বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিবেদক
প্রকাশ : ১১ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ ১০:৩৭ এএম
ঠক-ঠক শব্দে পাল্লা দিয়ে চলা ইঞ্জিনবিহীন এই ঘোড়ার গাড়ি আধুনিককালে এসে জৌলুশ হারিয়েছে। প্রবা ফটো
ইতিহাস, ঐতিহ্য আর সংস্কৃতির পরিপূর্ণ নগরী ঢাকা। প্রাচীনকাল থেকেই এই নগরী ছিল আভিজাত্যে ভরপুর। প্রায় দুইশ বছর আগে রাজা-বাদশা, অভিজাত শ্রেণির মাধ্যমে এই নগরীতে ঘোড়ার গাড়ির প্রচলন হলেও পরে তা সাধারণ মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে যায়। টমটম নামে পরিচিত এই গাড়ি পরিণত হয় জনসাধারণের অন্যতম যানবাহনে। ঠক-ঠক শব্দে পাল্লা দিয়ে চলা তেল-ইঞ্জিনবিহীন এই ঘোড়ার গাড়ি আধুনিককালে এসে জৌলুশ হারিয়েছে।
পুরান ঢাকার বাংলাবাজার মোড় এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, ঢাকা কলেজিয়েট স্কুলের সামনে থেকে যাত্রা শুরু করে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশ দিয়ে গুলিস্তানের গোলাপ শাহ মাজার পর্যন্ত অন্যান্য যানবাহনের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলছে বেশ কয়েকটি ঘোড়ার গাড়ি। সময়ের বিবর্তনে এখনও টিকে থাকলেও জৌলুশ হারিয়ে অস্তিত্ব সংকটে ভুগছে এই যান।
সংশ্লিষ্টরা জানান, এখন গুলিস্তান-সদরঘাট ছাড়াও রাজধানীর ফুলবাড়িয়া, গুলিস্তান, গোলাপশাহ মাজার, বঙ্গবাজার, বকশীবাজার ও কেরানীগঞ্জ এলাকায় ১৫-২০টি গাড়ি চলাচল করে। পুরো শহরে গোটা কয়েক গাড়ি এখনও টিকে থাকলেও নানান সংকটে তারা অস্তিত্ব রক্ষার জন্য লড়াই করছে। আধুনিকতার ছোঁয়ায় নগরের রাস্তা ইঞ্জিনচালিত গাড়ির দখলে যাওয়ার পর থেকেই ঘোড়ার গাড়ির সংখ্যা কমতে শুরু করে। ঢাকায় ঘোড়ার সংখ্যা কমে যাওয়া, ঘাস, ভূসিসহ ওষুধের দাম বৃদ্ধি, যাত্রীদের আগ্রহ হারিয়ে ফেলা ও পিচঢালা রাস্তায় যানজটের কারণে চলাচলে অসুবিধা- এই সংকটের মূল কারণ বলে জানান সংশ্লিষ্টরা।
এখনও টিকে থাকা গাড়িগুলো প্রতিদিন সকাল ১০টা থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত চলে সদরঘাট-গুলিস্তান রোডে। একেকটি গাড়ি প্রতিদিন সর্বোচ্চ ছয়বার সদরঘাট-গুলিস্তান রুটে যাওয়া-আসা করতে পারে। সর্বোচ্চ ১৫ জন যাত্রী একটি টমটম গাড়িতে বসতে পারে। জনপ্রতি ৪০ টাকা করে ভাড়া নেওয়া হয়। তবে বিশেষ দিনগুলোতে ভাড়া হয়ে যায় ৫০ থেকে ৬০ টাকা।
প্রতিটি টমটমে একজন কোচোয়ান ও একজন হেলপার থাকে। কোচোয়ান ঘোড়া নিয়ন্ত্রণ করেন। হেলপার মালামালসহ যাত্রীদের গাড়িতে উঠতে-নামতে সহায়তা করেন। তাদের পারিশ্রমিক ও ঘোড়ার খাদ্যখরচ বাদে প্রতিদিন ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা পর্যন্ত আয় হয় গাড়ির মালিকদের। তবে বিশেষ দিনে এর পরিমাণ ১০০০ টাকা পর্যন্ত হয়। গাড়ির মালিকরা জানান, রাস্তায় খুব বেশি গাড়ি না চললেও পুরান ঢাকার বিয়ে ও বিভিন্ন অনুষ্ঠানে এখনও ব্যবহৃত হয় এই ঐতিহ্যবাহী টমটম গাড়ি। বরযাত্রায় এখনও এর ব্যবহার টিকিয়ে রেখেছে পুরান ঢাকার স্বল্পসংখ্যক পরিবার। তবে আগের চেয়ে অনেকাংটাই কমে এসেছে এর ব্যবহার। ফলে দিনে দিনে বিলীনের পথে হাঁটছে এই গাড়ি।
পুরান ঢাকার বাসিন্দা জাফর ব্যাপারী বলেন, ‘আগে আমগোর পুরান ঢাকায় বহুত ঘোড়ার গাড়ি ছিল। এখন সময় পাল্টাইছে। ঘোড়ার গাড়ির সংখ্যাও কইমা গ্যাছে। আমগো বাপ-দাদারা আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে যাইত ঘোড়ার গাড়িতে চইড়া। এইটা একটা নবাবি কারবার ছিল।’
জামিল হোসেন নামের এক কোচোয়ান বলেন, ‘১৫ বছর থেকে সদরঘাট-গুলিস্তান রুটে টমটম চালাই। এই গাড়ি ঢাকাইয়াদের ঐতিহ্য। আগে মানুষ প্রতিদিনই যাতায়াত করলেও এখন মানুষ শখের বসে ওঠে।’ বিয়ে ও বিভিন্ন উৎসব অনুষ্ঠানের ভাড়া দূরত্ব অনুযায়ী ৫ হাজার থেকে ২০ হাজার টাকা পর্যন্ত বলে তিনি জানান।
টমটম মালিক আহসানউল্লাহ বলেন, ‘ঘোড়ার গাড়ি আমাগো আদি ঢাকাইয়াবাসীর ঐতিহ্য। এখন আগের মতো ঘোড়া ঢাকায় নেই। দিনে দিনে সংখ্যা কমে এসেছে। এখন রাস্তায় যানবাহন বেড়ে যাওয়ায় গাড়ি চালানোটাই কষ্ট। অন্যদিকে ঘোড়ার সঠিক পরিচর্যা করা সম্ভব হচ্ছে না। ভুসি, ঘাসসহ অন্যান্য খাদ্যসামগ্রীর দাম বাড়ায় খরচ অনেক বেড়ে গেছে। অনেক সময় ঘোড়াকে তিনবেলা খাবার দেওয়াও সম্ভব হয় না।’
আরেক মালিক সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘সরকারিভাবে ঠিকমতো চিকিৎসাসেবা পাওয়া যায় না। ফলে রোগাক্রান্ত হয়ে গেলে অনেক ঘোড়া অকালেই মারা যায়। তাছাড়া ঘোড়ার গাড়িতে আগের মতো যাত্রীদের ভিড়ও নেই। অধিকাংশ যাত্রী শখ বা আভিজাত্যের একটা স্বাদ নেওয়ার জন্য এই গাড়িতে ওঠেন।’
ইমরান নামে একজন যাত্রী বলেন, ‘সদরঘাট থেকে গুলিস্তানে বাসে গেলে ভাড়া লাগে ১০ টাকা। টমটমে গেলে ৪০-৫০ টাকা ভাড়া লাগে। বাসে যাওয়াই আমাদের জন্য সহজ। তাই টমটমে এখন আর যাওয়া হয় না।’