ফয়সাল খান
প্রকাশ : ০১ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ ১৬:২৯ পিএম
গুলশান-২ নম্বর স্টপেজে দাঁড়িয়ে আছে। ফাইল ফটো
হাতিরঝিলের পুলিশ প্লাজা থেকে বাস ছাড়ার মাত্র ৩ মিনিটের মাথায় হেলপারের ডাক... ‘গুলশান-১ নামেন’। গুগল ম্যাপ খুলে দেখা গেল এই পথের দূরত্ব মাত্র ১ দশমিক ৩ কিলোমিটার। সরকার নির্ধারিত ২ টাকা ৩৫ পয়সা হিসাবে ভাড়া আসে ৩ টাকার একটু বেশি। অথচ ভাড়া নেওয়া হচ্ছে ৩০ টাকা!
গুলশান-২ থেকে নতুনবাজার বাসস্ট্যান্ড এবং গুলশান-১ থেকে পুলিশ প্লাজা পর্যন্ত সড়কের দূরত্ব ১ দশমিক ৪ কিলোমিটার করে। সরকারের বেঁধে দেওয়া এ দুটি রুটে ভাড়া আসে ৩ টাকা ২৯ পয়সা, নেওয়া হচ্ছে ২৫ টাকা করে। একই অবস্থা গুলশান-১ থেকে গুলশান-২ এবং গুলশান-২ থেকে বনানী রুটেও।
আইনের ফাঁকে স্বল্প দূরত্বের এসব রুটে এভাবেই যাত্রীদের কাছ থেকে ‘গলাকাটা’ ভাড়া আদায় করছে ভিআইপি এলাকার গণপরিবহন ‘ঢাকা চাকা’ ও ‘গুলশান চাকা’। তা ছাড়া হাতিরঝিলের চক্রাকার বাসেও অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করার অভিযোগ পাওয়া গেছে।
নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) সাধারণ গণপরিবহনের ভাড়া নির্ধারণের সময় সর্বনিম্ন ১০ টাকা ধার্য করেছে। কিন্তু ভিআইপি এসব এলাকায় কোনো সড়কেই ২৫ টাকার কম ভাড়া নেই। এর কারণ হিসেবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এসি ও বিশেষ সুবিধাযুক্ত বাসের ভাড়া বিআরটিএ নির্ধারণ করে না। আইনে বিশেষ সুবিধাসম্পন্ন ও শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত গাড়ির ভাড়া নির্ধারণে মালিকদের স্বাধীনতা দেওয়া আছে। সেই সুযোগ কাজে লাগিয়েই কোনো নোটিস ছাড়াই যখন-তখন ভাড়া বৃদ্ধি করা হচ্ছে।
গুলশান-বনানীর রুটগুলোর ভাড়া পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, গুলশান-১ থেকে ২ এর দূরত্ব ১ দশমিক ৭ কিলোমিটার। এখানে সাধারণ পরিবহনের ভাড়া আসে প্রায় ৪ টাকা। কিন্তু নেওয়া হচ্ছে ২৫ টাকা। বনানী থেকে নতুনবাজার বাসস্ট্যান্ডের দূরত্ব প্রায় ৩ কিলোমিটার। এই পথে একসঙ্গে যাতায়াত করলে ভাড়া লাগে ৩০ টাকা। তবে কেউ যদি গুলশনা-২-এ নেমে আবার নতুনবাজার যান তাকে গুনতে হবে ৫০ টকা। অথচ বিআরটিএর নির্ধারিত হারে ভাড়া আসে ৭ টাকার কিছু বেশি। একইভাবে গুলশান-১ থেকে বনানী অথবা নতুন বাজার যেতে হলে ৫০ টাকা দিতে হবে।
জানা গেছে, রাজধানীর ভিআইপি এলাকা খ্যাত গুলশান, বনানী, বারিধারা, নিকেতন ও নতুনবাজার এলাকায় শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বিশেষ এ সার্ভিসের বাসগুলো চলাচল শুরু হয়েছিল ২০১৬ সালে। ওই বছর ১ জুলাই গুলশানের হলি আর্টিজানে জঙ্গি হামলার ঘটনায় নিরাপত্তার অজুহাতে এ এলাকায় সব গণপরিবহন বন্ধ করে দেওয়া হয়। একই বছরের আগস্ট মাসে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রয়াত মেয়র আনিসুল হক ডিএমপি এবং বিভিন্ন সংস্থার প্রতিনিধিদের নিয়ে ‘ঢাকা চাকা’ বাস সার্ভিস চালু করেন। শুরুতে বেশ সুনাম অর্জন করলেও অস্বাভাবিক ভাড়া আদায়ে যাত্রী অসন্তোষ বৃদ্ধি পাচ্ছে।
প্রথমে ৩৫ আসনের শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ১০টি বাস নিয়ে ‘ঢাকা চাকা’ সার্ভিস চালু করে নিটোল টাটা। পরে আরও ২০টি গাড়ি বাড়ানো হয়। ২০১৯ সালের জুলাই মাসে হিমাচল পরিবহন চালু করে ‘গুলশান চাকা’ নামে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত আরেকটি বাস সার্ভিস। বর্তমানে দুটি কোম্পানির আওতায় এসব রুটে শতাধিক বাস রয়েছে। এর মধ্যে প্রতিদিন গড়ে ৮০টি বাস চলাচল করে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
বিশেষ সারকুলার বাস সার্ভিসটি চালুর সময় যেকোনো দূরত্বের ভাড়া ছিল ১৫ টাকা। সেই ভাড়া ৬ বছরে দ্বিগুণ করা হয়েছে, যা অন্যান্য এলাকার ভাড়ার সঙ্গে আকাশ-পাতাল পার্থক্য। এসি এবং আরামদায়ক বাসে কিছুটা বাড়তি ভাড়া থাকাটা স্বাভাবিক হলেও স্বল্প দূরত্বের এসব রুটে যে ভাড়া নেওয়া হচ্ছে তা অনেক বেশি বলে মনে করছেন যাত্রীরা।
সম্প্রতি বনানী থেকে নতুনবাজার আসার জন্য ‘গুলশান চাকা’ বাসে ওঠেন আনিস আহমেদ। কিন্তু ব্যক্তিগত কাজে তাকে গুলশান-২ নামতে হবে। তাই ২৫ টাকা দিয়ে গুলশান-২-এর টিকিট কাটেন তিনি। আলাপকালে আনিস আহমেদ বলেন, ‘কতটুকুই আর দূরত্ব? জ্যাম না থাকলে ৩ মিনিট লাগে। এরপরও এত ভাড়া দিতে হয়। বিকল্প কোনো পরিবহন না থাকায় বাধ্য হয়েই এই বাসে যাতায়াত করি।’
শরিফা ইয়াসমিন নামের এক বেসরকারি চাকরিজীবী জানান, তিনি প্রতিদিন হাতিরঝিল থেকে নতুনবাজার যাতায়াত করেন। ৪ কিলোমিটারের কম দূরত্বের এ পথে ৮০ থেকে ১০০ টাকা খরচ হচ্ছে। তিনি বলেন, ‘এসি বাস, সার্ভিস ভালো। তাই বলে এত বেশিভাড়া নেওয়া অযৌক্তিক। যাদের আয় কম তারাই বাসে চড়েন। আর এই এলাকার বাসভাড়া রিকশা ও সিএনজির চেয়েও বেশি।’
একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মচারী শাহা আলম বলেন, ‘গুলশান-বনানী বলে সবাই বড়লোক না। আমাদের মতো কম আয়ের মানুষের জন্য এসব পরিবহনে চলাচল করা খুবই কষ্টের। অন্য কোনো পরিবহন না থাকায় বাধ্য হয়ে বেশি টাকা দিয়েই চলাচল করতে হচ্ছে।’
ভাড়া বেশির বিষয়টি স্বীকার করছেন কাউন্টার কর্মীরাও। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক কর্মী প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেছেন, ভাড়া নিয়ে প্রতিদিনই যাত্রীরা নানা কথা বলে। কিন্তু আমরা কী করতে পারি। সর্বনিম্ন ভাড়া ১০ টাকা হলে ঠিক ছিল। তারা আরও জানিয়েছেন, গুলশান-পুলিশ প্লাজা-নাবিস্কো রুটের সর্বনিম্ন ভাড়া ৩০ টাকা। বনানী-নতুনবাজার রুটের সর্বনিম্ন ভাড়া ২৫ টাকা।
জানতে চাইলে ‘ঢাকা চাকা’র চেয়ারম্যান মন্টু মিয়া প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, এ ভাড়া নতুন করে বাড়ানো হয়নি। অনেক আগে থেকেই চলছে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সবকিছুর দাম বাড়তি। গাড়ি চালাতে অনেক খরচ হয়। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম বাড়ায় স্টাফদেরও বাড়তি খরচ লাগে। সড়কের দূরত্ব কম হলে যানজটের কারণে অনেক সময় লাগে। ভালো সার্ভিস দিতে গিয়ে খরচ বেড়ে গেছে।
এদিকে, এসি বাস না থাকলেও হাতিরঝিলের চক্রাকার সার্ভিসেও নেওয়া হচ্ছে বাড়তি ভাড়া। যাত্রীদের অভিযোগ, বিএফডিসি কাউন্টার থেকে সর্বনিম্ন টিকিট দেওয়া হয় ২০ টাকার। কোনো যাত্রী যদি আধা কিলোমিটার দূরে নামেন তাও তাকে ২০ টাকার টিকিটই কাটতে হয়। অথচ এই কাউন্টার থেকে পুলিশ প্লাজা কাউন্টারের দূরত্ব মাত্র ১ দশমিক ৩ কিলোমিটার।
রায়হানুল হক নামের এক যাত্রী ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, পুলিশ প্লাজা থেকে বাড্ডা কাউন্টারের দূরত্ব ১ কিলোমিটারও হবে না। এখানে ১৫ টাকা ভাড়া নির্ধারণ করা হলো কীভাবে। লায়ন নামের অন্য একজন যাত্রী বলেন, হাতিরঝিলে একটি মাত্র পরিবহন। তাই তাদের ইচ্ছামতো ভাড়া আদায় করে। বিকল্প না থাকায় আমরাও বাধ্য হয়েই চলাচল করি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সাড়ে ৭ কিলোমিটারের চক্রাকার এ পথে ৮টি কাউন্টারের মাধ্যমে সার্ভিসটি পরিচালনা করা হচ্ছে। দুটি বাদে ৬টি কাউন্টার থেকে সর্বনিম্ন ২০ টাকার কম টিকিট দেওয়া হয় না। পুলিশ প্লাজা থেকে বাড্ডা/রামপুরা এবং মহানগর থেকে এফডিসি মোড় পর্যন্ত ১৫ টাকার দুটি টিকিট রয়েছে।
জানা গেছে, রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) ব্যবস্থাপনায় এ সার্ভিসটি পরিচালিত হয়। বাস পরিচালনার দায়িত্বে থাকা এইচ আর ট্রান্সপোর্টের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, হাতিরঝিলে তাদের ২৩টি বাস রয়েছে। যার মধ্যে প্রতিদিন সকাল ৭টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত ২০টি বাস চক্রাকার এ রুটে চলাচল করে।
এইচ আর ট্রান্সপোর্টের প্রজেক্ট ইনর্চাজ নজরুল ইসলাম দাবি করেছেন, তেলের দাম ও অন্যান্য খাতে বেশি খরচের জন্যই ভাড়া কিছুটা বেড়েছে। তবে দূরত্ব অনুযায়ী কম ভাড়া নির্ধারণ করলে অনেক সময় যাত্রীরা ফাঁকি দেন। তাই বেশিরভাগ কাউন্টারেই কাছাকাছি দামের টিকিট রেখেছি।
বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, সড়ক পরিবহন আইনের ৩৪ নম্বর ধারা অনুযায়ী, কর্তৃপক্ষ গণপরিবহনের ভাড়া নির্ধারণ করবে। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বিলাসবহুল কিংবা বিশেষ সুবিধা সংবলিত গণপরিবহনের ভাড়ার ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম রয়েছে। অযৌক্তিক ভাড়া নির্ধারণ করলে নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষ হিসেবে বিআরটিএ শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে পারবে বলে আইনে উল্লেখ আছে।
এ প্রসঙ্গে বিআরটিএর পরিচালক (রোড সেফটি) শেখ মোহাম্মদ মাহবুব-ই রাব্বানী প্রতিদিনের বাংলাদেশেকে বলেন, এসি ও বিশেষ সুবিধাযুক্ত বাসের ভাড়া আমরা নির্ধারণ করি না। আইন অনুযায়ী তা মালিকপক্ষই নির্ধারণ করে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমাদের কাছে কেউ অভিযোগ করলে ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ আছে। এখনও এ-সংক্রান্ত কোনো অভিযোগ পাইনি। এলাকাবাসী কেউ যুক্তিসংগত অভিযোগ করলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
জানতে চাইলে যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজ্জাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, সব সময় জনগণকে কেন অভিযোগ করতে হবে? বিআরটিএর ভ্রাম্যমাণ আদালত আছে, মনিটরিং সেল আছে। তারা তো জনস্বার্থ বিঘ্নিত হলে নিজেরাই ব্যবস্থা নিতে পারে। অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এখানে যে ভাড়া নেওয়া হচ্ছে, তা কোনোভাবেই যৌক্তিক নয়। বিআরটিএ ব্যবস্থা না নিলে যাত্রীদের পক্ষ থেকে আমরাই অভিযোগ করব।