিক দিয়ে বাইরের পানি ঢুকবে সেদিকেই ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট আছে। অতএব পানি শোধন হয়েই ভেতরে ঢোকার কথা। কিন্তু কেন এর ব্যত্যয় হচ্ছে তা খতিয়ে দেখা দরকার। তিনি বলেন, গত তিন দিনে অনেক মাছ মারা গেছে। এটি ছোটখাটো কোনো বিষয় নয়। এই ঝিল জীববৈচিত্র্যের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়ালে ঢাকার পরিবেশের ওপর মারাত্মক প্রভাব পড়বে।