ফয়সাল আহম্মেদ
প্রকাশ : ১০ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ১০:৫০ এএম
ছবি : সংগৃহীত
ঢাকার রাজপথে বাণিজ্যিকভাবে চলাচল করা মোটরসাইকেলের সংখ্যা ক্রমাগত বাড়ছে। সে সুবাদে একশ্রেণির মানুষের কর্মসংস্থানেরও একটা মাধ্যম হয়ে উঠেছে। নগরবাসীও দ্রুত গন্তব্যে পৌঁছতে বিকল্প একটি মাধ্যম পেয়ে উপকৃত হচ্ছে। তবে এসব মোটরসাইকেল চলাচলের ক্ষেত্রে নিয়মনীতি তেমন একটা মানা হচ্ছে না। তাতে করে বাড়ছে যাত্রীর ঝুঁকি। নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে সড়কের শৃঙ্খলায়।
রাজধানীতে রাইড শেয়ারিং অ্যাপ চালুর শুরুর দিকে অনেকে একটু বাড়তি আয়ের জন্য নিজস্ব পেশার পাশাপাশি নিজের বাইকে ভাড়ায় যাত্রী বহন করতেন। কিন্তু বর্তমানে পেশা হিসেবে নিয়ে বাইক চালাতে যুক্ত হয়েছেন অনেকে। কিন্তু পরিবর্তন আসেনি লাইসেন্সে। তারা অপেশাদার হিসেবে মোটরসাইকেল চালকের লাইসেন্স নিয়ে চালাচ্ছেন বাণিজ্যিকভিত্তিতে।
আগে ছোটখাটো একটা চাকরি করতেন জসীম উদ্দিন। বাড়তি রোজগারের আশায় চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে ঢাকায় এসেছেন মাসছয়েক হলো। এখন রাজধানীতে মোটরসাইকেল চালাচ্ছেন ভাড়ায়। কিন্তু কোনো অ্যাপে রেজিস্ট্রেশন করেননি। রাজধানীর ব্যস্ততম সড়ক মোড়গুলোতে দাঁড়িয়ে থেকে চুক্তিভিত্তিক ভাড়ায় যাত্রী বহন করছেন।
কোনো অ্যাপে রেজিস্ট্রেশন করেননি কেনÑ এমন প্রশ্নে জসীম বলেন, ‘শুনেছি অ্যাপে ভাড়া নিলে কম আয় হয়। তা ছাড়া আয়ের বড় একটা অংশ কমিশন হিসেবে রাইড অ্যাপ শেয়ারিং কোম্পানিকে দিতে হয়। তাতে করে সারাদিন মোটরসাইকেলে যাত্রী টেনেও পকেটে নিজের বলে তেমন কিছু থাকে না।’
ফিরোজ ঢাকায় প্রায় এক বছর ধরে মোটরসাইকেলে রাইড শেয়ারিং করেন। তিনিও কোনো অ্যাপে রেজিস্ট্রেশন করেননি। কারণ হিসেবে তিনি নিজের স্মার্ট মোবাইল না থাকার কথা জানান।
রাজধানীর বাসাবো এলাকার বাসিন্দা আকাশ মোটরসাইকেলে রাইড শেয়ারিং করেন। অ্যাপ কেন ব্যবহার করেন না এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘আমার গাড়ি, আমার তেল। আমি কষ্ট করে আয় করে তার বড় একটা অংশ কমিশন হিসেবে রাইড শেয়ারিং কোম্পানিকে কেন দিতে যাব?’
রংপুরের মিনহাজুল হক জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন রংপুরের একটি কলেজের শিক্ষার্থী। ড্রাইভিং লাইন্সেস পাওয়ার মতো বয়স হয়নি। সেজন্য লাইন্সেস ছাড়াই রাজধানীতে এসে রাইড শেয়ার করছেন মোটরসাইকেলে। ড্রাইভিং লাইন্সেস ছাড়া মোটরসাইকেল চালানো অপরাধÑ এমনটা স্মরণ করিয়ে দিলে তিনি বলেন, ‘প্রধান সড়কে চালাই না। শুধু বিভিন্ন পাড়া-মহল্লার গন্তব্যে যাত্রী পেলে তাদের রাইড শেয়ার করি।’
গুলশানে চাকরি করেন আল-আমিন। চাকরির ফাঁকে অবসর সময়টুকুতে মোটরসাইকেলে রাইড শেয়ার করেন। তিনি বলেন, ‘অ্যাপসে চালাতে গেলে ঝামেলা হয়। দেখা যায় কাস্টমার এমন একটা দূরত্বে থাকে যেখানে যেতে ঝামেলা হয়। অনেক সময়ই রাস্তার ওপারে যাত্রী দাঁড়িয়ে থাকে, আর তার কাছে পৌঁছতে লম্বা দূরত্বের ইউটার্ন নিতে হয়। এটা বিরক্তিকর! এজন্য অ্যাপস ব্যবহার করি না।’
রাজধানীর ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির ছাত্র ইয়াসিন আরাফাত নীলক্ষেত থেকে মোটরসাইকেলে বাড্ডা নতুন বাজারে এসে নামার পর ভাড়া দিলেন ২২০ টাকা। তিনি এই প্রতিবেদককে বলেন, প্রতিদিন নীলক্ষেত থেকে আসি। অ্যাপসে এলে সর্বোচ্চ ১৮০ টাকা ভাড়া ওঠে। আজকে মোবাইল ফোনে ইন্টারনেট না থাকায় চুক্তিতে আসছি। এজন্য ভাড়া একটু বেশি দিতে হলো। অ্যাপসে না আসাটা ঝুঁকিপূর্ণ। তা জেনেও পরিস্থিতির শিকার হয়ে আজ চুক্তিতে আসছি।’
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অ্যাকসিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক মো. হাদিউজ্জামান বলেন, ‘রাইড শেয়ারিংয়ের যে দর্শন সেখানে পেশাদার ড্রাইভিং লাইসেন্সের প্রয়োজন নেই। তবে আমাদের দেশে রাইড শেয়ারিং সেই দর্শনের বাইরে। রাইড শেয়ারিং মূল দর্শন, রাস্তায় যাতায়াতের পথে কোনো ব্যক্তি গাড়িতে একজন যাত্রী নিলে তার কিছুটা আয় হয়; একই সঙ্গে রাস্তায় বাড়তি গাড়ির চাপ কমে। এই দর্শন থেকে আমরা এখনও যোজন যোজন দূরে। তবে পেশাদার ড্রাইভিং লাইসেন্স ছাড়া বাণিজ্যিকভাবে গাড়ি চালানোর কোনো সুযোগ নেই।’
অ্যাপসের ব্যবহার না হওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে এই যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ বলেন, ‘এতে করে বড় ধরনের নিরাপত্তা ঘাটতি তৈরি হয়েছে। আমরা মুখে বলছি রাইড শেয়ারিং কিন্তু আমাদের দেশে এটা রাইড শেয়ারিং হিসেবে নেই, এটা একটা পেশা হিসেবে নিয়েছে মানুষ। রিকশাচালকরা যেমন যাত্রীদের সঙ্গে ভাড়া দিয়ে দরকষাকষি করে গন্তব্যে নিয়ে যান, ঠিক তেমন একটা অবস্থা হয়েছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘কোনো একটা পলিসি তৈরি করার সময় যে একটি ন্যূনতম গবেষণা করতে হয় সেটা আমাদের এখানে হয় না। দেশে বিপুলসংখ্যক মানুষ বেকার। তাদের একটা অংশ এটাকে পেশা হিসেবে নিয়ে নিয়েছে। এজন্য দেখা যাচ্ছে রাস্তার মোড়ে মোড়ে এখন বাইকাররা বসে থেকে যাত্রী ডাকছেন। এতে করে সড়কে তৈরি হচ্ছে বিশৃঙ্খলা।’
বুয়েটের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক এবং দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক ড. এম শামসুল হক বলেন, ‘আমাদের এখানে যেসব ব্যক্তিগত মোটরসাইকেল বাণিজ্যিকভাবে চলাচল করছে সেগুলোকে আলাদা করে চিহ্নিত করার সুযোগ নেই। এজন্য সবার আগে প্রয়োজন বাণিজ্যিক ও ব্যক্তিগত গাড়ি সহজে চিহ্নিত করার ব্যবস্থা করা। এ ছাড়া বাণিজ্যিকভাবে চালানো গাড়ির চালকদের লাইসেন্সে ভিন্নতা আনতে হবে।’
তিনি বলেন, ‘বাণিজ্যিকভাবে গাড়ি চালালে অবশ্যই রুটপারমিট থাকতে হবে। বিআরটিএর গাফিলতির কারণে এগুলো এখনও সিস্টেমের আওতায় আসেনি। এতে করে আইনের ব্যত্যয় ঘটেছে। আইনের প্রয়োগ ঘটাতে হলে বিআরটিএর কর্তাব্যক্তিদের দায়িত্বশীল হতে হবে।’
ড. শামসুল হক আরও বলেন, ‘পুরো পৃথিবীতে যারা রাইড শেয়ার অ্যাপ তত্ত্বাবধান করে তাদের বাধ্য করা হয়েছে করপোরেট দায়িত্ব নেওয়ার জন্য। রাইড শেয়ার অবশ্যই অ্যাপে হতে হবে। চালক ও যাত্রী উভয়কে ইন্টারনেটের আওতায় থাকতে হবে। তাহলে নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে। অ্যাপবিহীন মোটরসাইকেলে যাত্রী বহনের বিষয়ে শুধু চালকরা নয়, অ্যাপ কোম্পানিগুলোও দায়ী। কারণ তারা উচ্চ হারে সার্ভিস কমিশন রাখছে। আর সে কারণে চালকরা বাধ্য হয়ে চুক্তিতে যাত্রী নিচ্ছে। উন্নত দেশগুলোতে রাইড শেয়ারিং অ্যাপে চালিত গাড়িগুলোকে সহজে চিহ্নিত করা যায়। কারণ তাদের গাড়িগুলোতে বিশেষ রঙ বা চিহ্ন দেওয়া থাকে। বাংলাদেশে বিআরটিএ’র অদক্ষতার কারণে এই সেক্টরে সেবার মানের উন্নয়ন হয়নি।’
মোটরসাইকেলচালকরা বলছেন, অতিরিক্ত কমিশনের কারণে তারা অ্যাপস ব্যবহার করছেন না। এ ব্যাপারে উবার-পাঠাওয়ের একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বললে তারা জানান, একজন চালক যখন দিনের প্রথম রাইড দেন সেখানে ১৫ শতাংশ হারে কমিশন নেওয়া হয়। পরবর্তী রাইডগুলোতে এই কমিশনের হার কমতে কমতে ৭ শতাংশে নেমে আসে। চালক ও যাত্রী দুজনই যদি নিরাপত্তার বিষয়টি মাথায় রাখেন, তবে উচিত হবে অ্যাপস ব্যবহার করা।
এ ব্যাপারে গুলশান ট্রাফিক জোনের এডিসি জিয়াউর রহমান প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, ‘প্রত্যেক ট্রাফিক ডিভিশনে স্পেশাল ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগ করা হয়েছে। আশা করা করা যায় খুব দ্রুত আমরা অভিযানে নামতে পারব। মোটরসাইকেলচালকদের অনেকেই অহরহ ট্রাফিক আইন অমান্য করছেন এবং সড়কে যেখানে-সেখানে পার্কিং ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করছেন। তাদের বিরুদ্ধে ট্রাফিক আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে। রাইড শেয়ারিং অ্যাপ নীতিমালা ২০১৭ অনুযায়ী এবং ট্রাফিক আইন প্রয়োগ করে ত্রুটিপূর্ণ কোনো কিছু দেখলে তার বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি’র (বিআরটিএ) চেয়ারম্যান মো. ইয়াসীন প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, ‘অপেশাদার লাইসেন্স নিয়ে গাড়ি চালালে আইনি কোনো বাধা নেই। তবে বিআরটিএ সবসময় উৎসাহিত করে যারা বাণিজ্যিকভাবে গাড়ি চালাবেন তারা যেন পেশাদার লাইসেন্স নেন। বিশ্বের উন্নত দেশগুলোতে ব্যক্তিগত গাড়ি ও বাণিজ্যিক গাড়ি খুব সহজে চিহ্নিত করা যায়।’
এমন কোনো পদ্ধতি দেশে বাস্তবায়ন করা যায় কি নাÑ এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘তা সম্ভব হলে এটা খুব ভালো উদ্যোগ হবে নিঃসন্দেহে। সবার সঙ্গে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে এ বিষয়ে নীতিমালা প্রণয়নের উদ্যোগ নেব।’