× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

কংক্রিটে শেষ ঢাকার পুকুর

আমিনুল ইসলাম মিঠু

প্রকাশ : ০৬ মে ২০২৩ ১০:১১ এএম

আপডেট : ০৬ মে ২০২৩ ২০:০৯ পিএম

পুকুর থেকে দখলদারদের উচ্ছেদ করেছিল প্রশাসন। কিন্তু দখল থেকে মুক্ত হলেও একসময়ের রামসার পুকুর এখন খেলার মাঠ। প্রবা ফটো

পুকুর থেকে দখলদারদের উচ্ছেদ করেছিল প্রশাসন। কিন্তু দখল থেকে মুক্ত হলেও একসময়ের রামসার পুকুর এখন খেলার মাঠ। প্রবা ফটো

এককালে এলাকার প্রাণ ছিল পুষ্প সাহা পুকুর। রাজধানীর পুরান ঢাকার জগন্নাথ সাহা রোডের এই পুকুরটি খুঁজতে গিয়ে মিলল এক ভাগাড়- ময়লার ভাগাড়।

ভাগাড়ের নিচে পাওয়া যায় কংক্রিটভর্তি প্লাস্টিকের বস্তাও। পুরোপুরি ভরাট করে ফেলা হয়েছে লম্বা-চওড়া এই পুকুরটি। পুষ্প সাহা পুকুর ছাড়াও জগন্নাথ সাহা রোডে ছিল রামসার পুকুর। আরও কয়েকটি পুকুর ছিল বলেও এলাকাবাসীর ভাষ্য। সেগুলোর পরিণতি পুষ্প সাহা পুকুরের মতোই। কোথাও কোথাও গড়ে উঠেছে সুউচ্চ ভবন।

সম্প্রতি দেশজুড়ে তীব্র দাবদাহ অনুভূত হয়। তার ওপর বঙ্গবাজার ও নিউ সুপার মার্কেটের আগুন মনে করিয়ে দেয় অট্টালিকার শহর ঢাকার পরিস্থিতি। আবহাওয়া ঠান্ডা রাখতে বা আগুন নেভাতে যে জলাধার প্রয়োজন তা দিন দিন প্রায় ভরাট হয়ে গেছে। এখন পর্যন্ত যা আছে, তারও যত্ন নেই। ফলে পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে। বঙ্গবাজারের আগুন নেভাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদুল্লাহ হলের পুকুর এবং নিউ সুপার মার্কেটে অগ্নিকাণ্ডের সময় ঢাকা কলেজের পুকুরের পানি ব্যবহার করতে হয়েছে ফায়ার সার্ভিসকে।

আগারগাঁওয়ে পুকুর  ভরাট করে  বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের ভবন নির্মাণ। প্রবা ফটো

পুষ্প সাহা পুকুর রক্ষা কমিটির সাধারণ সম্পাদক সায়েমুল ইসলাম সায়েম বলেন, ১৯৩০ সালের দিকে জমিদার জগন্নাথ সাহার ছেলেরা পানির চাহিদা মেটাতে পুকুরটি খনন করেন। যেকোনো প্রয়োজনে স্থানীয়দের পানির চাহিদা পূরণসহ ঐতিহাসিক দিক থেকেও পুষ্প সাহা পুকুরটি গুরুত্বপূর্ণ। অথচ ধীরে ধীরে দখলদারদের কবজায় চলে যাচ্ছে পুকুরের জায়গাটি। 

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) ২০১৯ সালের ঢাকা ও আশপাশের জলাশয় ভরাটের গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, ঢাকা মেট্রোপলিটন এলাকায় ৩ হাজার ১৬২ একর জলাশয়ের মধ্যে ২৭ শতাংশ ভরাট করা হয়েছে। এ কারণে তাপমাত্রা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। এতে আরবান হিট আইল্যান্ডে পরিণত হয়েছে রাজধানী। গত ২০ বছরে ঢাকার তাপমাত্রা কয়েক ডিগ্রি বেড়ে গেছে। তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে ডেঙ্গুর প্রভাবও বেড়েছে। তাই জনস্বার্থ এবং জীব-বৈচিত্র্যের জন্য জলাধারগুলো প্রয়োজন।

বিআইপির প্রেসিডেন্ট নগরপরিকল্পনাবিদ ড. আদিল মোহাম্মদ খান প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, একটি মহানগর এলাকায় মোট ভূমির কমপক্ষে ১২ থেকে ১৫ শতাংশ জলাধার দরকার। ২০ বছর আগেও ঢাকায় ১২ শতাংশ ছিল। কিন্তু এখন তা ৫-৬ শতাংশে নেমে এসেছে। একসময় পুরান ঢাকার প্রতিটি মহল্লায় পুকুর ছিল।

মৎস্য অধিদপ্তরের পরিসংখ্যানমতে, ১৯৮৫ সালে ঢাকায় পুকুর ছিল ২ হাজার। সম্প্রতি মৎস্য বিভাগের এক জরিপ বলছে, ঢাকায় সরকারি পুকুর ১২০টি, বেসরকারি ৩২টি এবং লেক আছে ৩১টি। এর বাইরে সেনানিবাস এলাকায় কিছু পুকুর রয়েছে।

বেসরকারি সংস্থা রিভার অ্যান্ড ডেল্টা রিসার্চ সেন্টারের (আরডিআরসি) জরিপ অনুযায়ী, ১৯২৪ সালে ব্রিটিশ টপোগ্রাফি মানচিত্রে পুরান ঢাকায় ১২০টি ছোট-বড় পুকুর ছিল। তার মধ্যে এখন টিকে আছে ২৪টি। এ হিসাবে ভরাট হয়েছে ৯৬টি পুকুর। যে ২৪টি পুকুর আছে, তা-ও আকারে ছোট হয়ে গেছে।

ভরাট করা হয়েছে জগন্নাথ সাহা রোডের ঐতিহ্যবাহী পুষ্প পুকুর। প্রবা ফটো


সংস্থাটির চেয়ারম্যান মোহাম্মদ এজাজ বলেন, পুরান ঢাকার পুকুর রক্ষায় কখনোই জোরালো কোনো ভূমিকা রাখতে পারেনি সরকারি সংস্থাগুলো। আমরা মনে করি দখলের কারণে আয়তনে ছোট হয়ে যাওয়া পুকুরের ভূমি উদ্ধার করে হলেও তা সচল রাখা উচিত। এজন্য দেশে জলাধার ও পরিবেশ আইন আছে। সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর তা মানা উচিত। সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে আর কোনো জলাশয় বা জলাধার ভরাট না করার নির্দেশনা আছে, কিন্তু মানা হচ্ছে না।

শুধু পুরান ঢাকাই না; ঢাকার বর্ধিত নতুন এলাকায়ও ভরাট করা হচ্ছে পুকুর ও জলাধার। এ কাজে বেসরকারি ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের চেয়ে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো এক ধাপ এগিয়ে। আগারগাঁও এলাকায় কয়েকটি সরকারি পুকুরের খোঁজে গিয়ে দেখা গেল, সেগুলোতে নির্মাণ হচ্ছে সুউচ্চ ভবন। 

ভবন নির্মাণ করতে রাজউক থেকে প্ল্যান পাস করাতে হয়। পুকুর বা জলাশয় ভরাট করলে ভবন নির্মাণে ছাড়পত্র দেয় না রাজউক। কিন্তু সরকারি সংস্থাগুলো রাজউকের অনুমতি ছাড়াই ভবন নির্মাণ করছে। এ বিষয়ে নগর পরিকল্পনাবিদ আদিল মোহাম্মদ খান বলেন, সম্প্রতি বিএডিসি জলাশয় ভরাট করেছে, পান্থপথে পানি ভবনও জলাশয় ভরাট করে নির্মাণ করা হয়।

গত বছর বেসরকারি বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক) জলাশয় ভরাট করেছে। ইউজিসি ভবন হয়েছে জলাশয় ভরাট করে। কুড়িলে জলাশয় লিজ দেওয়ার চেষ্টা করে রেলওয়ে। আমাদের প্রতিবাদের মুখে তা বন্ধ করা হয়। এসব ঘটনা বেসরকারি ভবন নির্মাণ প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তিদের উৎসাহ দেবে।

রাজউক ও সিটি করপোরেশনকে সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে। যাতে সরকারি সংস্থাগুলোও রাতের আঁধারে জলাধার ভরাট করতে না পারে। এ ছাড়া সরকারি সংস্থাগুলোরও রাজউক থেকে ভবন নির্মাণের ছাড়পত্র নেওয়া উচিত। তবে সম্প্রতি ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন উদ্যোগ নিয়ে কয়েকটি জলাশয় ভরাট করা বন্ধ করেছে, যা প্রশংসনীয়।

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন-বাপার কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক শরীফ জামিল বলেন, প্রাকৃতিক জলাধার যাতে নষ্ট না হয়, সেজন্য ২০০০ সালে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী প্রাকৃতিক জলাধার রক্ষায় আইন প্রণয়ন করেন। কিন্তু এখন ওনার দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা দায়িত্ব পালনে অবহেলা করছেন। এমনকি সেসব পুকুর-জলাধার ভরাট করে নগরকে হুমকির মুখে ফেলে দিয়েছেন। এগুলো এককভাবে কেউ করেননি, এটি সামষ্টিকভাবে করা হয়েছে। এজন্য কাউকে জবাবদিহির আওতায় আনা হয়নি। এমনকি আইন লঙ্ঘন করার জন্য প্রশাসনিক বা আদালতের মাধ্যমে শাস্তিমূলক ব্যবস্থাও নেওয়া হয়নি। পুকুর-জলাধার পুনরুদ্ধার করা দরকার। তবে তার আগে আইন লঙ্ঘন বন্ধ করা প্রয়োজনসহ জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে।

বুয়েটের পানি ও জলবায়ু বিশেষজ্ঞ ড. একেএম সাইফুল ইসলাম বলেন, শহরের জলাধারগুলো অনেক গুরুত্ব বহন করে। প্রাত্যহিক প্রয়োজন ছাড়াও তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা রাখে এই জলাধার। একই সঙ্গে ভূগর্ভস্থ পানি বৃদ্ধি করে।

ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি বলেন, ‘দিন দিন আমরা পানির আধারগুলো খেয়ে ফেলছি। সরকারের কোনো নজরদারি নেই।’ এখনই শহরের পুকুরগুলো রক্ষায় জোর দেওয়ার তাগিদ দিয়ে তিনি বলেন, ‘প্রয়োজনে ব্যক্তিমালিকানাধীন পুকুর ও আশপাশের জমিগুলো অধিগ্রহণ করতে পারে সরকার। সরকারি পুকুরগুলোর তালিকা করে নম্বর দিতে হবে। পুকুরকেন্দ্রিক জীববৈচিত্র্যও রক্ষা করতে হবে। এজন্য পাড়গুলো বেঁধে দিতে হবে।’

যে পুকুরগুলো আছে, সেগুলো সিটি করপোরেশন ও রাজউকের অধীনে রাখারও মত দেন তিনি।

শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা