× ই-পেপার প্রচ্ছদ সর্বশেষ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি শিক্ষা ধর্ম ফিচার ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

ঢাকা সিটি করপোরেশন

‘বেকার’ পড়ে আছে খাদ্য পরীক্ষার ল্যাব

রাহাত হুসাইন

প্রকাশ : ১১ মার্চ ২০২৫ ১০:১১ এএম

আপডেট : ১১ মার্চ ২০২৫ ১০:৫৬ এএম

‘বেকার’ পড়ে আছে খাদ্য পরীক্ষার ল্যাব

রাজধানীর বঙ্গবাজার মোড়। ফুলবাড়িয়ার কাজী আলাউদ্দীন রোড। এই রোডটির মোড়ের দক্ষিণ-পশ্চিম পাশে দাঁড়িয়ে আছে সোনালি রঙের একটি পাঁচতলা ভবন। ভবনটিতে তিনটি ডিজিটাল সাইনবোর্ড রয়েছে। তবে সাইনবোর্ডগুলোর লেখা ধূসর হয়ে গেছে। সাইনবোর্ড দেখে ভবনটির পরিচয় বুঝতে বেগ পেতে হবে যে কারোর। ভবনে গিয়ে জানা গেল, এটি সিটি করপোরেশনের খাদ্য পরীক্ষাগার। পাকিস্তান শাসনামল থেকে এখানে খাদ্যের মান পরীক্ষা হয়ে আসছে। ২০১১ সালে ঢাকা সিটি করপোরেশন দুভাগে বিভক্ত হলে খাদ্য পরীক্ষাগারটি দক্ষিণের অন্তর্ভুক্ত হয়। তবে এখানে খাদ্যের রাসায়নিক পরীক্ষার কার্যক্রম সম্পূর্ণ বন্ধ। জনস্বাস্থ্য বিশ্লেষক না থাকায়, হচ্ছে না খাদ্য পরীক্ষা। বলা বাহুল্য, উত্তর সিটি করপোরেশনের নিজস্ব খাদ্য পরীক্ষাগার নেই। 

জানা গেছে, নগরবাসীর নিরাপদ খাবার নিশ্চিত করতে উত্তর-দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের স্বাস্থ্য পরিদর্শকরা খাদ্যের নমুনা সংগ্রহ করে এই ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষার জন্য পাঠান। এই ল্যাবরেটরি থেকে খাদ্যের নমুনাগুলোর শুধু রাসায়নিক পরীক্ষা করে সনদ দেওয়া হয়। আধুনিক যন্ত্রপাতি থাকা সত্ত্বেও খাদ্যের মাইক্রোবায়লোজিক্যাল পরীক্ষা হয় না এখানে। তবে এবার খাদ্যের রাসায়নিক পরীক্ষার কার্যক্রমও সম্পূর্ণ বন্ধ। জনস্বাস্থ্য বিশ্লেষক না থাকায় থেমে আছে এই কার্যক্রম। নিয়ম অনুযায়ী খাদ্য পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর সনদে স্বাক্ষর দেন জনস্বাস্থ্য বিশ্লেষক। গত ২৬ ফেব্রুয়ারি থেকে এই পদটি শূন্য। এতদিন ল্যাবরেটরিতে এ পদে প্রেষণে দায়িত্ব পালন করেছেন মো. শামছুল হক। গত বছর ডিসেম্বরে তার বদলির অর্ডার হয়। সে সময় ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে প্রশাসক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা না থাকায় আটকে ছিল তার বদলির আদেশ। সংস্থাটিতে প্রশাসক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা নিয়োগ হওয়ার পর জনস্বাস্থ্য বিশ্লেষককে অবমুক্ত করে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন। এরপর থেকে পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেছে ল্যাবরেটরির সব কার্যক্রম।

বসে বসে সময় কাটাচ্ছে রাসায়নিক ল্যাবের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। বাজার থেকে নমুনা সংগ্রহের কাজও বন্ধ। বেকার বসে আছেন সিটি করপোরেশনের খাদ্য পরিদর্শকরাও। নাম প্রকাশ না করার শর্তে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের এক স্বাস্থ্য পরিদর্শক বলেন, দাপ্তরিক কোনো চিঠির মাধ্যমে আমাদের খাদ্য নমুনা সংগ্রহ স্থগিত করা হয়নি। কিন্তু যেহেতু নমুনা সংগ্রহ করার সাত দিনের মধ্যে পরীক্ষা করার নিয়ম আছে, তবে আমাদের পরীক্ষার ফলাফলের সনদের স্বাক্ষর বা প্রত্যয়নকারী কর্মকর্তা জনস্বাস্থ্য বিশ্লেষক নেই। তাই আমাদের সংগ্রহ কার্যক্রম স্থগিত রয়েছে।

২০১৩ সালে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) সহযোগিতায় স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের অধীন আরবান পাবলিক অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল হেলথ সেক্টর ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্টের (ইউপিইএইচএসডিপি) অধীনে প্রায় ৬৩ কোটি টাকা ব্যয়ে ঢাকা ও চট্টগ্রামে দুটি আধুনিক খাদ্য পরীক্ষাগার নির্মাণ করা হয়। নগরবাসীর নিরাপদ খাদ্যের জন্য জার্মান প্রযুক্তিতে উন্নত মানের যন্ত্রপাতি স্থাপন করা হয়েছে ল্যাবরেটরিত। ২০২০ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে ল্যাবরেটরিটি উদ্বোধন করা হয়। উদ্বোধনের ৫ বছরেই ভবনের নিচতলার বাইরের বিভিন্ন অংশে পলেস্তারা খসে পড়েছে। ফলে ল্যাবরেটরির কোনো কার্যক্রম নেই এখানে। রয়েছে শুধু পাহারাদার ও জেনারেটর কক্ষ। দ্বিতীয় তলায় ঘুরে দেখা গেল ভবনের একপাশে মাইক্রোবায়োলজিক্যাল ল্যাব আছে বন্ধ অবস্থায়। ল্যাব সংশ্লিষ্ট অফিস কক্ষগুলোতে ঝুলছে তালা। তবে তৃতীয় তলায় রাসায়নিক পরীক্ষার প্রাথমিক ল্যাব ও অফিস কক্ষগুলো খোলা রয়েছে। চতুর্থ তলায় অ্যাডভান্স ল্যাব। আর পঞ্চম তলায় প্রশিক্ষণ কক্ষ। তবে ৫ বছরে ফুড সেফটি নিয়ে কোনো ধরনের প্রশিক্ষণ হয়নি। 

আধুনিক যন্ত্রপাতি থাকা সত্ত্বেও খাদ্যের মান ও নিরাপত্তা নিশ্চিতে সব ধরনের পরীক্ষা করতে পারে না প্রতিষ্ঠানটি। খাদ্য পরীক্ষায় রাসায়নিক বিশ্লেষণের মধ্যে সীমাবদ্ধ আধুনিক এই ল্যাবরেটরি। জীবাণু সংক্রমণজনিত স্বাস্থ্যঝুঁকি চিহ্নিত করতে পারে না। শুধু খাদ্যের অ্যাডালট্রেশন (ভেজাল মিশ্রণ) পরীক্ষা হতো। আধুনিক সুবিধা থাকা সত্ত্বেও কন্টামিনেশন (পরিবেশগত কারণে খাদ্যের গুণগত মান নষ্ট হওয়া) পরীক্ষা হয় না। নেই মাইক্রোবায়োলজিস্ট। দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের অর্গানোগ্রামে (সাংগঠনিক কাঠামো) পদ না থাকায় মাইক্রোবায়োলজিস্ট নিয়োগও দিতে পারছে না সংস্থাটি। পাঁচ বছরেও ল্যাবরেটরির মাইক্রোবায়োলজির অংশটি করতে পারেনি। অলস পড়ে থাকায় দিন দিন নষ্ট হচ্ছে অণুজীব ও ব্যাকটেরিয়া পরীক্ষার যন্ত্রপাতি। অর্গানোগ্রাম অনুযায়ী শুধু কেমিস্ট্রি ল্যাব চালু আছে। এখান থেকে শুধু খাদ্যপণ্যের রাসায়নিক পরীক্ষা হতো। তাও এখন বন্ধ।

বিশেষজ্ঞদের মতে, খাদ্যে ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়ার মতো অণুজীব থাকলে বমি, ডায়রিয়া ও পেটব্যথা, আমাশয়, টাইফয়েড, হেপাটাইটিস, হজমের সমস্যা ও অ্যালার্জি দেখা দিতে পারে। এ ছাড়া পেশি দুর্বলতা ও শ্বাসকষ্ট হতে পারে। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. এমএইচ চৌধুরী প্রতিনিদের বাংলাদেশকে বলেন, খাবার থেকে আমরা জীবনী শক্তি পাই। খাদ্য শরীরের ক্ষয় পূরণ করে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে তোলে। খাদ্যে ভেজাল থাকলে অসুখ-বিসুখ বাড়বে; রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা নষ্ট হবে। মানুষের কর্মক্ষমতা কমতে থাকবে। খাদ্য বিশুদ্ধ না হলে শরীরের অঙ্গ-প্রতঙ্গের কার্যকারিতা হ্রাস পাবে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে কার্যকারিতা পুরোপুরি নষ্ট হয়ে যেতে পারে। যেমন কিডনি-লিভার অকেজো হতে পারে। পাকস্থলীর ক্ষয় বা বিষক্রিয়া হতে পারে। বাজারের প্রচলিত প্রতিটি খাদ্যের পরীক্ষা হওয়া দরকার। পৃথিবীর সব দেশে বিশুদ্ধ ও ভেজালমুক্ত খাবারের জন্য জোর দেওয়া হয়। কিন্তু আমাদের দেশের কর্তৃপক্ষ এ জায়গায় অনেকটায় উদাসীন। খাদ্যের সব ধরনের পরীক্ষ হোকÑ এটাই প্রত্যাশিত। 

ল্যাবরেটরিটি বন্ধের বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ড. মো. জিল্লুর রহমান প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, আমি আজকেই প্রথম আপনার থেকেই অবহিত হলাম। খোঁজ নিয়ে জানাতে পারব কী অবস্থায় আছে। এরপর পদক্ষেপ নেব। আর অর্গানোগ্রামে পদ না থাকায় মাইক্রোবায়োলজিস্ট নিয়োগ দেওয়া যাচ্ছে না। ২০২০ থেকে ২০২৫ সাল পর্যন্ত মাইক্রোবায়োলজিস্ট পদ সৃষ্টির জন্য অর্থ মন্ত্রণালয় ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের মধ্যে দেনদরবার চলছে। আজ পর্যন্ত এটার অনুমোদন হয়নি। এজন্য নিয়োগ দেওয়া যাচ্ছে না। 

নিরাপদ খাদ্যের জন্য সব ধরনের পরীক্ষার বিষয়টি নিশ্চিত করতে সিটি করপোরেশনের দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া উচিত বলে জানিয়েছেন কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) ভাইস প্রেসিডেন্ট এসএম নাজের হোসেন। তিনি প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, নিয়মিত জীবাণু পরীক্ষা ছাড়া খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। অনেক দেশেই খাদ্যের রাসায়নিক ও মাইক্রোবায়োলজিক্যাল পরীক্ষা বাধ্যতামূলক। সিটি করপোরেশনে খাদ্য পরীক্ষাগার বন্ধ রাখা উচিত হয়নি । অর্গানোগ্রামে পদ না থাকায় মাইক্রোবায়োলজিস্ট নিয়োগ দিতে পারছে না। এই কথা শুধু অজুহাত। অর্গানোগ্রাম পদ সংযুক্তির বিষয়টি মন্ত্রণালয়ে পাঠানোর পর কোনো ফলোআপ করেনি। এখানে ব্যক্তিগত স্বার্থ থাকলে ১ মাসের মধ্যে এটা পাস করিয়ে নিয়ে আসত বলে আমরা মনে করি। 

এদিকে জনস্বাস্থ্যের বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) নিজস্ব খাদ্য পরীক্ষাগার নির্মাণ করবে বলে জানিয়েছেন সংস্থাটির প্রশাসক মোহাম্মদ এজাজ। তিনি প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, নগরবাসীর জন্য নিরাপদ খাদ্য গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের একটি পরামর্শক কমিটি রয়েছে। সেখানে এ বিষয়ে প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। তাদের পরামর্শ নিয়ে আধুনিক খাদ্য পরীক্ষাগার আমরাও নির্মাণ করব।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের (বিএফএসএ) চেয়ারম্যান জাকারিয়া প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, আমাদের পরীক্ষা চলমান। আমরা রোজার মাস উপলক্ষে মুড়ি-সেমাই, বেসনসহ বিভিন্ন খাদ্যপণ্যের পরীক্ষা করছি। আমাদের সীমাবদ্ধতা রয়েছে; আমরা তো শতভাগ পরীক্ষা করতে পারি না। যতটুকু কুলায় ততটুকু করি। সিটি করপোরেশনের খাদ্য পরীক্ষার সঙ্গে আমাদের কোনো যোগসূত্র নেই। আমাদের পরীক্ষা কার্যক্রম আলাদা। সিটি করপোরেশন স্বাধীনভাবে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করে। খাদ্য পরীক্ষার জন্য আমরা তাদের নিয়ন্ত্রণ করি না। তবে সিটি করপোরেশনের খাদ্য পরিদর্শকরা কেউ কেউ আমাদের সঙ্গে কাজ করেন। তারা মাসে মাসে আমাদের প্রতিবেদন পাঠানÑ কী কী খাদ্য পরীক্ষা করেছে সেগুলোর।

২০২৪ সালে বাজার থেকে ৩৩২টি খাদ্যপণ্য পরীক্ষার জন্য নমুনা পাঠায় ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের খাদ্য পরিদর্শকরা। শুধু রাসায়নিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে ৫১টি খাদ্যপণ্য মানসম্পন্ন নয় বলে প্রতিবেদন দেয় প্রতিষ্ঠানটি। এ ছাড়া সে বছর ব্যক্তি উদ্যোগে ১৬৫টি খাদ্যের রাসায়নিক পরীক্ষা করা হয়। এর মধ্যে ২৪টি খাদ্যপণ্য মানবদেহের জন্য মানসম্পন্ন বলে জানায় এ প্রতিষ্ঠানটি।

শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক : মোরছালীন বাবলা

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা