× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

ঢামেকের ভেতর-বাহির ১

ঢামেকের ফুটপাতে মাসে ৬০ লাখ টাকার চাঁদাবাজি

আসাদুজ্জামান তপন

প্রকাশ : ১২ জানুয়ারি ২০২৫ ১০:২৫ এএম

আপডেট : ১২ জানুয়ারি ২০২৫ ১১:৫১ এএম

গ্রাফিক্স : প্রতিদিনের বাংলাদেশ

গ্রাফিক্স : প্রতিদিনের বাংলাদেশ

দেশের অন্যতম প্রধান সরকারি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠান ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতাল। সারা দেশ থেকে প্রতিনিয়ত বিপুলসংখ্যক রোগী আসে এখানে। রোগী আর স্বজনের সার্বক্ষণিক ভিড়ে পুরো এলাকা সার্বক্ষণিক থাকে সরগরম। সে সুবাদে পুরো এলাকায় গড়ে উঠেছে নানা দোকানপাট। বিশেষত ফুটপাত দখল করে গড়ে তোলা দোকান ঘিরে তৎপর সংঘবদ্ধ চাঁদাবাজ চক্র।

পাশাপাশি চলছে হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য আসা রোগীদের ভাগিয়ে নিতে সিন্ডিকেটের তৎপরতা। চাঁদাবাজ, দালাল, হাসপাতালের কিছু অসাধু কর্মচারী এবং দায়িত্বরত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর এমন নানামুখী অপতৎপরতায় ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন দেশের দূরদূরান্ত থেকে চিকিৎসাসেবা নিতে আসা রোগী ও সঙ্গে থাকা স্বজনরা।

হাসপাতালের চারপাশের দেয়াল, ফুটপাত আর রাস্তা ঘিরে অবৈধভাবে গড়ে উঠেছে ছয় শতাধিক দোকান ও খাবারের হোটেল। সিন্ডিকেটের সদস্যরা এগুলোকে তাদের চাঁদাবাজির ক্ষেত্র বানিয়েছে। এমনকি ফুটপাত দখল করে কোথায় কে দোকান বসাবে তা-ও নিয়ন্ত্রণ করে এই সিন্ডিকেট। এভাবে ফুটপাত দখলের কারণে হাসপাতালে প্রবেশ করাটাও ঝক্কির বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। জরুরি বিভাগে কোনো যানবাহন বা অ্যাম্বুলেন্স ঢুকতে দেখা দেয় প্রতিবন্ধকতা। বেপরোয়া এই সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে কথা বলার যেন কেউ নেই।

অভিযোগ রয়েছে, চাঁদাবাজ ও দালাল সিন্ডিকেটের নেপথ্যে আছেন বিভিন্ন রাজনৈতিক দল আর হাসপাতালের চতুর্থ শ্রেণির কয়েকজন অসৎ নেতা এবং পুলিশ ও হাসপাতাল প্রশাসনের কতিপয় সদস্য। 

জানা গেছে, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল সংলগ্ন ফুটপাত থেকে দৈনিক কমপক্ষে দুই লাখ টাকা চাঁদা তোলা হয়। সে হিসাবে মাসে ন্যূনপক্ষে ৬০ লাখ টাকা চাঁদা আদায় করে চাঁদাবাজ সিন্ডিকেট।

ঢামেক হাসপাতাল থেকে রোগী ভাগিয়ে আশপাশের ক্লিনিকে নেওয়ার বাণিজ্যও রমরমা। হাসপাতালের বাইরে পরীক্ষা-নিরীক্ষা আর রোগী ভাগাতে দালাল চক্রের এই অপতৎপরতায় প্রতিদিন কয়েক লাখ টাকা হাতবদল হয়। কে বা কারা এই চাঁদার টাকা আদায় করেন এবং তার অংশ কাকে কাকে দিতে হয়Ñ এমন প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে বের হয়ে এসেছে অনেক চাঞ্চল্যকর তথ্য।

গোয়েন্দা সংস্থা এনএসআই ঢাকা উইংয়ের তথ্যমতে, ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে দালাল চক্র নির্মূলে গত ২৫ নভেম্বর অভিযান চালায় যৌথ বাহিনী। এ সময় নারী-পুরুষসহ দালাল ও চাঁদাবাজ চক্রের ২১ সদস্যকে আটক করা হয়। ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে বেশ কয়েকজনকে সর্বোচ্চ তিন মাসের জেল ও ৩ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। এদের অনেকেই জামিনে বেরিয়ে আবারও একই কাজে নেমে পড়েছেন। এর আগে গত বছরের ৪ মার্চ এক বিশেষ অভিযানে ঢামেক হাসপাতালের বিভিন্ন বিভাগ থেকে প্রায় ৭০ জন দালালকে আটক করা হয়।

চাঁদাবাজ আর বহিরাগত দালালদের দৌরাত্ম্যের বিষয়টি স্বীকার করেছেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার আসাদুজ্জামান। প্রতিদিনের বাংলাদেশকে তিনি বলেন, ‘প্রতিদিন হাজার হাজার লোকের আনাগোনা ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। এদের মধ্যে কে চাঁদাবাজ-দালাল সিন্ডিকেটের, আর কে রোগী বা রোগীর স্বজন, সেটা শনাক্ত করা কঠিন। এর পরও মাঝেমধ্যে অভিযান চালিয়ে এই সিন্ডিকেটের সদস্যদের গ্রেপ্তার করা হয়। কিন্তু সহজেই তারা জামিন পেয়ে আগের জগতে ফিরে যায়।’ 

তিনি বলেন, ‘এমন নানা প্রতিকূলতার মধ্য দিয়েই আমাকে কাজ করে যেতে হচ্ছে। তবে এই সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য ও প্রভাব কমিয়ে রোগীদের সর্বোচ্চ সেবা নিশ্চিত করার চেষ্টা করছি।’

সরেজমিন অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ঢামেক হাসপাতালের জরুরি বিভাগের সামনে হকার এবং ছোট ছোট ভাতের হোটেলসহ বিভিন্ন ধরনের দোকানের সংখ্যা দুই শতাধিক। ভবন-২-এর দুই গেটের দুপাশে রয়েছে আরও দুশর মতো দোকান ও হোটেল। বহির্বিভাগের গেটের সামনে আছে ১২০টি দোকান। ঢাকা মেডিকেল কলেজের গেটে এবং তার আশপাশে রয়েছে ৫০টির মতো দোকান। ডা. মিলন অডিটোরিয়ামের অদূরে গেটের আশপাশে রয়েছে আরও ৩০টির মতো দোকান। সব মিলে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ঘিরে এ ধরনের নানা পণ্যের হকার, ক্ষুদ্র দোকান, ভাতের হোটেলের সংখ্যা ছয় শতাধিক। প্রতিটি দোকান থেকে প্রতিদিন গড়ে ৩০০ টাকা করে চাঁদা আদায় হয়। সে হিসাবে প্রতিদিন চাঁদাবাজির পরিমাণ প্রায় দুই লাখ।

স্থানীয় হকারদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তাদের কাছ থেকে চাঁদার টাকা আদায় করে এলাকার চিহ্নিত চাঁদাবাজ ও পুলিশের সোর্স বা লাইনম্যান হিসেবে পরিচিত জলিল, আনোয়ার ওরফে ফর্মা আনোয়ার, হারেস, আকরাম, জামাল ও ইকরাম। ইকরাম এদের দলনেতা। 

এ ছাড়া দালাল সিন্ডিকেটে রয়েছেনÑ সাইদুর, শিশির, কাউসার, নজরুল, সাগর, জয়দেব, মাহমুদা, মুনতাহার, মমতাজ, শেফালী, মোরশেদা, শাহিনুর, শাহনাজ, মর্জিনা, সাইফুল ও রাজিব। রোগী ভাগানোর দালালি করতে গিয়ে এরা প্রত্যেকেই একাধিকবার গ্রেপ্তারও হয়েছেন। সবশেষ যৌথ বাহিনীর অভিযানেও আটক করা হয় তাদের।

অনুসন্ধানে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, হাসপাতালের আশপাশে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকটি হলের ছাত্রদেরও পৃথক ৫টি চাঁদাবাজ সিন্ডিকেট ছিল। পাঁচটি চক্রের দলনেতা ছিলেন স্বাধীন, শুভ, হেদায়েত, রাশেদ ও ইমরান। ছাত্রলীগের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকা এসব দালাল বর্তমানে অনেকটাই নিষ্ক্রিয়। তবে চাঁদাবাজি বন্ধ হয়নি। চাঁদাবাজ বদল হয়েছে মাত্র। আরেকটি গ্রুপ সক্রিয় হয়ে উঠেছে।

হান্নান ও কাশেম ওরফে ট্যাক্সি কাশেম নামে ঢাবির দুই বহিরাগত চাঁদাবাজও আছে এই সিন্ডিকেটে। ঢামেক হাসপাতালে আসা যেসব রোগীর এনআইসিইউ বা আইসিইউ প্রয়োজন হয়, সেসব রোগীকে লক্ষ্য করেই পাঁচটি চক্র কাজ করে বলে জানা গেছে। এরা হাসপাতাল এলাকায় হোন্ডা বাহিনী নামে পরিচিত এবং হাসপাতালের একাডেমিক গেট ও বাগান এলাকাতেই এরা সাধারণত মোটরসাইকেল নিয়ে অবস্থান করে।

অনুসন্ধানে জানা যায়, ঢামেক থেকে বেসরকারি হাসপাতালে কোনো রোগী ভর্তি করাতে পারলে চক্রের সদস্যদের রোগীপ্রতি পার্সেন্টেজ দেওয়া হয়। রোগীর চিকিৎসা বিলের ওপর নির্ভর করে পার্সেন্টেজের পরিমাণ। এই পার্সেন্টেজ সর্বনিম্ন ২০ শতাংশ থেকে সর্বোচ্চ ৫০ শতাংশ পর্যন্ত হয়ে থাকে। রোগী যত দিন ভর্তি থাকবেন, সে হিসাবেও টাকা নেওয়ার সুযোগ আছে।

গত সোমবার বেলা আড়াইটার দিকে ঢামেকের চানখাঁরপুল এলাকায় ফুটপাতের একটি খাবারের দোকান থেকে চাঁদা তুলছিলেন সায়েফ আলী ওরফে আলী নামে এক যুবক। প্রতিদিনের বাংলাদেশকে তিনি বলেন, ‘আমি মূলত পুলিশের সোর্স। পাশাপাশি এই এলাকা থেকে চাঁদা আদায়ের কাজ দেখভালের দায়িত্বটাও আমার। প্রতিদিন এই টাকা তুলে দেওয়া হয় পুলিশ ও আনসার ক্যাম্পে। পরে ক্যাম্প থেকেই এই টাকার ভাগবাঁটোয়ারা হয়।’

তিনি বলেন, ‘এই ক্যাম্প দুটিতে যখন যিনি ইনচার্জ হয়ে আসেন তখন তিনিই এই বাঁটোয়ারার দায়িত্ব পালন করেন। টাকার অংশ পায় শাহবাগ থানা, বাবুপুরা পুলিশ ফাঁড়ি, ঢামেক হাসপাতালের কয়েকজন চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী নেতা, ঢামেকে কর্মরত কয়েকজন সাংবাদিক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আশপাশের আবাসিক হলের কয়েকজন ছাত্র।’ 

সায়েফ আরও বলেন, ‘এসব বিষয় নিয়ে সংবাদমাধ্যম যা-ই প্রচার করুক না কেন, আমরা আসলে এই হকারদের বসিয়ে বা তাদের দেখভাল করে রোগী বা তার স্বজনদেরই উপকার করছি। এসব দোকানে কম দামে খাবারের পাশাপাশি যেকোনো পণ্য পাওয়া যায়। হকারদের দোকানে জিনিসপত্রের দামও বাইরের তুলনায় অনেক কম। রোগীর স্বজনদের জরুরি প্রয়োজনে এগুলো কিনতে বেশি দূরেও যেতে হয় না।’

ঢামেক হাসপাতালে রোগী ও স্বজনের ভোগান্তির আরেকটি বড় কারণ হুইলচেয়ার সিন্ডিকেট। হাসপাতালের জরুরি বিভাগসহ কয়েকটি বিভাগ ও ওয়ার্ডে যেসব হুইলচেয়ার ব্যবহার করা হয়, সেগুলোর অধিকাংশেরই মালিক বহিরাগত। এ ধরনের হুইলচেয়ারের সংখ্যা ৩০টির মতো। 

পুলিশ ক্যাম্পের মাধ্যমে এই হুইলচেয়ার সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করেন কল্পনা, কল্পনার মেয়ে মিতু, মর্জিনা, পিয়ারা বেগম, বাবলী ওরফে বুবলী, সেতু, রীতা, কেয়া, শিউলী ও রানী নামে ১০ বহিরাগত। তবে রোগীদের কাছে ওরা নিজেদেরকে ঢাকা মেডিকেলের কর্মচারী হিসেবে পরিচয় দেন। 

ফুটপাতের চাঁদাবাজ ও পুলিশের সোর্স সায়েফ আলী এমন তথ্য জানিয়ে বলেন, ‘হাসপাতালের কর্মচারীদের নেতা ও প্রশাসন বিভাগের অসৎ সদস্যদের মধ্যে চাঁদার টাকা ভাগ-বণ্টনের দায়িত্ব ওয়ার্ড মাস্টার রিয়াজের। আর এই রিয়াজের কারণে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষও হুইলচেয়ার সিন্ডিকেটের বহিরাগতদের কিছু বলে না।’ 

তবে ওয়ার্ড মাস্টার রিয়াজ দাবি করে বলেন, ‘আমি এ ধরনের কোনো অনৈতিক কাজে সম্পৃক্ত নই। আমার বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ আনা হচ্ছে তার পুরোটাই মিথ্যা। একটি মহল অহেতুক আমার বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালাচ্ছে।’

৫ আগস্ট দেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর আন্দোলকারীরা এই রিয়াজকে আটক করে পুলিশে সোপর্দও করে। অনুসন্ধানকালে জানা যায়, ৫ আগস্টের আগে ঢামেক হাসপাতাল ও আশপাশে আনসারদের হয়ে চাঁদা আদায় করতেন প্লাটুন কমান্ডার মিজানুর রহমান ওরফে পিসি মিজান এবং পুলিশ ক্যাম্পের পক্ষে পরিদর্শক বাচ্চু মিয়া। তারা দুজনেই বদলি হয়ে গেছেন। তবে চাঁদাবাজি আছে বহাল তবিয়তে। এখন আদায়কৃত চাঁদার ভাগ-বণ্টন করেন ঢামেক পুলিশ ক্যাম্পের ইনচার্জ ইন্সপেক্টর মো. ফারুক ও আনসার ক্যাম্পের পিসি বাবুল। 

এ ব্যাপারে পরিদর্শক মো. ফারুক দাবি করেন, তার বিরুদ্ধে যে অভিযোগ আনা হচ্ছে তা সঠিক নয়। তিনি কোথাও থেকে কোনো চাঁদা নেন না। 

তিনি বলেন, ‘ফুটপাত দেখে শাহবাগ থানা ও ট্রাফিক পুলিশ। ক্যাম্প পুলিশ এ বিষয়ে কিছু জানে না। সেখানে চাঁদাবাজি হয় কি না, সে বিষয়টিও আমি নিশ্চিত নই। আর হাসপাতালে এখন আর কোনো দালাল নেই। যে অবৈধ ট্রলিগুলো চলাচল করে, সেগুলো পুলিশ ধরলেও হাসপাতালের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বাধা হয়ে দাঁড়ান। কেননা তিনিই এসব ট্রলি চলাচলের অনুমতি দিয়েছেন।’

ফারুক আরও বলেন, আগের পুলিশ এ ধরনের নানা অপকর্মে সম্পৃক্ত থাকলেও বর্তমানে যারা আছেন তারা এগুলো কল্পনাও করেন না।

শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক : মোরছালীন বাবলা

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা