হাসনাত শাহীন
প্রকাশ : ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ১৭:২৮ পিএম
ছবি : সংগৃহীত
ষড়ঋতুর দেশে ঘুরে ঘুরে আবারও এলো ঋতুরাজ বসন্ত। বাংলার ঋতুচক্রের শেষ ঋতু বসন্ত তার রঙিন পরশে প্রকৃতি ও প্রাণে জাগিয়ে তুলেছে উচ্ছ্বাসের জোয়ার। ফাল্গুন আর চৈত্র—এই দুই মাসব্যাপী এই ঋতুর আজ ১লা ফাল্গুন, বসন্তের প্রথম দিন।
বসন্ত মানেই প্রকৃতিতে নতুন প্রাণের স্পন্দন, হৃদয়ে ভালোবাসার উষ্ণতা। এর সঙ্গে মিলেছে ১৪ ফেব্রুয়ারির বিশ্ব ভালোবাসা দিবসের আবেগ। ফলে আজকের দিনটি হয়ে উঠেছে আরও বর্ণিল, আরও আনন্দময়।
রাজধানী ঢাকার ব্যস্ত নগরজীবনেও বইছে বাসন্তী আমেজ। ইট-কাঠ-পাথরের শহর আজ রঙিন উচ্ছ্বাসে মাতোয়ারা। চিরচেনা নগরীর রাস্তাঘাট, বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস, পার্ক আর বিনোদনকেন্দ্রগুলো হাজারো তরুণ-তরুণী, কিশোর-কিশোরী থেকে শুরু করে নানা বয়সী মানুষের মিলনমেলায় পরিণত হয়েছে।
বসন্ত বরণের এই উৎসব চিরায়ত অসাম্প্রদায়িক ঐতিহ্যের প্রতিচ্ছবি। ভালোবাসার রঙে রাঙানো এই দিন যেন একসঙ্গে মিলিয়ে দিয়েছে প্রকৃতি, সংস্কৃতি ও মানুষের আবেগ।
উচ্ছ্বাসে ভেসে যাওয়ার এমন দিনে ঢাকার এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত সেজেছিল বাসন্তী রঙে। প্রকৃতি নতুন পল্লবে সেজেছে, হাজারো রঙিন ফুলের সৌরভ আর দখিন হাওয়ার সুরলিত সুরে ঢেকে গেছে চারপাশ। বনে-বাদাড়ে, বাগানে-আগানে গাছে গাছে চলছে পুরনো পাতা ঝরার নৃত্য।
বসন্তের এমন সুর আর নৃত্যের আবহে শুক্রবার (১৪ ফেব্রুয়ারি) রাজধানীজুড়ে অনুষ্ঠিত হয়ে গেল বর্ণিল সব আয়োজন। সকাল থেকেই শহরের নানা প্রান্তে বসন্তবরণ উৎসবের আনন্দ ছড়িয়ে পড়ে।
নগরজুড়ে বেজে ওঠে বসন্তের গান—‘শোন গো দখিন হাওয়া, প্রেম করেছি আমি’, ‘বসন্ত বাতাসে সই গো’, ‘ফাগুন হাওয়ায় হাওয়ায় করেছি যে দান’, ‘রাঙিয়ে দিয়ে যাও যাও যাও গো এবার যাবার আগে’, ‘বসন্তের বাহারে শরম লাগে আহারে’, ‘ঝরো ঝরো ঝরে রঙের ঝরণা’, ‘আহা আজি এ বসন্তে এতো ফুল ফোটে, এতো পাখি গায়, আহা কী আনন্দ আকাশে-বাতাসে’।
গানের সুরে, নৃত্যের ঝঙ্কারে, বসন্তের রঙিন আনন্দে ভাসলো পুরো রাজধানী। বসন্ত মানেই নতুন স্বপ্ন, নতুন প্রাণ, ভালোবাসার উচ্ছ্বাস—আর সেই আবেগেই আজ মাতোয়ারা ছিল ঢাকা নগরী।
বসন্ত বরণ বাঙালির চিরন্তন ঐতিহ্যের প্রতিচ্ছবি। বাংলা বর্ষপঞ্জির পরিবর্তনের ফলে এবার একই দিনে মিলেছে পহেলা ফাল্গুন ও বিশ্ব ভালোবাসা দিবস। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে শুক্রবারের ছুটির দিন—সব মিলিয়ে রাজধানীজুড়ে সৃষ্টি হয়েছে এক অনন্য উৎসবের আবহ।
এই উৎসবের আবেশ শীতের নিস্তব্ধ প্রকৃতিতে নতুন প্রাণের উষ্ণতা এনে দিয়েছে। উত্তুরে হিমেল হাওয়া থেমে দখিনা বাতাসে পাতা ঝরার বেদনাকে সরিয়ে নগরজুড়ে বসন্তের আবাহন শুরু হয়েছে।
ফাগুনের প্রথম প্রহরেই বসন্তকে বরণ করতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের বকুলতলায় আয়োজন করা হয় ‘বসন্ত উৎসব-১৪৩১’। ‘জাতীয় বসন্ত উদ্যাপন পরিষৎ’-এর আয়োজনে দিনভর চলে সংগীত, নৃত্য, আবৃত্তি ও নানা সাংস্কৃতিক পরিবেশনা।
প্রকৃতির রঙের ছোঁয়ায়, গানের সুরে, ভালোবাসার উচ্ছ্বাসে রাজধানী ঢাকায় নেমে আসে এক অন্যরকম আনন্দধারা, যেখানে প্রকৃতি আর মানুষের হৃদয় একসঙ্গে গেয়ে ওঠে বসন্তের গান।
ঘড়ির কাটায় তখন সকাল ৭টা। ভোরের আবেশ কাটিয়ে উজ্জ্বল রোদ ঝলমলে সকাল আলোকিত করেছে বকুলতলার চত্বর। সবুজ পাতার ফাঁক গলে পড়া মিষ্টি রোদের আভায় উদ্ভাসিত মঞ্চ যেন প্রকৃতির সঙ্গে একাত্ম হয়ে উঠেছে। ঘোষকের আনুষ্ঠানিক ঘোষণার পরই মঞ্চে আসন নেন কয়েকজন শিল্পী।
হঠাৎ ভেসে এলো সুস্মিতা দেবনাথ শুচীর কণ্ঠে ধ্রুপদী সংগীতের মোহনীয় সুর। সঙ্গে বাজতে শুরু করল ইসরা ফুলঝরি খানের ‘সরোদ’ ও আপন বিশ্বাসের ‘তবলা’। শুদ্ধ সংগীতের এ আবেশ শেষ হতেই মঞ্চে স্থান নেন বেঙ্গল পরম্পরা সঙ্গীতালয়ের বাদ্যযন্ত্রশিল্পীরা। ধ্রুপদী সংগীতের মুগ্ধতা ছড়িয়ে পড়তেই মঞ্চে প্রবেশ করেন পূজা সেনগুপ্ত ও তার দল। সম্মেলক নৃত্যের ছন্দময় পরিবেশনায় যেন বসন্তের প্রাণোদয় স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
‘এসো মিলি প্রাণের উৎসবে’—এই স্লোগানে বর্ণাঢ্য আয়োজনের শুরু হয় অপূর্ব সুর, সংগীত ও নৃত্যের সংমিশ্রণে। পরে সমবেত সংগীত, নৃত্য পরিবেশনা, একক গান, শিশু-কিশোরদের পরিবেশনা এবং ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক উপস্থাপনায় উৎসবের রঙ আরও গাঢ় হয়ে ওঠে। বসন্ত বন্দনার সঙ্গে মিশে যায় ভালোবাসার উষ্ণ আমেজ। উৎসবে অংশ নেওয়া নগরবাসী প্রাণের উচ্ছ্বাসে ভাসতে থাকেন বসন্তের সুর-তালে।
সাংস্কৃতিক পরিবেশনা শেষে শুরু হয় বসন্ত কথন পর্ব। এ পর্বে সভাপতিত্ব করেন পরিষদের সহ-সভাপতি কাজল দেবনাথ। বক্তব্য দেন পরিষদেরর সাধারণ সম্পাদক মানজার চৌধুরী সুইট।
কাজল দেবনাথ বলেন, আমরা অনেক ভাগ্যবান জাতি। কারণ; আমরা জন্মেছি ছয় ঋতুর দেশ বাংলাদেশে। পৃথিবীর খুব দেশ আছে; যাদের ছয়টি ঋতু আছে বা আমাদের মতো বৈচিত্রময় প্রকৃতি আছে। আমাদের মতো ভয়াল রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দেশ স্বাধীনদেশ পেয়েছে। তিনি বলেন, আমরা চাই; আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের যে চেতনাÑ সকলের মাঝে সমতা- বৈষম্যহীনতা ও অসাম্প্রদায়িক চেতনায় সবাই মিলেমিশে আমাদের দেশটাকে সোনার বাংলা গড়ব।
উৎসব উদযাপন পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মানজার চৌধুরী সুইট বলেন, বসন্ত উৎসব উদযাপনের প্রধান লক্ষ্য হল আমাদের মধ্যে সম্প্রীতির বন্ধন যেন আরও দৃঢ় হয়। কেননা, মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্যে দিয়ে স্বাধীনতা লাভ করা আমাদের প্রিয় বাংলাদেশে নানান বর্ণের ফুলের (মানুষের) বসবাস। আমরা চাই নির্বিঘ্নে এখানে আরও ফুল ফুটুক। আমরা চাই; মহান স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সঙ্গে আবহমান গ্রাম-বাংলা, পাহাড়-পর্বতের চিরায়ত সংস্কৃতি মেলবন্ধনে সমতার বাংলাদেশ- বৈষম্যহীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা হোক।
তিনি বলেন, আমরা কখনোই চাই না- জয়পুরহাটে যেভাবে মেয়ের ফুটবল খেলা বন্ধ করা হলো- তা, টাঙ্গাইলে বাঙালি সংস্কৃতি ও মানুষের প্রবাদপুরুষ লালন সাঁইজির স্মরণে ‘লালন স্মরণোৎসব’ বন্ধ হওয়া। এসব বন্ধ হলে আমাদের সংস্কৃতি হুমকির মুখে পড়ে।
এ আয়োজন শেষে অনুষ্ঠিত হয় প্রীতি বন্ধনী ও আবির বিনিময়ের উৎসব। বন্ধু-বান্ধবীরা একে অপরের হাতে ফুলের বন্ধনী পরিয়ে দেয়, যা সম্প্রীতির এক অনন্য দৃষ্টান্ত তৈরি করে। পাশাপাশি, গাল ও কপালে রঙের ছোঁয়ায় বসন্তের আনন্দ ভাগাভাগি করে নেয় সবাই।
চারুকলায় দেশের স্বনামধন্য সাংস্কৃতিক সংগঠন, কণ্ঠশিল্পী, বাদ্যযন্ত্রশিল্পী, নৃত্যশিল্পী এবং আবৃত্তিশিল্পীদের অংশগ্রহণে বসন্ত উৎসব আরও রঙিন হয়ে ওঠে। একইসঙ্গে, রাজধানীর পুরান ঢাকার বাহাদুর শাহ পার্ক ও উত্তরা ৩ নম্বর সেক্টরের উন্মুক্ত মঞ্চে ‘বসন্ত উৎসব উদযাপন পরিষৎ’-এর উদ্যোগে পালিত হয় ‘বসন্ত উৎসব-১৪৩১’।
এ সকল আয়োজনে বসন্তের রঙ ও সুরের মেলবন্ধনে ইট-পাথরের এই কর্মব্যস্ত নগরী ঢাকায় নেমে আসে এক স্নিগ্ধ আবহ। গ্রাম-বাংলার প্রাণময় বসন্ত যেন মিশে যায় নগর জীবনের ব্যস্ততার মাঝে। বসন্তের এমন উচ্ছ্বাসে দিনভর মেতে ছিলেন নানা বয়সী মানুষ, উপভোগ করেছেন বসন্ত বন্দনার এই রঙিন উৎসব।