রাহাত হুসাইন
প্রকাশ : ১৮ এপ্রিল ২০২৫ ০৯:০৯ এএম
আপডেট : ১৮ এপ্রিল ২০২৫ ১০:৫২ এএম
মুসলিমদের শেষ গন্তব্য কবরস্থান। সেই যাত্রার প্রস্তুতকারীরা হলেন গোর খোদক। ঢাকার দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের বিভিন্ন কবরস্থানে তারা ঠিকাদারের অধীনে কাজ করেন। সংস্থাটির কবরস্থান পরিচালনার নীতিমালায় বলা হয়েছে, কবর খনন এবং দাফনের সরঞ্জাম সরবরাহ করবে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। বাজারদরের সঙ্গে মিলিয়ে প্রাক্কলনের মাধ্যমে নির্ধারণ হবে শ্রমমূল্য। কিন্তু বাস্তবে কেবল কাগজেই নিয়ম আছে। ঠিকাদারের অধীনে চাকরি থাকলেও গোর খোদকদের নেই বেতন, নেই নিয়োগপত্র। পরিচয়পত্রই একমাত্র দলিল। তাদের সংসার চলে মৃতের স্বজনদের দেওয়া টাকায়।
রাজধানীর কবরস্থানে যারা গোর খোঁড়েন, তাদের জীবনও যেন কবরের মাটির মতো- চুপচাপ, ভারী আর সবার নজরের বাইরে। নেই কোনো ছুটি, অবসরের দিন। রোদ, বৃষ্টি, রোজা ও ঈদের দিনও- সবকিছুর ঊর্ধ্বে গিয়ে তাদের কবর খুঁড়তে হয়। লাশ এলে মেলে খোরাকির টাকা। দাফন না হলে আয় নেই। দিনটি যায় একেবারে ফাঁকা। এক ধরনের অনিশ্চয়তা নিয়েই দিন কাটে তাদের। পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে কম মজুরি হয়তো গোর খোদকদেরই। প্রতি কবর খোঁড়ার জন্য ঢাকা দক্ষিণ সিটির জুরাইন, ধলপুর, মুরাদপুর, খিলগাঁও কবরস্থানে মজুরি নির্ধারণ করা হয়েছে তিন টাকা। আর আজিমপুর কবরস্থানে গোর খোঁড়া সর্বনিম্ন ৫ টাকা এবং সর্বোচ্চ ১১ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। সিটি করপোরেশন যে মজুরি নির্ধারণ করেছে, তা প্রতীকী বললেও কম বলা হয়। তাদের সংসার চলে মূলত মৃত ব্যক্তির স্বজনদের দেওয়া টাকায়, যার পরিমাণ নির্ধারিত নয়।
এই নগর তাদের শ্রম নেয়, মৃত্যুতে তাদের ডাক পড়ে, অথচ জীবনের খাতায় তাদের কোনো স্বীকৃতি নেই। তারা শহরের সবচেয়ে নীরব শ্রমিক। গোর খোদকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তারা প্রতিদিন দুই শিফটে কাজ করেন। প্রথম শিফট সকাল ৬টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত, দ্বিতীয় শিফট দুপুর ২টা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত। প্রতিদিন সকালে তারা নির্ধারিত স্থানে অবস্থান নেন। লাশের জন্য অপেক্ষা করেন। লাশ এলে দাফনের জন্য তাদের ডাক পড়ে। শাবল-কোদাল হাতে ছুটে যান কবর খুঁড়তে। অনেক সময় মৃত ব্যক্তির স্বজনরাই আগেভাগে কবর খুঁড়ে রাখতে বলেন। কবর খুঁড়লে মৃত ব্যক্তির স্বজনদের কেউ পাঁচশ, কেউ এক হাজার আবার কেউবা ১৫০০ টাকাও দেন। কোনো দিন আবার বিনা পয়সায় কবর খুঁড়ে দিতে হয়। এমনও দিন যায়, কোনো লাশই আসে না।
আড়াই বছর ধরে জুরাইন কবরস্থানে ঠিকাদারের অধীনে কাজ করেন মো. খোকন। তার বাসা গেন্ডারিয়ার শহিদ নগর। তার বাবা আগে জুরাইন কবরস্থানে গোর খোদক ছিলেন। বাবা অসুস্থ হওয়ার পর থেকে তিনি এ কাজে যুক্ত হন। লাশের জন্য কবর খুঁড়েই সংসার চালাতেন তারা বাবা। ছিল না অন্য কোনো কর্ম বা পেশা। খোকন প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, আমার বাবা প্রায় ২৬ বছর জুরাইন কবরস্থানে কাজ করেছেন। তিনি স্ট্রোক করার পর থেকে আমি এ কাজে যোগ দিই। মেসার্স বিসমিল্লাহ এন্টারপ্রাইজ আমাকে একটি পরিচয়পত্র দিয়েছে। তবে আমাদের কোনো বেতন দেওয়া হয় না। কবর খোঁড়ার পর মৃত ব্যক্তির আত্মীয়স্বজন খুশি হয়ে যে টাকা দেন, তাই দিয়েই আমাদের সংসার চলে। অনেক সময় লাশের জন্য কবর খুঁড়লেও আমরা টাকা পাই না। বেওয়ারিশ লাশের জন্যও কবর খুঁড়ে দিই। যে টাকা পাই তা দিয়ে ঠিকমতো সংসার চলে না। টানাটানি আর ঋণ করে চলতে হয়। আমাদের ভবিষ্যৎ কী হবে, একমাত্র আল্লাহ জানেন। আমাদের যদি সিটি করপোরেশন থেকে একটা বেতন নির্ধারণ করা হয়, তাহলে ভালো হতো। বেতন পেলে লাশের স্বজনদের কাছে হাত পাতব না আমরা।
জুরাইন কবরস্থানের মতো আজিমপুর পুরাতন কবরস্থানে মৃত ব্যক্তির লাশ দাফনের কাজ করেন নুর ইসলাম শেখ। তবে তিনি গোর খোদক নন। তিনি শুধু দাফনের সময় মাটি দিয়ে কবর ভরাট করেন। আজিমপুর কবরস্থানে গোর খোঁড়ার জন্য আলাদা লোক রয়েছে। তিনি প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, আমরা কবর খুঁড়ি না। আমাদের কাজ লাশ দাফন করা। কবর খোঁড়ার টিম আলাদা। মৃত ব্যক্তির স্বজনরা খুশি হয়ে যে টাকা-পয়সা দেন, তা দিলে কোনোমতে চলে যায় সংসার। এ ছাড়া কবরে পানি দিলে, দেখেশুনে রাখলে আরও কিছু টাকা-পয়সা পাওয়া যায়।
আজিমপুর কবরস্থানে ঠিকাদারের নিয়োগ করা ৮৪ জন গোর খোদক দুই শিফটে কাজ করেন বলে জানিয়েছেন অতিরিক্ত দায়িত্বপ্রাপ্ত মোহরার মাওলানা হাফিজুর রহমান মোহরার। তিনি বলেন, প্রথম শিফট সকাল ৬টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত ৪২ জনের একটা গ্রুপ কাজ করে। আর দুপুর ২টা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত ৪২ জনের আরেকটি গ্রুপ কাজ করেন। ঠিকাদারের নিয়োগ ছাড়াও বেশকিছু লোক কবরস্থানে কাজ করেন। তাদের কোনো ধরনের নিয়োগ দেওয়া হয়নি। তাদের কোনো পরিচয়পত্র নেই। মেসার্স সুজন ভূঁইয়া অ্যান্ড ব্রাদার্স আজিমপুর কবরস্থানের ঠিকাদার।
শহরের এই নীরব শ্রমিকদের প্রসঙ্গে ন্যাশনাল ওয়ার্কার্স ইউনিটি সেন্টারের সভাপতি সুলতানা বেগম প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, কেউ মারা গেলে, পরিবার সবার আগে খোঁজে একজন গোর খোদক। গ্রামীণ জীবনে অনেকে স্বেচ্ছায়, নিজের ইচ্ছাতেই কবর খুঁড়ে দেন। কিন্তু রাজধানী ঢাকার কবরস্থানগুলোতে গোর খোঁড়ার কাজটি বংশপরম্পরায় করে আসছেন কিছু মানুষ। তারা মাটি খোঁড়েন, গর্ত তৈরি করেন, বাঁশ বসান, আর মৃত মানুষটিকে প্রস্তুত করে দেন চিরঘুমের জন্য। তবুও শহরের কোনো উন্নয়ন পরিকল্পনায় নেই তাদের নাম। সরকারি কোনো তালিকায় নেই তাদের পেশা। শ্রমিক হিসেবেও নেই কোনো স্বীকৃতি। স্থানীয় সরকার ও সিটি করপোরেশনের উচিত, কবরস্থান ব্যবস্থাপনার নীতিমালা সংশোধন করে গোর খোঁড়ার কাজটিকে একটি স্বীকৃত পেশা হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা।
পুরান ঢাকা নাগরিক ফোরামের মুখপাত্র ইবকাল কবির প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, কবর খোঁড়ার কাজ শুধু শারীরিক শ্রম নয়, তা মানসিকভাবে কঠিনও। কারণ তারা প্রতিদিন দেখেন শোক, কান্না, বিচ্ছেদ। তারপরও স্বজনরা অনেক সময় খিটখিটে মেজাজে তাদের সঙ্গে কথা বলেন, ধমক দেন, এমনকি বকাবকি করতেও ছাড়েন না। অথচ তারা জানেন না- এই মানুষগুলো দিনে একাধিক কবর খুঁড়ে সংসার চালান, বিনিময়ে পান যৎসামান্য কিছু টাকা। অনেক সময় টাকা না দিয়ে স্বজনরা তাদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেন। তারা হয়তো মনে করেন গোর খোদকরা সরকারি বেতন পান। আসলে তারা সিটি করপোরেশন থেকে কোনো বেতন-ভাতা পান না। সিটি করপোরেশন কেবল কবর রেজিস্ট্রেশনের জন্য নির্ধারিত ফি নেয়। তবে কবর খোঁড়ার জন্য নগরবাসীকে আলাদা টাকা দিতে হয়, যার কোনো নির্ধারিত হার নেই। এ খাতে নির্দিষ্ট ফি নির্ধারণ করলে তা নগরবাসী ও গোরখোদক- উভয়ের জন্যই উপকারী হবে। আইন সংশোধনের মাধ্যমে গোর খোদকদের ‘মাস্টার রোলে’ অন্তর্ভুক্ত করে নিয়মিত বেতন-ভাতা দেওয়া যেতে পারে।
গোর খোদকদের কেউ কেউ এ কাজে এসেছেন বংশপরম্পরায়। আবার কেউ এসেছেন জীবনের চাপে, কোনো কাজ না পেয়ে। তবে সন্তানদের এ কাজে আনবেন না তারা। এমনটাই জানিয়েছেন জুরাইন কবরস্থানের গোর খোদক আব্দুল কুদ্দুস। তিনি প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, কবর খোঁড়ার জন্য ঠিকাদার ৩ টাকা আর দুই টাকা নির্ধারণ করেছে। এক কাপ চা খেতেও ১০ টাকা লাগে। সমাজে আমাদের তেমন গুরুত্ব নেই। মেয়ে বিয়ে দিতে গেলে জিজ্ঞেস করে বাবা কী করেন? গোর খোদক বললে অনেক সময় সম্পর্ক হয় না। সিটি করপোরেশন যদি আমাদের বেতন-ভাতা দিত, তাহলে কাজটা সম্মানজনক হতো। আমি এ কাজে এসে ভুল করেছি। আমার ছেলেকে এ কাজে নিয়ে আসব না।
এ বিষয়ে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান সমাজকল্যাণ ও বস্তি উন্নয়ন কর্মকর্তা (উপসচিব) মোহাম্মদ মোবাশ্বের হাসান প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, কবর খোঁড়ার বিষয়টি ঠিকাদারের অংশ। সিটি করপোরেশনের কবর ব্যবস্থাপনার নীতিমালায় তা স্পষ্ট উল্লেখ রয়েছে। সামনে আমরা প্রাক্কলনটাকে যৌক্তিক হারে উপস্থাপন করব। ঠিকাদার কীভাবে এ বিষয়টি ম্যানেজ করবে, এটা তার বিষয়। আগে তো আমি এ দায়িত্বে ছিলাম না।