ফারহানা বহ্নি
প্রকাশ : ২০ মে ২০২৩ ১৩:০০ পিএম
আপডেট : ২০ মে ২০২৩ ১৪:১৮ পিএম
রাজধানীর মানিকনগরের তেলেগু কলোনিতে বিদ্যুৎ সংযোগ নেই। মোমবাতি জ্বালিয়ে শিশুদের পড়ান রাধা রানী। ছবি : ইন্দ্রজিৎ কুমার ঘোষ
রাস্তার নোংরা পানি পার হয়ে দেখা যায় খোলা মাঠজুড়ে ভাঙা ঘরবাড়ির ইটের টুকরোর স্তূপ। কিছুদিন আগেও সেখানে ছিল গাদাগাদি করে গড়ে ওঠা ছোট ছোট ঘর। পাশেই নতুন করে ঘর তুলছেন যাত্রাবাড়ীর ধলপুরের হরিজন পল্লীর বাসিন্দা সোমা লম্মা। নিজেদের মধ্যে তেলেগু ভাষায় কথা বললেও বাইরের মানুষের সঙ্গে বাংলাতেই কথা বলেন। তবে নিজেদের তেলেগু বলে পরিচয় দিতে পছন্দ করেন তারা।
সোমা লম্মা দেখেছেন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধও। তখন তিনি ১৩ বছরের কিশোরী। দীর্ঘ সময়ে এদেশে থাকায় তামিল ছাড়াও বাংলা ভাষাটাও ভালো রপ্ত করেছেন। ধলপুরের ১৪ নম্বর আউটফলে সুইপার কলোনি থেকে গত ফেব্রুয়ারিতে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) উচ্ছেদ অভিযানে তেলেগুদের যে শতাধিক ঘর ভাঙা হয়, তার একটি সোমা লম্মার।
একাত্তরে কেন দেশ ছেড়ে ভারতে যাননি জানতে চাইলে ক্ষিপ্ত হয়ে তিনি বলেন, ‘আমি কেন পালিয়ে যাব? আমি এদেশের নাগরিক।’ ব্রিটিশ আমলে পরিচ্ছন্নতার কাজ করতে ভারত থেকে তার বড় চাচাকে প্রথমে নিয়ে আসা হয়। তারপর বাবা, মাসিকেও আনা হয়। এভাবেই এ দেশের নাগরিক তারা।
এত বছরেও এদেশে তার কোনো স্থায়ী ঠিকানা হয়নি। নতুন করে ঘর তুলতে প্রায় ৭০ হাজার টাকা খরচ হয়েছে বলে জানান এ নারী। তবে বিদ্যুৎ ও পানির ব্যবস্থা না থাকায় রাত হলে এখানে বেশিরভাগের ঘরেই মোমবাতি জ্বলে ওঠে। সোমা লম্মা বলেন, ‘পাশে সিটি করপোরেশনে যারা চাকরি করে তাদের ফ্ল্যাট থেকে পানি নিয়ে আসতে হয়। এতে কোমর ব্যথা হয়। কারেন্ট নাই যে ফ্যান চালাব।’
ধ্বংসস্তূপের পাশেই কোনো রকমে টিকে আছে ছোট একটি অস্থায়ী চায়ের দোকান। চা চাইলে কিছুটা লাজুক হেসে ১৪ বছরের তুষার জানায়, তাদের সবাই ‘মেথর’ বলে। তাদের সঙ্গে বসে কেউ চা খায় না।
তুষার জানায়, আগের জায়গায় ৩০ বছরেরও বেশি সময় ধরে তার বাপ-দাদারা ঘর তুলে বসবাস করেছিল। জায়গার সংকট থাকায় অনেকেই দোতলা ঘর তুলেছিল। সব ভেঙে দেওয়ার পর প্রথমে মাথা গোঁজার জায়গা ছিল না। পরে এখানে জায়গা দিলে নতুন করে ঘর তুলতে হচ্ছে। তবে এখানে বিদ্যুৎ, পানি কিছুই নেই। আবার অন্য কোথাও যাওয়ারও সুযোগ নেই। কারণ কেউ তাদের বাসা ভাড়া দেয় না।
বংশপরম্পরায় পরিচ্ছন্নতাকর্মীর কাজ করা বাবু দাস এখন একটি ব্যাংকে অফিস সহকারী পদে কর্মরত। নতুন ঘর বানাচ্ছেন তিনিও। বাবু দাস বলেন, ‘মৌচাকে মৌমাছিরা যেমন একসঙ্গে থাকতে চায়, আমরা তেলেগুরা তেমন থাকতে পছন্দ করি। সেই মৌচাক ভেঙে গেলে অসহায় লাগে।’
পরিচ্ছন্নতার কাজ করেন গুরফু রামু। তার স্ত্রীর নাম রাজিয়া বেগম। এ কলোনির সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ খ্রিস্টান ও হিন্দু। তবে তিনটি পরিবার রয়েছে মুসলিম। ৯ সদস্যের পরিবার রাজিয়া বেগমের। তার স্বামী গুরফু রামু বলেন, ‘এইটুকু ঘরে বউ-বাচ্চা-শাশুড়ি মিলে তো থাকা সম্ভব না। অন্য কোথাও থাকতে পারব না। কালচার মিলবে না। আমাদের একসঙ্গে মরা, একসঙ্গে বাঁচা।’
টিকাটুলী থেকে আরও সুন্দর জীবনের আশায় এক ছেলেকে নিয়ে ধলপুরে এসেছিলেন মুত্তালে রত্না। ধলপুরের ১৪ নম্বর আউটফলে ৩৫ বছর ধরে বসবাস করেছেন তিনি। এক মেয়ে, এক ছেলে, ছেলের বউ, নাতিসহ চারজনের সংসার রত্নার। বলছিলেন, ‘ওইখানে সবকিছু ভাইঙা দিছে। মেয়ে-ছেলে কই যাবে, আমি কই যামু।’
সম্প্রতি সিজারে বাচ্চা জন্ম দিয়েছেন সোনিয়া। দুইটি ছোট বাচ্চা নিয়ে এ অবস্থায় বেশ বেগ পোহাতে হচ্ছে তার। সেলাই নিয়ে এতদূর থেকে পানি আনাও সম্ভব না। তিনি বলেন, গরমের কারণে বাচ্চাদের ডায়রিয়া হচ্ছে দুই দিন পর পর। আবার টয়লেটে পানি নাই। ঘর পর্যন্ত গন্ধ আসে। গরমে ঘেমে ঠান্ডা লেগে দুই দিন পর পর বাচ্চাদের জ্বর হয়। কদিন পর পর হাসপাতালে যেতে হয়।
এত বছরেও কেন কোথাও স্থায়ী ঠিকানা হয়নি তেলেগুদের? এমন প্রশ্নে লেখক ও গবেষক পাভেল পার্থ বলেন, তাদের প্রধান সমস্যা আর্থিক নয়, অস্পৃশ্যতা। মানুষ তাদের সঙ্গে মিশতে চায় না। ফলে যেকোনো জায়গায় তারা গিয়ে থাকতে পারে না। ওদের মূল ধারায় আনতে হবে। এ পেশা থেকে অন্যান্য পেশায় নেওয়া না গেলে সমস্যাটা বাড়তে থাকবে। পেশার কারণে তাদের অস্পৃশ্য বলা হয়। এ পেশার সঙ্গে জড়িত সবাইকে মূলত হরিজন বলা হয়। এটা মূলত একটা টার্ম। তাদের প্রত্যেকেরই আলাদা জাতিগত পরিচয় আছে।
তিনি বলেন, ঢাকায় তাদের যেভাবে বারবার উচ্ছেদ করা সহজ, অন্য জেলাগুলোতে এতটা সহজ নয়। বারবার উচ্ছেদের কারণে তাদের স্থায়ী জায়গাটাও হয় না, আবার মেথর বলে গালাগাল করে অন্যরাও তাদের থাকার জায়গা দেয় না।’
বাংলাদেশে পরিচ্ছন্নতা পেশায় নিয়োজিত বাঁশফোড়, হেলা, লালবেগী, ডোমার, তেলেগু, রাউত, হাঁড়ি, ডোম (মাঘাইয়া) ও বাল্মীকি সম্প্রদায়ের সদস্যরা নিজেদের হরিজন দাবি করেন। তবে এদের অনেকেই এখন বিভিন্ন পেশায় যুক্ত। মূলত ব্রিটিশ সরকার ভারতের তেলেঙ্গানা রাজ্য থেকে তাদের পূর্বপুরুষদের এ অঞ্চলে নিয়ে এসেছিল ‘জাত মেথর’ হিসেবে কাজ করানোর জন্য। সারা দেশে ‘মেথরপট্টি’ গড়ে তুলে তাদের বাসস্থানের ব্যবস্থা করেছিল তৎকালীন সরকার।
কথিত এসব ‘অচ্ছুত’ মানুষকে সম্মানজনক অবস্থান দেওয়ার জন্য মহাত্মা গান্ধী তাদের নাম দিয়েছিলেন হরিজন। মানে ঈশ্বরের সন্তান। ঢাকা শহরে অবহেলিত হরিজন সম্প্রদায়ের মধ্যে ক্ষুদ্র জাতিসত্তা তেলেগু একটি। ব্রিটিশ আমলে জঙ্গল পরিষ্কারের জন্য ভারতের অন্ধ্র প্রদেশ থেকে কয়েকটি তেলেগু পরিবারকে ঢাকায় আনা হয়। পরে তাদের দিয়ে করানো হয় ময়লা পরিষ্কারের কাজ।
ঢাকার কমলাপুরসংলগ্ন গোপীবাগ রেলওয়ে হরিজন কলোনিতে ৫০ বছর ধরে ১৭৭টি পরিবার কাঁচা ঘরে বাস করে আসছে। ব্রিটিশ আমলে চার-পাঁচটি তেলেগু পরিবার টিনের ঘর বানিয়ে থাকত পুরান ঢাকার লক্ষ্মীবাজারে। তখন তারা চাল-ডাল, সাবান পেত নামমাত্র মূল্যে। দিনে দিনে তেলেগু জনগোষ্ঠীর সদস্যসংখ্যা বাড়তে থাকে। তখন লক্ষ্মীবাজার থেকে এনে তাদের জায়গা দেওয়া হয় নারিন্দায়। এটাই এখন নারিন্দা মেথরপট্টি হিসেবে পরিচিত। ঘিঞ্জি এ জায়গায় ১৯৮৭ সালে তাদের একটি বহুতল ভবন দেওয়া হয়। সেই ভবনে ঠাঁই হয় অনেকের।
সিটি করপোরেশনের টেন্ডারে অংশ নিয়ে একটি প্রতিষ্ঠান হরিজনদের জন্য ভবনটি নির্মাণ করেছিল। কিন্তু বুঝিয়ে দেওয়ার আগেই ভবনটি ভেঙে পড়তে থাকে। পরে সিটি করপোরেশন ভবনটি পরিত্যক্ত ঘোষণা করে। এরপর হরিজনদের ঠাঁই হয় দয়াগঞ্জ সিটি করপোরেশন মার্কেটের দোকানঘরে। সেখানে থাকে কয়েকশ পরিবার। নব্বইয়ের দশকের প্রথম দিকে কিছু তেলেগু পরিবারকে থাকার জায়গা দেওয়া হয়েছিল ধলপুর সিটি পল্লীতে। সেখান থেকেও তাদের উচ্ছেদ করে পাশে আবার জায়গা দেওয়া হয়েছে।
ধলপুরে উচ্ছেদ হওয়া ১২৬টি পরিবারের জন্য ১০টি করে দুই পাশে ২০টি ছোট টয়লেট দেওয়া হয়েছে। আলাদা গোসলখানা রয়েছে ৫টি। সেগুলোও খুব ছোট পরিসরে। প্রত্যেক পরিবারকে ১০ ফুট দৈর্ঘ্য ও ১৫ ফুট প্রস্থের একটি করে ঘর দেওয়া হয়েছে। রান্নাঘরের কোনো ব্যবস্থা নেই।
তাদের উচ্ছেদ করা হয়নি দাবি করে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের নির্বাহী প্রকৌশলী সাইফুল ইসলাম জয় বলেন, ‘তাদের আপাতত একটা জায়গা দেওয়া হয়েছে। পরে ঘর তুলে দেব। সেটার মাস্টার প্ল্যান হচ্ছে। তাদের কেউ বাসা ভাড়া দেয় না। এ অবস্থায় উচ্ছেদ করলে তারা কোথায় যাবে?’
তিন মাস পানি-বিদ্যুৎ ছাড়া বসবাস করা অমানবিক উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘অনেকবার এই এলাকায় পানির ব্যবস্থা করার চেষ্টা করেছি, কিন্তু সম্ভব হয়নি। তাই আমরা এখানে একটি ডিপ টিউবওয়েলের ব্যবস্থা করব।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন তেলেগু নেতা বলেন, ‘মূলত জায়গা পরিবর্তনের কারণে আগের বকেয়া বিল শোধ করা যাচ্ছে না। তাই বিদ্যুৎ অফিস লাইন দিচ্ছে না। এখন কুপি, মোম জ্বালিয়ে রাতটা পার করছি। এ ছাড়া নতুন ঘর তোলায় অনেকের হাতে টাকা নেই। আগের এত টাকা শোধ করতে পারছে না।’
বিনা নোটিসে হরিজনদের উৎখাতের যেকোনো অপপ্রয়াস বেআইনি বলে জানান হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের নেতা কাজল দেবনাথ। তিনি বলেন, পানি-বিদ্যুৎ ছাড়া তাদের পুনর্বাসন করা হলো কীভাবে? আউটফল হলো ভাগাড়, যেখানে মৃত গরু-ছাগল ফেলা হতো, ময়লা-আবর্জনা ফেলা হতো। তখন তাদের থাকার জায়গা নেই বলে এ জায়গায় তারা ময়লা পরিষ্কার করে থাকার উপযোগী করে তুলেছে। এখন ৩০ বছর পর সিটি করপোরেশন জায়গাটা ফিরিয়ে নিতে চায়। এটা অমানবিক।