প্রবা প্রতিবেদক
প্রকাশ : ০৮ মার্চ ২০২৩ ০৮:৫৯ এএম
আপডেট : ০৮ মার্চ ২০২৩ ১২:০২ পিএম
স্বজন হারিয়ে স্বজনের আহাজারি। প্রবা ফটো
ঢাকা মেডিকেলের জরুরি বিভাগের নিবন্ধন ডেস্কের পাশে দাঁড়িয়ে নিবন্ধন বইয়ের দিকে অপলক চেয়ে আছেন তাজুল ইসলাম ভূইয়া। মলিন চেহারা, চোখে জল ছলছল করছে। গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়া অশ্রু শুকিয়ে দাগ হয়ে গেছে। এরই মধ্যে হঠাৎ তার পকেটে থাকা মোবাইল বেজে ওঠে, মোবাইলের কল ধরে অন্য প্রান্তে থাকা এক স্বজনকে বলছেন, ‘ভাইয়ের মুখটা পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। ভাইকে তো চেনা যায় না’ বলেই চিৎকার করে কান্না শুরু করেন ৫৩ বছর বয়সি তাজুল।
একটু পর ফের অন্য প্রান্তে স্বজনের কথার উত্তরে কান্না থামিয়ে বলেন, ‘মাত্র এন্ট্রি করা হইল। লাশ কখন বুঝে পামু জানি না।’
ঢাকা মেডিকেলের জরুরি বিভাগের ৭ নম্বর কক্ষেই সিদ্দিকবাজারে বিস্ফোরণে নিহতদের নাম নিবন্ধন করা হয়। মেডিকেল স্টাফদের দম ফেলার ফুরসত নেই। দ্রুতগতিতে তাদের হাত চলছে নিবন্ধন বইতে। এদিকে নিহতের স্বজনদের আহাজারি আর কান্নাকাটিতে এই কক্ষে পরিবেশ ভারী হয়ে আছে। স্বজন হারানো মানুষের বিলাপ কানে এলেও আসলে ঠিক বোঝা যাচ্ছে না তারা কী বলছেন। বোঝা না গেলেও আহাজারির অন্তর্নিহিত ভাষা বেদনা, কষ্ট, যা বুক ফেটে বেরিয়ে আসে।
তাজুল ইসলাম জানান, বিস্ফোরণের ভবনের পাশের ভবনেই ছিল তার বড় ভাই নুরুল ইসলাম ভূইয়ার দোকান। নাম ইউসুফ স্যানিটারি। প্রতিদিনের মতো আজও নুরুল এসেছিলেন তার দোকানে, কিন্তু সেখান থেকে আর বাড়ি ফেরা হয়নি। সিদ্দিকবাজারের বিস্ফোরণে প্রাণ হারিয়ে এখন ঢাকা মেডিকেলের মর্গে নিথর পড়ে আছেন। স্বজনরা মরদেহ বুঝে পাওয়ার জন্য বুকে পাথর চেপে অপেক্ষা করছেন।
শুধু তাজুলই নন, নিহতদের অনেক আত্মীয়স্বজনরাও মরদেহ বুঝে নিতে গিয়েছিলেন ঢাকা মেডিকেলে। তারা শুধু নিবন্ধন কাজে থাকা কর্মীদের বারবার অনুরোধ করছিলেন দ্রুত মরদেহ হস্তান্তরের জন্য।
গুলিস্তানের ফুটপাতে পান-সিগারেট বিক্রি করেন পঞ্চাশোর্ধ্ব হাসেম মিয়া। ছোট্ট নিবন্ধন কক্ষের বাইরে ‘কুইক রেসপন্স টিমের’ কক্ষ। সেখানে একটি চেয়ারে বসে আছেন তিনি। ছেলে হৃদয়কে হারিয়ে শোকে পাথর হয়ে গেছেন। ছেলেকে বিকালে ফোন দিয়ে দোকানে আসতে বলেছিলেন। বাবার ফোন পেয়ে সেখানে যাওয়ার পথে বিস্ফোরণের কবলে পড়ে মারা যায় ছেলেটি।
তিনি কাঁদতে কাঁদতে বলেন, ‘ছেলেডারে ফোন দিয়া আইতে না কইলে ছেলেডা মারা যাইত না।’ এরপর আর কোনো কথা বলতে পারেননি হৃদয়ের বাবা।
হৃদয়ের খালু জয়নাল মিয়া বলেন, ‘হৃদয়ের মুখের এক পাশ পুইড়া গেছে। দেখলে ডর লাগে। পুইড়া যাওয়া মুখ দেখলে চেনার উপায় নাই।’
জরুরি বিভাগের বাইরে স্ট্রেচারে গুরুতর আহত জামাল শিকদার। বিস্ফোরণে দিনমজুর স্বামীর এমন অবস্থা দেখে মুষড়ে পড়েছেন স্ত্রী মুন্নি বেগম। তিনি গৃহকর্মীর কাজ করেন।
মুন্নি বেগম বলেন, ‘আমার স্বামী মাথায় ও পায়ে গুরুতর আঘাত পেয়েছে। উন্নত চিকিৎসার দরকার। দিন আনি দিন খাই। কীভাবে কী করব ভেবে পাচ্ছি না।’
রাজধানীর ব্যস্ততম এলাকা গুলিস্তানের সিদ্দিকবাজারে মঙ্গলবার বিকাল ৪টা ৫০ মিনিটে একটি ভবনে বিস্ফোরণ ঘটে। এতে পাশের ভবনসহ দুটি ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এতে নিহত হয়েছেন ১৮ জন; যাদের মধ্যে ১৬ জনের মরদেহ রাতেই স্বজনদের হস্তান্তর করা হয়েছে।
এ ছাড়া বুধবার দ্বিতীয় দিনের মতো উদ্ধারকাজ শুরু হয়েছে ভবন দুটিতে। বিস্ফোরণের ঘটনায় এখনও চারজন নিখোঁজের তথ্য জানা গেছে।