ইউছুব ওসমান, জবি
প্রকাশ : ১৫ মার্চ ২০২৫ ১০:১৭ এএম
দেশের অন্যতম পাইকারি বাজার পুরান ঢাকার ইসলামপুরে ঈদের কেনাকাটার ব্যস্ততা। প্রবা ফটো
মুসলমানদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব ঈদুল ফিতর ঘিরে দেশের বিভিন্ন শপিং কমপ্লেক্সে ব্যস্ততা বেড়েছে। ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করতে পরিবারের সদস্যদের জন্য নতুন পোশাক কিনছেন প্রায় প্রত্যেকেই। এরই ধারাবাহিকতায় ব্যস্ততা বেড়েছে পুরান ঢাকার ঐতিহ্যবাহী পাইকারি কাপড়ের বাজার ইসলামপুরেও। নতুন পোশাকের বেচাকেনা নিয়ে ব্যস্ত সময় পার করছেন এই বাজারের ব্যবসায়ীরা। দিন দিন বাড়ছে ক্রেতাদের আনাগোনা। জমে উঠেছে এই এলাকার প্রতিটি পাইকারি মার্কেট। দোকানগুলোতে সারি সারি সাজানো রঙিন কাপড়, নতুন নতুন ডিজাইনের পোশাক আর পাইকারি ক্রেতার ভিড়ে মুখর হয়ে উঠেছে পুরো এলাকা।
পুরান ঢাকার ইসলামপুর দেশের বৃহত্তম পাইকারি কাপড়ের বাজার হিসেবে পরিচিত। দেশজুড়েই রয়েছে এর সুপরিচিতি। সারা দেশ থেকেই পাইকারি ক্রেতারা ভিড় করেন এই বাজারে। এখান থেকে পাইকারি পোশাক কিনে দেশের বিভিন্ন জায়গায় ব্যবসা করেন ব্যবসায়ীরা। এখানকার ব্যবসায়ীরা মূলত সালোয়ার-কামিজ, থ্রি পিস, পাঞ্জাবি, শাড়ি, লুঙ্গি ও বোরকার কেনাবেচা করেন। তবে দেশি-বিদেশি নামিদামি ব্র্যান্ডের থানকাপড়, গজ কাপড়, শার্ট-প্যান্টের কাপড়সহ বিভিন্ন ধরনের পোশাকসামগ্রীও পাওয়া যায় এখানে।
জানা গেছে, মোগল আমলে বাংলার সুবাদার ইসলাম খাঁ চিশতির নামানুসারে ইসলামপুরের নামকরণ হয়। তবে এখানে পাইকারি কাপড়ের ব্যবসা শুরু হয় ১৭৭৩ সালে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সময়। তার আগে এই এলাকা ফলের জন্য বিখ্যাত ছিল, বিশেষ করে আমের জন্য। যার কারণে একসময় এলাকাটির নাম ছিল ‘আমপট্টি’। সে আমপট্টিই পরবর্তী সময়ে রূপ নেয় বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান বস্ত্র ব্যবসায়িক কেন্দ্রে। আমপট্টি নামটি পরিবর্তিত হলেও ফলের বাজার আগের মতোই রয়েছে, যা এখন পরিচিত বাদামতলী ফলের আড়ত নামে। ইসলামপুরের কাপড়ের ব্যবসা একসময় সদরঘাটসহ আশপাশের এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে। বর্তমানে বিক্রমপুর গার্ডেন সিটি, গুলশান আরা সিটি, সাউথ প্লাজা, জাহাঙ্গীর টাওয়ার, চায়না মার্কেটসহ দেড় শতাধিক মার্কেটে পোশাক ও কাপড় বেচাকেনা হয়। এসব মার্কেটে ১০ হাজারের বেশি দোকান রয়েছে।
সরেজমিন দেখা গেছে, এখানে দেশি-বিদেশি থান কাপড় থেকে শুরু করে শাড়ি, লুঙ্গি, থ্রি পিস, বাচ্চাদের পোশাক, বিছানার চাদর, পর্দার কাপড় ইত্যাদির বিশাল সংগ্রহ রয়েছে। এ ছাড়া বোতাম, জিপার, ইলাস্টিকসহ পোশাক তৈরির প্রয়োজনীয় সব উপকরণও পাওয়া যায়। এসব পোশাক ও থান কাপড় দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে পাইকারি ক্রেতারা এসে কিনে নিয়ে যান। বছরজুড়ে ব্যস্ততা থাকলেও ঈদ মৌসুমে এই বাজারের ব্যস্ততা পৌঁছে যায় অন্য মাত্রায়। সরগরম হয়ে ওঠে পুরো এলাকা।
ইসলামপুরের ব্যবসায়ীরা দেশের বিভিন্ন বস্ত্রকল থেকে কাপড় তৈরি করে আনেন। এখানকার অনেক ক্ষুদ্র ও মাঝারি বস্ত্রকল মালিকদের নিজস্ব দোকানও রয়েছে। আবার কোনো কোনো বস্ত্রকল থেকে এই বাজারে কাপড় সরবরাহ করা হয়। পাশাপাশি ভারত ও পাকিস্তান থেকে কাপড় আমদানি করেন এখানকার অনেক আমদানিকারক। এ ছাড়া রপ্তানিমুখী তৈরি পোশাক কারখানার পোশাকও ইসলামপুরে বিক্রি করেন ব্যবসায়ীরা। এখানকার ব্যবসায়ীরা শাড়ি, লুঙ্গি, থ্রি-পিসসহ বিভিন্ন পোশাক দেশীয় বস্ত্রকল থেকে তৈরি করে আনেন। ঈদ সামনে রেখে ইসলামপুরের আশপাশে ছোট ছোট কারখানাতেও এখন ব্যস্ততা বেড়েছে। গাড়িবোঝাই পোশাক ও কাপড় আনা হচ্ছে দোকানগুলোতে। আবার ক্রেতারাও গাড়িবোঝাই কাপড় কিনে নিয়ে যাচ্ছেন এই পাইকারি বাজার থেকে। সন্ধ্যা হলেই আশপাশের এলাকার কুরিয়ার সার্ভিসগুলোতেও বেড়ে যায় ব্যস্ততা। দেশের বিভিন্ন প্রান্তের ব্যবসায়ীরা কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে এই পাইকারি মার্কেট থেকে কেনা পোশাক নিয়ে যাচ্ছেন।
ইসলামপুরের ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত বছরের তুলনায় এবার ঈদকেন্দ্রিক তৈরি পোশাকের বেচাকেনা বেড়েছে। শবেবরাতের পরের ১৫ দিন বিক্রি জমে ওঠে। প্রথম দিকে বিক্রি-বাট্টা কিছুটা কম থাকলেও ঈদ ঘনিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে তা বাড়ছে। আর রোজার শেষের দিকে বেচাকেনা আরও বাড়বে বলে আশা করছেন ব্যবসায়ীরা।
কাইজান ফেব্রিক্সের বিক্রেতা ইমরুল কায়েস বলেন, ইসলামপুরে রোজা শুরুর আগে থেকেই ব্যস্ততা শুরু হয়। আমরা আগে থেকেই প্রস্তুতি নিয়ে থাকি। শবেবরাতের পর থেকেই ব্যবসার মূল সময়। তবে শুরুর দিকে ক্রেতা কিছুটা কম ছিল। এখন তা বেড়েছে। দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে ক্রেতারা আসছেন। এবার বেচাকেনা ভালো হবে বলে আশা করছি।
ইসলামপুরের নিউ লামিয়া ফ্রেবিক্স দোকানের কর্মচারী রিয়াজ উদ্দিন বলেন, আমাদের মূল বেচাকেনা শুরুর দিকে হয়। এখন ধীরে ধীরে ক্রেতা বাড়ছে। আমরা ক্রেতাদের চাহিদার কথা বিবেচনায় প্রস্তুতি নিয়েছি। আশা রাখছি এবার ভালো ব্যবসা করতে পারব।
অঙ্গ ফ্যাশনের বিক্রেতা খোরশেদ আলম বলেন, আমরা পাইকারি থ্রি পিস বিক্রি করি। এইবার শুরু দিকে পাইকারি কাপড় তেমন বিক্রি হয়নি। তবে এখন ধীরে ধীরে বাড়ছে। আমরা এখন থেকে খুচরা বিক্রিরও সিদ্ধান্ত নিয়েছি। সব ধরনের কাপড়ই আছে।
আরএইচ ক্লোথের মালিক রাসেল মজুমদার বলেন, এবার সুতি কাপরের ডিমান্ড বেশি। এইবার ঈদের বাজারে অনেক ভালো বিক্রি হচ্ছে। গরম পড়ে গেছে, তাই সুতি কাপড়গুলাই বিক্রি হচ্ছে। এবার বিক্রি নিয়ে সন্তুষ্ট। আশা করছি বিক্রি আরও বাড়বে।
ঈদ যত ঘনিয়ে আসছে, বাজারে পাইকারি ক্রেতাদের পাশাপাশি খুচরা ক্রেতার ভিড়ও বাড়ছে। ব্যবসায়ীরা বলেছেন, ঈদ যত এগিয়ে আসবে খুচরা ক্রেতাদেরও ভিড়ও বাড়বে। দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে ক্রেতা ও ব্যবসায়ীদের নিরাপত্তা নিশ্চিতের আহ্বান জানিয়েছেন তারা।
নিরপত্তার বিষয়ে ডিএমপির কোতোয়ালি জোনের এসি ফজলুল হক বলেন, এই এলাকায় ব্যবসা আগে থেকেই শুরু হয়। আমরা রোজার আগে থেকেই নিরাপত্তা জোরদার করেছি। নিয়মিত আমরা টহল জোরদার করেছি। বিশেষ টহলও দেওয়া হচ্ছে। কয়েকটি পয়েন্টে চেকপোস্টও বসানো হয়েছে। ক্রেতা-বিক্রেতাদের নিরাপত্তায় আমরা সচেষ্ট আছি।