প্রবা প্রতিবেদক
প্রকাশ : ১৩ এপ্রিল ২০২৫ ১০:২৪ এএম
গুলশান-বনানীর সিসা বারে মাদক কারবারি সাইফুল ইসলাম জুয়েল (বাঁ থেকে দ্বিতীয়)
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে স্বৈরাচার আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব নেন নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস। শুরুতেই দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি উন্নয়নের পাশাপাশি মাদকের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করে সরকার। মাদক ব্যবসা বন্ধে বিভিন্ন স্পটে অভিযান জোরদারের পাশাপাশি মাদক কারবারিদের একের পর এক গ্রেপ্তার করতে থাকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী। সরকারের নেওয়া এসব পদক্ষেপে আশাবাদী হয়ে ওঠেন সাধারণ মানুষ এবং ভালোমানের হোটেল ব্যবসায়ীরা। তারা ভাবতে থাকেন এখন থেকে আর কাউকে নানা অজুহাতে মোটা অঙ্কের মাসোহারা গুনতে হবে না। শিকার হতে হবে না হয়রানির।
সরকারের এসব ভালো পদক্ষেপের পরও অগোচরে রাজধানীর অভিজাত এলাকা গুলশান, বনানী জোনের হোটেল, সিসাবার, বার এবং বিভিন্ন মাদক স্পট থেকে প্রতি মাসে প্রায় কোটি টাকার চাঁদা উঠানোর অভিযোগ উঠেছে মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের উত্তর জোনের দুই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে। আর তাদের চাঁদাবাজির এ সব ঘটনা এখন অনেকটাই ওপেন সিক্রেট। দাবিকৃত চাঁদা না পেলে লোকদেখানো অভিযানও চলিয়ে থাকে সংশ্লিষ্ট হোটেল, বারসহ মাদক স্পটগুলোতে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এসব প্রকাশ্য চাঁদাবাজির সবকিছুই নিয়ন্ত্রণ করেন মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের ঢাকা মেট্রো উত্তরের সহকারী পরিচালক মো. এনায়েত হোসেন এবং গুলশান সার্কেলের পরিদর্শক আতাউর রহমান। মূলত আতাউর রহমানই ওই জোনের ক্যাশিয়ার হিসেবে পরিচিত। যশোরের বাসিন্দা আতাউর রহমান গত স্বৈরাচার সরকারের আমলে নিজেকে আওয়ামী লীগের নেতা পরিচয় দিয়ে শেখ হেলালের সঙ্গে সখ্য গড়ে তোলেন।
খুলনায় থাকাকালীন যশোরের কেশবপুরে মাদক স্পট থেকে চাঁদাবাজি করতে গিয়ে গণধোলাইয়ের শিকার হন আতাউর রহমান। এই ঘটনার পর তাকে শাস্তিমূলক পদক্ষেপ হিসেবে খাগড়াছড়িতে বদলি করা হয়। সেখানে থেকে আওয়ামী লীগ নেতার মাধ্যমে তদবির করে ফরিদপুরে বদলি হন। ফরিদপুরে ৪ মাস থাকার পর শেখ হেলালের সুপারিশে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে ২০২৪-এর ফেব্রুয়ারিতে ফের খুলনায় বদলি হয়ে আসেন।
অভিযোগ রয়েছে, গত বছরের ৫ আগস্ট রাজনৈতিক পটপরিবর্তন হলে নিজেকে বিএনপি নেতা দাবি করে খালিদ হোসেন নামে মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরে এক তদবিরকারকের (দালাল) মাধ্যমে ৩৫ লাখ টাকার বিনিময়ে ঢাকায় আসেন আতাউর রহমান। এরপর তাকে পোস্টিং দেয়া হয় লাভজনক এলাকা হিসেবে পরিচিত গুলশান জোনে। এই জোনেই ৪২টি সিসাবার, অর্ধশতাধিক হোটেল এবং বড় বড় কয়েকটি মাদক স্পট রয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, এ সব মাদক স্পটের দেখাশোনা করেন এই আতাউর। আরও অভিযোগ রয়েছে, মাদক ও পতিতার দালাল হিসেবে পরিচিত সিসা জুয়েলের মাধ্যমে ৪২টি সিসা স্পট থেকে নিয়মিত মাসোহারা তুলে থাকেন আতাউর। এই সিসা জুয়েলই নির্ধারণ করেন কোন স্পট থেকে কত টাকা তুলতে হবে। সিসা জুয়েল শুধু মাদক ব্যবসায় নয়, বিভিন্ন হোটেলে নারী সাপ্লাই চেনের কাজও করে থাকেন। দুবাইসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশেও রয়েছে সিসা জুয়েলের পতিতা সাপ্লাইয়ের নেটওয়ার্ক।
সম্প্রতি মোটা অঙ্কের দাবিকৃত চাঁদা না পেয়ে বনানীর একটি হোটেলে তথাকথিত অভিযান চালিয়ে ৩ হোটেল কর্মকর্তা-কর্মচারীকে আটক করে চালান দেয়ার ঘটনায় আলোচনায় আসেন মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের পরিদর্শক আতাউর রহমান, সহকারী পরিচালক এনায়েত হোসেন এবং মাদক ও নারী ব্যবসায়ী সিসা জুয়েল।
গত বৃহস্পতিবার গভীর রাতে বনানীর ইউনিক রিজেন্সি হোটেলে অভিযান চালিয়ে মদের কিছু খালি বোতল উদ্ধার করে ওই হোটেলের তিন কর্মকর্তা-কর্মচারীকে আটক করে বনানী থানায় মামলা দায়ের করেন পরিদর্শক আতাউর নিজেই।
হোটেল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, ইউনিক রিজেন্সি হোটেলে কখনও অবৈধ কোনো ব্যবসা হয় না। যে খালি বোতলগুলো উদ্ধার করা হয়েছে তা একজন কাস্টমারের; যার মদ খাওয়ার লাইসেন্স রয়েছে। ৩০ লাখ টাকা এককালীন চাঁদা এবং প্রতি মাসে ৫ লাখ টাকা চাঁদা না পেয়ে মাদক ও নারী ব্যবসায়ী জুয়েলের সহযোগিতায় ওই হোটেলে অভিযান চালিয়ে একটি সাজানো নাটক বানায় মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের ঢাকা মেট্রো উত্তর সার্কেলের এই অসাধু দুই কর্মকর্তা। যাদের গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে তারা কেউই মাদক সেবনতো দূরের কথা ধূমপানও করেন না।
হোটেলের সিসি টিভির ফুটেজ থেকে দেখা গেছে, মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর ঢাকা মেট্রোর কর্মকর্তারা অভিযান পরিচালনার সময় হোটেল কর্মকর্তাদের সঙ্গে অহেতুক তর্কে জড়িয়ে যান। একপর্যায়ে তারা লাথি মেরে হোটেলের এক কর্মচারীকে মেঝেতে ফেলে দেন এবং এলোপাথাড়ি কিলঘুসি মারতে থাকেন।
মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের এই কর্মকর্তাদের এমন আচরণে হোটেলে অবস্থানরত বিদেশি অতিথি এবং চারপাশের লোকজন হতবাক বনে যান। তারা এই ঘটনার তাৎক্ষণিক প্রতিবাদও জানায়।
কে এই সিসা জুয়েল
পুলিশ, মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর এবং ঢাকার আন্ডারওয়াল্ডে সিসা জুয়েল এক পরিচিত নাম। নারায়ণগঞ্জের বাসিন্দা সাহাবুদ্দিনের ছেলে রাইসুল ইসলাম জুয়েল একসময় নিজেকে ছাত্রলীগের নেতা পরিচয় দিতেন। আওয়ামী লীগের সময় মন্ত্রী, এমপিসহ রাজনৈতিক নেতা, পুলিশ কর্মকর্তা, সরকারি পদস্থ কর্মকর্তাদের কাছে তরুণী, উঠতি বয়সি কথিত মডেল সরবরাহ করতেন। এসব অপকর্মের সুবাদে আওয়ামী লীগের সাবেক মন্ত্রী, এমপি ও সরকারি কর্মকর্তাদের সঙ্গে তার বিশেষ সম্পর্ক গড়ে ওঠে। আর ওপর মহলে এই সম্পর্ক ব্যবহার করে আওয়ামী লীগের সময় বনানী ও গুলশান এলাকায় নির্বিঘ্নে অবৈধ মাদক কারবার ও পতিতা ব্যবসা করতেন মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের তালিকাভুক্ত মাদককারবারি সিসা জুয়েল।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হলেও সিসা জুয়েল রয়ে গেছেন বহাল তবিয়তে। এখনও তিনি নির্বিঘ্নে চালিয়ে যাচ্ছেন মাদক ও নারী সাপ্লাইয়ের করবার। সিসা জুয়েলের বিরুদ্ধে একাধিক মামলা থাকলেও প্রশাসনের চোখ এড়িয়ে থেকে যাচ্ছেন ধরাছোঁয়ার বাইরে।
এদিকে মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের অসাধু এই দুই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অসংখ্য অভিযোগ রয়েছে। পর্যায়ক্রমে তা প্রকাশ করা হবে।