ফয়সাল আহম্মেদ
প্রকাশ : ২০ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ১৫:১৬ পিএম
পথচারীদের নিরাপদ রাস্তা পারাপার নিশ্চিত করতে রাজধানীর বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের উদ্যোগে নির্মিত হয় শতাধিক ফুট ওভারব্রিজ। কিন্তু পথচারীদের জন্য তৈরি এসব ফুট ওভারব্রিজের বড় অংশ দখলে নিয়ে ব্যবসা করছেন হকাররা। এসব ব্রিজ হকারমুক্ত করতে সিটি করপোরেশন কিংবা সংশ্লিষ্ট বিভাগের নেই কোনো দৃশ্যমান উদ্যোগ।
সরেজমিনে দেখা যায়, রাজধানীর ফার্মগেট, উত্তরা, বনানী, মিরপুর, ভাটারা, রায়েরবাগ এলাকার ফুট ওভারব্রিজগুলো দখলে নিয়ে অবাধে ব্যবসা করছেন হকাররা। মাঝখানে সামান্য জায়গা ফাঁকা রেখে ফুট ওভারব্রিজের দুই পাশে বিভিন্ন মালামাল রেখে অস্থায়ী দোকান বসিয়েছেন তারা। ফলে অল্প এ জায়গা দিয়েই পথচারীরা পার হচ্ছেন ফুট ওভারব্রিজ।
মিরপুর ১০ নম্বর গোলচত্বরের ফুট ওভারব্রিজে গিয়ে দেখা যায়Ñ অর্ধশতাধিক অস্থায়ী দোকান নিয়ে হকাররা বিভিন্ন পণ্যের পসরা সাজিয়েছেন। পথচারীদের অভিযোগ, দিনের বেলা এ ফুট ওভারব্রিজ হকারদের আর রাতে থাকে ভ্রাম্যমাণ পতিতাদের দখলে। এ ছাড়া আছে মাদকাসক্তদের ভয়। ফলে ফুট ওভারব্রিজ ব্যবহারে আগ্রহ দেখান না অনেক মানুষ।
মিরপুর ১৪ নম্বরের বাসিন্দা মনির হোসেন বলেন, হকারদের কারণে ফুট ওভারব্রিজটি সাধারণ মানুষ স্বাচ্ছন্দ্যে ব্যবহার করতে পারেন না। রাত হলে ফুট ওভারব্রিজে বসে বখাটে ও মাদকসেবীদের আড্ডা। এ ছাড়া রাতের বেলা এখানে রাত্রিযাপন করেন নিম্নবিত্ত কিছু মানুষ।
রাজধানীর ব্যস্ততম ফার্মগেট এলাকার ফুট ওভারব্রিজের দুপাশে অস্থায়ী ব্যবসায়ীদের কারণে ঠিকমতো রাস্তা পারাপার হতে পারেন না এ পথের চলাচলকারীরা। নূর ইসলাম নামে মধ্যবয়সি এক হকার জানান, তিনি এখানে ৬ মাস ধরে মোবাইল ফোনের যন্ত্রপাতি বিক্রি করেন। আগে এখানে বসতে চাঁদা দিতে হলেও এখন আর দিতে হয় না। তাই নির্বিঘ্নে এখানে বসে ব্যবসা করতে পারেন।
একই চিত্র রাজধানীর রায়েরবাগ এলাকার ফুট ওভারব্রিজটির। অবাধে হকারা এখানে চালিয়ে যাচ্ছেন তাদের ব্যবসা। এজন্য পথচারীদের পথ সরু হয়েছে। পথচারীদের দাবি, হকাদের উচ্ছেদ করা হলে মানুষের চলাচল অনেক নির্বিঘ্ন হতো।
রাজধানীর ভাটারা-বসুন্ধরা এলাকার ফুট ওভারব্রিজটিরও বেশিরভাগ অংশে হকারদের দৌরাত্ম্য দেখা যায়। পাঁচ থেকে দশ জন হকার নিয়মিত এখানে অস্থায়ী দোকান বসিয়ে ব্যবসা করেন। এ পথে চলাচলকারী ইন্ডিপেনডেন্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী নাজিয়া জেরিন বলেন, হকাররা দুই পাশে বসে, এ ব্রিজ এখন ব্যবহারের অনুপযোগী। যে কারণে অনেক মানুষ আইল্যান্ড দিয়ে ঝুঁকি নিয়ে রাস্তা পারাপার হচ্ছেন।
সাত বছর ধরে বাড্ডা নতুন বাজার ফুট ওভারব্রিজে ব্যাগের ব্যবসা করেন মুজাহিদ কামরুল। ফুট ওভারব্রিজেই কেন ব্যবসা করেনÑ এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, সাধারণ মানুষ আমাদের থেকে অল্প দামে পণ্য কিনতে পারেন। এজন্য মানুষরাই চায় ফুট ওভারব্রিজে বসে আমরা ব্যবসা করি। কারণ মার্কেটে যে পণ্যের দাম ৩০০ টাকা, সেটা আমাদের থেকে ১৫০ টাকায় কিনতে পারেন।
তিনি আরও বলেন, আমরা গরিব মানুষ, দুবেলা ভাতের আশায় ব্যবসা করি। এ ছাড়া তো আমাদের যাওয়ার কোনো জায়গা নেই। সরকার যদি আমাদের কোনোখানে ব্যবসা করার স্থায়ী ব্যবস্থা করে দেয়, তাহলে আমাদের আর এইখানে বসতে হয় না।
রাফি আহসান অফিসে যাওয়া-আসার পথে প্রতিদিন ভাটারা থানার পাশের ফুট ওভারব্রিজ ব্যবহার করেন। হকার থাকার কারণে চলাচলে সমস্যা হয় কি নাÑ এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, দুপাশে হকার থাকার কারণে চলাচল করতে বেগ পেতে হয়। তবে রাতের বেলা একজন হকার থাকলে নিরাপত্তার ব্যাপারটা বিঘ্নিত হয় না। সন্ধ্যার পর ওভারব্রিজগুলো চলাচলের উপযোগী থাকে না।
উত্তরা ৩ নম্বর সেক্টরের রাজলক্ষ্মী কমপ্লেক্সের বিপরীতে নতুন নির্মিত ফুট ওভারব্রিজে বসে ব্যবসা করা মহসিন নামের এক যুবক জানান, আগে পুলিশ মাঝে মাঝে ফুট ওভারব্রিজে এসে অভিযান চালাইত, এজন্য ব্যবসায় সমস্যা হইত। কিন্তু এখন কেউ আসে না, ব্যবসায়ও সমস্যা হয় না।
স্কুলে যাতায়াতের সময় এই ওভারব্রিজ ব্যবহার করেন ক্যামব্রিয়ান স্কুল অ্যান্ড কলেজের দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী হাসান আল জাহিদ। কিন্তু ওভারব্রিজের দুপাশে হকার মালামাল নিয়ে বসে থাকার কারণে ঠিকমতো হেঁটে যাওয়া যায় না বলে অভিযোগ তার।
এ ছাড়া উত্তরা আজমপুর এলাকায় ফুট ওভারব্রিজের হকার হান্নান মিয়া জানান, এই এলাকায় ২০ বছর ধরে ব্যবসা করে আসছেন তিনি। আগে ভ্যানে করে মালামাল বিক্রি করলেও এখন ভ্যানগাড়ি না থাকায় ফুট ওভারব্রিজই তার ব্যবসার কেন্দ্র।
ফুট ওভারব্রিজ ব্যবহারে রাজধানীবাসীকে আগ্রহী করতে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন নানা উদ্যোগের কথা বললেও নেই কোনো কার্যকর পদক্ষেপ। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের অধীনে ফুট ওভারব্রিজ রয়েছে ৪৭টি এবং নতুন আরও ১৮টি ব্রিজ নির্মাণাধীন। এদিকে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের অধীনে রয়েছে ৩৩টি ফুট ওভারব্রিজ।
সাধারণ মানুষ বলছেন, ফুট ওভারব্রিজের ওপর ছিনতাইকারী, ভিক্ষুক, হকার ও নেশাখোরদের উচ্ছেদ করতে হবে। তা না হলে কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত জনগণের কোনো কাজে আসবে না। রাজধানীর বিভিন্ন সড়ক দুর্ঘটনাপ্রবণ। রাজধানীতে প্রতি বছর ফুট ওভারব্রিজ ব্যবহার না করায় দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছে মানুষ।
বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, রাজধানীর ফুট ওভারব্রিজগুলোয় ২৯ প্রকারের ব্যবসা বাণিজ্য হয়ে থাকে। ফুট ওভারব্রিজ হকারমুক্ত করতে হলে সিটি করপোরেশনসহ প্রশাসনের দায়িত্বশীল হওয়ার প্রয়োজন আছে। ২০২৪ সালে সারা দেশে ৬ হাজার ৩৫৯টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৮ হাজার ৫৪৩ জন নিহত হয়েছে এবং ১২ হাজার ৬০৮ জন আহত হয়েছে। এর মধ্যে রাজধানীতে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছে ৪ দশমিক ৯৩ শতাংশ।
এ বিষয়ে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের তথ্য কর্মকর্তা প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, ফুট ওভারব্রিজ দখলমুক্ত করতে উদ্যোগ চলমান রয়েছে। কিন্তু বর্তমানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সীমাবদ্ধতার জন্য কার্যক্রম কিছুটা ব্যাহত হচ্ছে। নির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে ব্যবস্থ্যা গ্রহণ করা হয়।
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মাসুদ আলম সিদ্দিক বলেন, ফার্মগেট ফুট ওভারব্রিজে সিসি ক্যামেরা লাগিয়েছি আমরা, এ থেকে সুফলও পাচ্ছি। সরকারের আইসিটি ডিভিশনের সহায়তায় দ্রুতই বাকি ফুট ওভারব্রিজকে সিসি ক্যামেরার আওতায় নিয়ে আসা হবে। এ ছাড়া সিটি করপোরেশনের আঞ্চলিক জোনগুলোয় আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তাদের দিয়ে দ্রুত অভিযান চালিয়ে ফুট ওভারব্রিজ হকারমুক্ত করা হবে। হকাররা উচ্ছেদের পর যাতে আবারও ফুট ওভারব্রিজে এসে ব্যবসা করতে না পারে, এজন্য তাদের আলাদা কোথাও ব্যবসা করার জন্য টেকসই ব্যবস্থা করে দেওয়া হবে। এ ছাড়া রাজধানীর ফুট ওভারব্রিজের বিকল চলন্ত সিঁড়িগুলো মেরামতে কাজ দ্রুত শুরু করা হবে।
এ বিষয়ে নগর পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, হকারদের লাইসেন্সের আওতায় আনতে হবে। ঢাকা শহরে যে হকার বসবে তাকে নির্দিষ্ট সময় অর্থাৎ তিন-পাঁচ বছরের বেশি লাইসেন্স দেওয়া উচিত হবে না। নির্দিষ্ট সময় অতিক্রম হওয়ার পর একজন হাকার অর্থনৈতিকভাবে কিছুটা স্বাবলম্বী হবে এবং সে নিজে বিকল্প কর্মসংস্থান খুঁজে বের করবে। হকারদের বায়োমেট্রিক আইডেনটিফিকেশনের আওতায় নিয়ে আসতে হবে। এতে করে নিশ্চিত হওয়া যাবে কারা স্থায়ী হকার আর কারা নতুন করে নিযুক্ত হচ্ছেন।
এ ছাড়া হকারদের পুনর্বাসনে রাজধানীর রাস্তাগুলো ক্যাটাগরি করে; যেসব রাস্তায় হকার বসলেও সমস্যা হবে না, সেখানে পুনর্বাসন করার অভিমত এই নগরবিদের।