× ই-পেপার প্রচ্ছদ সর্বশেষ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি শিক্ষা ধর্ম ফিচার ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

শহরজুড়ে নালা-খালে অবৈধ পয়ঃবর্জ্যের সংযোগ

রাহাত হুসাইন

প্রকাশ : ১৪ মে ২০২৫ ১৩:৫৫ পিএম

শহরজুড়ে নালা-খালে অবৈধ পয়ঃবর্জ্যের সংযোগ

রাজধানীর জুরাইনের তিতাস খাল। একসময় খালটি ছিল স্বচ্ছ পানির আধার। এই খাল থেকে তখন মানুষ ওজুর জন্য পানি নিত। স্বাধীনতার পর খনন করা আড়াই কিলোমিটার দীর্ঘ এই খালটি আজ পরিণত হয়েছে আবর্জনা ও পয়ঃবর্জ্যে পূর্ণ এক মৃত জলধারায়। খালটি শুরু হয়েছে পূর্ব জুরাইনের হাজী খোরশেদ আলী সরদার রোড থেকে এবং শেষ হয়েছে দনিয়ায়।

৪৯ বছর ধরে খালের পাশে বসবাস করা স্থানীয় বাসিন্দা জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘ছোটবেলায় দেখেছি, মানুষ এই খালের পানি দিয়ে ওজু করত। এখন এটি হয়ে উঠেছে বাসাবাড়ির পয়ঃবর্জ্য ফেলার সরাসরি সংযোগস্থল। ফলে পানি পচে গিয়ে ছড়ায় তীব্র দুর্গন্ধ। বৃষ্টি হলেই খালের পচা পানি, মলমূত্র রাস্তায় উঠে আসে। পানি নামার পর মল জমে থাকে, চারপাশে ছড়ায় দুর্গন্ধ।

জুরাইন কিংবা তিতাস নয়, দূষণের একই চিত্র দেখা যায় রাজধানীর অন্যান্য খালেও। রাজধানীর অধিকাংশ খালই একইভাবে বাসাবাড়ির সেপটিক ট্যাংকের অবৈধ সংযোগে দূষিত হয়ে পড়েছে। সিটি করপোরেশনের অনুমোদন ছাড়াই আবাসিক ও বাণিজ্যিক ভবন মালিকরা খালে বা ড্রেনে সরাসরি পয়ঃবর্জ্য ফেলছেন। তদারকি না থাকায় এসব সংযোগ বাড়ছেই। অনেক নকশায় সেপটিক ট্যাংক থাকলেও বাস্তবে তা নেই। ঢাকা শহরের একাধিক সংস্থার (রাজউক, ওয়াসা, দুই সিটি করপোরেশন) কাছেই নেই সেপটিক ট্যাংকের নির্ভরযোগ্য তথ্য। ফলে কারা অবৈধভাবে খালে সংযোগ দিয়েছে, কত সংখ্যক ভবনে সেপটিক ট্যাংক নেইÑ তা কেউ নিশ্চিতভাবে জানে না।

সম্প্রতি রাজধানীর বোয়ালিয়া, ডুমনি, ভাটার, কালুনগর, বাউনিয়া ও কল্যাণপুর খালের খালের পাশের ১০ তলা বা তার বেশি ভবনগুলোতে সেপটিক ট্যাংক রয়েছে কি না, তা জানতে গোপনে সমীক্ষা চালায় রাজউক। 

রাজউকের তথ্যমতে, এসব খালের পাশের অধিকাংশ ১০ তলা বা তার বেশি ভবনে সেপটিক ট্যাংক নেই। যেগুলোতে আছে, সেগুলো নিয়মিত পরিষ্কার হয় না। ভবন মালিকদের ইতোমধ্যে সতর্কতামূলক নোটিস পাঠানো হয়েছে। নোটিসে বলা হয়েছে, রাজউক আওতাধীন এলাকায় ড্যাপ (২০২২-৩৫) চিহ্নিত খালগুলোর পার্শ্ববর্তী ভবনগুলোতে সেপটিক ট্যাংক বা এসটিপি (সুয়ারেজ ট্রিটমেন্ট প্লান্ট) স্থাপন না থাকায় সেখানকার পয়ঃবর্জ্য সরাসরি খালে প্রবাহিত হচ্ছে, ফলে খাল ও অন্যান্য জলাশয় ও নিম্নাঞ্চল দূষিত হচ্ছে। এ ধরনের দূষণ রোধে ভবন মালিকদের নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় সেপটিক ট্যাংক বা এসটিপি স্থাপন করতে হবে। এ ব্যাপারে অবিলম্বে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে, অন্যথায় রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে জরিমানা বা প্রয়োজনীয় আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।

রাজউকের প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ মো. আশরাফুল ইসলাম প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, লেআউটে সেপটিক ট্যাংক দেখানো হলেও বাস্তবে তা খালের সঙ্গে যুক্ত। ফলে পয়ঃবর্জ্য সরাসরি খালে যাচ্ছে। সরকারি নির্দেশে আমরা প্রাথমিকভাবে কিছু খালের পাশে সমীক্ষা চালিয়েছি। দেখা গেছে, অল্প কিছু বাড়িতে সেপটিক ট্যাংক আছে, অধিকাংশ বাড়িতে নেই। তারা সরাসরি খালে পয়ঃবর্জ্য ফেলছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঢাকায় পরিকল্পিত পয়ঃবর্জ্য ব্যবস্থাপনার অভাব রয়েছে। পুরোনো ভবনগুলোতে রেট্রোফিটিং করে আলাদা সেপটিক ট্যাংক স্থাপন, নতুন ভবনে বাধ্যতামূলক স্যানিটারি নকশা বাস্তবায়ন ও ওয়ার্ডভিত্তিক স্যানিটারি পরিদর্শক নিয়োগ সময়ের দাবি। আইন প্রয়োগের পাশাপাশি নাগরিক সচেতনতা ও আধুনিক প্রযুক্তির প্রয়োগে সমস্যার স্থায়ী সমাধান সম্ভব। 

পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তন আন্দোলনের (পরিজা) সাধারণ সম্পাদক ফেরদৌস আহমেদ উজ্জ্বল বলেন, ‘শুধু খাল উদ্ধার করলেই হবে না, অবৈধ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করতেই হবে। ওয়াসা, রাজউক ও সিটি করপোরেশনকে সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে।’

এ প্রসঙ্গে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) প্রশাসক মো. শাহজাহান মিয়া প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, খাল ও ড্রেনে অবৈধ সংযোগের বিরুদ্ধে মোবাইল কোর্ট পরিচালনার প্রস্তুতি চলছে। ইতোমধ্যে ২৩ জন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট চেয়ে মন্ত্রণালয়ে আবেদন করা হয়েছে। তারা দায়িত্ব নিলে অবৈধ সংযোগকারীদের বিরুদ্ধে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা শুরু করব। 

উত্তর সিটি করপোরেশনের আওতাভুক্ত খালগুলো দখলমুক্ত ও পরিষ্কার করছে সংস্থাটি। খালের পাড়ে সবুজায়নের উদ্যোগ নিয়েছে। কিন্তু তাতে রয়ে যাচ্ছে অবৈধ পয়ঃসংযোগ। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রশাসক মোহাম্মদ এজাজ প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, গুলশানসহ বিভিন্ন এলাকায় যেসব ভবনের পয়ঃবর্জ্য সরাসরি খালে যাচ্ছে, তাদের তালিকা তৈরি করা হচ্ছে। পাশাপাশি ক্ষুদ্র ট্রিটমেন্ট প্লান্ট স্থাপনের সম্ভাব্যতা যাচাই চলছে। এ উদ্যোগ পানি উন্নয়ন বোর্ডের আওতায় বাস্তবায়ন করা হবে।

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্লানার্সের (বিআইপি) সাধারণ সম্পাদক শেখ মুহম্মদ মেহেদী আহসান প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, পানি নিষ্কাশন ও পয়ঃনিষ্কাশন দুটি পৃথক ব্যবস্থা হওয়া উচিত। কিন্তু ঢাকায় তা গুলিয়ে গেছে। ওয়াসার দায়িত্ব সুয়ারেজ নেটওয়ার্ক তৈরি ও রক্ষণাবেক্ষণ। কিন্তু তাদের গাফিলতির জন্যই অন্যান্য সংস্থার খাল রক্ষার প্রচেষ্টা ব্যাহত হচ্ছে।

তথ্য অনুযায়ী বর্তমানে রাজধানীর মাত্র ২০ শতাংশ এলাকায় ওয়াসার পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা রয়েছে। বাকি ৮০ শতাংশ পয়ঃবর্জ্য কোনো ট্রিটমেন্ট ছাড়াই খাল, নালা ও নদীতে গিয়ে পড়ছে। নগরবাসী নিয়মিত বিল দিলেও পাচ্ছে না কাঙ্ক্ষিত সেবা।

পয়ঃবর্জ্য ড্রেন বা খালে ফেলা ঠেকাতে ওয়াসা তদারকির বিষয়ে জানতে চাইলে সংস্থাটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. ফজলুর রহমান প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, আমাদের প্রত্যেক জোনে টিম আছে, যারা অবৈধ সংযোগের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়, সংযোগ বন্ধ করে ও জরিমানা আদায় করে। 

তবে বাস্তব চিত্র বলছে অভিযোগ থাকলেও কার্যকর পদক্ষেপের প্রমাণ নেই। ঢাকার খালগুলো এখন কেবল নোংরা পানি নয়, বরং শহরের পরিকল্পনা ও দায়িত্ববোধহীনতার প্রতিচ্ছবি। পয়ঃবর্জ্য ব্যবস্থাপনায় শক্ত নীতি, কঠোর নজরদারি এবং নাগরিক অংশগ্রহণ ছাড়া এই সমস্যা নিরসনের কোনো উপায় নেই। এখনই না জাগলে ভবিষ্যতের ঢাকা হবে আরও ভয়াবহ এক নর্দমার শহর।

শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক : মোরছালীন বাবলা

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা