× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

সরেজমিন চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট

তৌহিদ-অনিকদের হয়তো পৃথিবীর আলো দেখা হবে না আর

সেলিম আহমেদ

প্রকাশ : ২৭ জুলাই ২০২৪ ১২:০৭ পিএম

ফাইল ফটো

ফাইল ফটো

নরসিংদী শহরে কাপড়ের দোকান তৌহিদের। ১৮ জুলাই বিকালে যখন নরসিংদীতে আন্দোলনকারী ও পুলিশের ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া চলছিল তখন তিনি ভয়ে দোকান বন্ধ করে বাসার পথে রওনা দেন। তখনই পড়ে যান সংঘর্ষের মধ্যে। ছররা গুলি লাগে চোখে-মুখে। সঙ্গে সঙ্গে চারপাশ অন্ধকার হয়ে যায় তৌহিদের। পরিবারের লোকজন পরদিন তাকে নিয়ে আসেন জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে। কয়েক দফা অস্ত্রোপচার করা হলেও তার পৃথিবীর আলো দেখার সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, দুই চোখের মধ্যে কেবল একটি চোখ ভালো হওয়ার সম্ভাবনা ৫ শতাংশ। তৌহিদের সঙ্গে আলপাকালে পাশ থেকে ক্ষোভ প্রকাশ করে তার স্ত্রী বলেন, এসব প্রশ্ন আর তদন্ত করে কী লাভ। পারবেন আমার স্বামীর চোখ ফিরিয়ে দিতে। কাটা ঘায়ে লবণ দিয়ে কী লাভ? ক্ষুব্ধ ভদ্রমহিলা তার নাম জানাতেও অনীহা প্রকাশ করেন।

তৌহিদের মতো একইভাবে এই পৃথিবীর সুন্দর রূপ দেখার সম্ভাবনা ক্ষীণ হয়ে গেছে ফরিদপুরের অনিক হওলাদারের। তার বয়স এখনও ১৯ বছর পার হয়নি। অভাবের সংসারে হাল ধরতে কাজ করতেন মাদারীপুরে একটি বিপণন কোম্পানিতে। কোটা সংস্কার আন্দোলন চলাকালে ১৮ জুলাই বিকালে ডেলিভারি শেষ করে বাসায় ফেরার পথে মাদারীপুর আদালত সড়কে সংঘর্ষের মধ্যে পড়ে যান তিনি। চোখে-মুখ-মাথায় আঘাত করে অসংখ্য ছররা গুলি। অচেতন অবস্থায় তাকে প্রথমে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এবং পরে এই হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়। এরই মধ্যে তার চোখে দুই দফা অস্ত্রোপচার হয়েছে। আজ শনিবার চোখে আরেক দফা অস্ত্রোপচার হবে। তবে এখনও তার মাথা ও মুখে বিঁধে থাকা ছররা গুলি অপসারণ করা যায়নি। 

গত বৃহস্পতিবার হাসপাতালে অনিকের বেডে গিয়ে দেখা যায়, তার মাথার পাশে বসে আছেন বাবা নুরুল ইসলাম ও বড় ভাই সোহাগ হাওলাদার। তাদের চোখেমুখে এখন অজানা আতঙ্ক। অনিকের বাবা বলেন, আমার ছেলের এখন সারা জীবন পড়ে আছে। সে দুই চোখে আর দেখতে পারবে কি না সেই আশা এখনও দিতে পারছেন না চিকিৎসকরা। তারা বলেছেন, আরও এক মাস পরে বলতে পারবেন অনিক চোখে দেখতে পারবে কি না। 

তাদের মতোই আরেক আহত রোগী ইকরাম হোসেন। বয়স এখনও ১৮ বছর পেরোয়নি। ইকরামের বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরগরে। নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জের সানারপাড়ে কাজ শেষে বাসায় ফেরার পথে সংঘর্ষের সময় তার ডান চোখে লাগে গুলি। এরপর থেকে ডান চোখ দিয়ে কিছু দেখতে পারছেন না। তার এই অবস্থা দেখে পাগলপ্রায় মা-বাবা। 

ইকরামের মা নাসিমা বেগম বলেন, ছেলেকে বিদেশ পাঠানোর জন্য ওয়েল্ডিংয়ের কাজ শিখতে দিয়েছিলাম। সানারপাড়ে একটি গ্যারেজে কাজ শিখছিল সে। ১৮ জুলাই সন্ধ্যা ৬টার দিকে কাজ শেষে বাসায় ফেরার পথে দেখে রাস্তায় আন্দোলনকারী ও পুলিশের সংঘর্ষ হচ্ছে। ভয়ে আরও লোকজনের মতো সেও ফুটওভার ব্রিজে গিয়ে আশ্রয় নেয়। ওই সময়ই একটা বুলেট এসে তার চোখে লাগে। পথচারীরা স্থানীয় একটি বেসরকারি হাসপাতালে নিয়ে যায়। এরপর আমরা খবর পেয়ে সেখান থেকে নিয়ে আসি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। কিন্তু সেখানে ঠিকমতো চিকিৎসা না পেয়ে পরদিন নিয়ে যাই ব্রাহ্মণবাড়িয়ার একটি প্রাইভেট হাসাপাতালে। সেখানে কয়েক দিন চিকিৎসা করানোর পর চোখের কোনো উন্নতি না হওয়ায় চিকিৎসকরা তাকে চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে রেফার্ড করেছেন। ডাক্তাররা বলেছেন, ইকরাম চোখে দেখতে পারবে কি না তা নির্ভর করছে ভাগ্যের ওপর। 

তৌহিদ, অনিক আর ইকরামের মতো আরও অনেকেরই কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হয়ে কারও চোখের আলো নিভে গেছে, কারও বা নিভু নিভু করছে। 

জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের তথ্য মতে, সহিংসতা চলাকালে চোখে আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত ৪২৫ রোগী এসেছেন এই হাসপাতালে। তাদের মধ্যে ৩০৩ জনের চোখে অস্ত্রোপচার হয়েছে। অনেকেরই চোখে একাধিক অস্ত্রোপচার করতে হয়েছে। বতর্মানে ২০ জনের মতো রোগী চিকিৎসাধীন রয়েছেন। ঢাকাসহ ঢাকার বাইরে থেকেও চোখে গুলিবিদ্ধ অনেক রোগী এসেছেন। যারা চিকিৎসা নিয়ে চলে গেছেন তারা পুরোপুরি ভালো হয়ে হাসপাতাল ছাড়েননি বলে জানিয়েছেন কর্তব্যরত এক চিকিৎসক। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি বলেন, তাদের চোখে অস্ত্রোপচার শেষে সাময়িক রিলিজ দেওয়া হয়েছে। পরবর্তী সময়ে তারা ফলোআপে এলে বোঝা যাবে কতজন দৃষ্টিশক্তি ফিরে পাবেন। তিনি আরও বলেন, যাদের চোখ গুলিতে মারাত্মক আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছে, তাদের দৃষ্টিশক্তি ফিরে পাওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। 

ডান চোখে দৃষ্টিশক্তি ফিরে পাবেন কি না সেই শঙ্কা নিয়ে এই হাসপাতালে দিন পার করছেন রাকিব আহমদ। তার বাড়ি বরিশাল। কাজ করেন একটি বিপণন কোম্পানিতে। রাকিব বলেন, ১৭ তারিখ বিকালে বরিশাল শহরে তিনি বাসা থেকে বেরিয়ে নথুল্লাবাদ বাসট্যান্ড এলাকায় দুই পক্ষের সংঘর্ষের মধ্যে পড়েন। এ সময় পুলিশ এলোপাতাড়ি গুলি ছুড়তে থাকলে ভয়ে পালাতে গেলে ছররা গুলি লাগে তার চোখে। সঙ্গে সঙ্গে অচেতন হয়ে পড়েন। সেখান থেকে পথচরারীরা বরিশাল শেরেবাংলা মেডিকেল কলেজে নিয়ে যায়। এরপর তাকে এই হাসপাতালে রেফার্ড করা হয়। 

চিকিৎসাধীন রাকিব বলেন, আমার ডান চোখ গুলিবিদ্ধ হয়েছে। এখন পর্যন্ত গুলি বের করার জন্য অস্ত্রোপচার হয়নি। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, বোর্ড বসিয়ে অস্ত্রোপচারের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। তবে ইনফেকশন যাতে না হয় সেজন্য একটা ছোট অস্ত্রোপচার হয়েছে। 

রাকিবের স্ত্রী শারমিন খান বলেন, আমার স্বামী যদি আন্দোলন করতে গিয়ে চোখ হারাত তাহলে দুঃখ ছিল না। সে ১৫ হাজার টাকা বেতনে সাধারণ চাকরি করে। আমার তিন বছরের একটি মেয়ে আছে। এই টাকা দিয়েই চলে আমাদের সংসার। চোখ হারানোর পাশাপাশি তার এই ছোট্ট চাকরিটাও থাকবে কি না সেটা নিয়ে ভয় পাচ্ছি। চাকরি হারালে কীভাবে চলব? এসব চিন্তা করলে মাথা কাজ করে না। 

জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের পরিচালক গোলাম মোস্তফা বলেন, হাসপাতালে আসা রোগীর বেশিরভাগই ছররা গুলিতে আহত। তাদের আমরা সর্বোচ্চ চিকৎসা দেওয়ার চেষ্টা করছি। অনেকে চিকিৎসা নিয়ে বাড়ি ফিরে গেছেন। তাদের ফলোআপ করার জন্য আসতে বলা হয়েছে। ফলোআপে এলে তখন অনেকের প্রকৃত অবস্থা বোঝা যাবে।

শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা