× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

নকল প্রসাধনীতে রাজধানী সয়লাব

রানা আহমেদ, কেরানীগঞ্জ (ঢাকা)

প্রকাশ : ১৩ জুলাই ২০২৪ ১৬:৪১ পিএম

আপডেট : ১৩ জুলাই ২০২৪ ১৮:০০ পিএম

ঢাকার কেরানীগঞ্জে নকল প্রসাধনী পণ্য তৈরির একটি কারখানা। যেখানে বিভিন্ন ব্রান্ডের পণ্য নকল সিল ও মোড়কজাতের মাধ্যমে বাজারে বিক্রি করা হয়। প্রবা ফটো

ঢাকার কেরানীগঞ্জে নকল প্রসাধনী পণ্য তৈরির একটি কারখানা। যেখানে বিভিন্ন ব্রান্ডের পণ্য নকল সিল ও মোড়কজাতের মাধ্যমে বাজারে বিক্রি করা হয়। প্রবা ফটো

রাজধানীর অভিজাত একটি মার্কেটের শোরুম থেকে আয়েশা আক্তার নামে কেরানীগঞ্জের শুভাঢ্যা ইউনিয়নের বাসিন্দা একটি ব্র্যান্ডের শ্যাম্পুর বোতল কিনেন। ব্যবহারের কিছুদিন পর তিনি লক্ষ করেন ধীরে ধীরে তার চুল উঠে যাচ্ছে; যা আগে কখনও হয়নি। ভাবনায় পড়ে যান আয়েশা আক্তার। কয়েকজনকে বিষয়টি জানালে তারা শ্যাম্পুর বোতলটি পরখ করে জানান, আয়েশা প্রতারিত। শ্যাম্পুটি আসল নয়। একশ্রেণির ব্যবসায়ী এমন কাজ করে বিশাল অঙ্কের মুনাফা অর্জন করছেন। তাদের কাজই বিখ্যাত ও জনপ্রিয় সব ব্র্যান্ডের পণ্যকে নকল করা।

বাজারে নানা নামের দেশি-বিদেশি প্রসাধনীর ছড়াছড়ি। এই ভিড়ে ভেজাল বা নকল এবং মানহীন প্রসাধনীরও অভাব নেই। পাড়ার ছোট দোকান থেকে শুরু করে বড় বড় বিপণিবিতান- সবখানেই মিলেমিশে আছে আসল-নকল। নকল পণ্যে ক্রেতার আর্থিক ক্ষতির পাশাপাশি ত্বকেরও ক্ষতি হচ্ছে।

সরেজমিনে ঢাকার কেরানীগঞ্জ উপজেলার শাক্তা ইউনিয়নের খোলামোড়া এলাকায় শাহজালাল সড়কে গিয়ে দেখা গেছে, এখানকার আবু তালহা নামে এক ব্যক্তির বহুতল বাড়ির নিচতলায় একটি কারখানা বানিয়ে সেখানে বিদেশি নামিদামি ব্র্যান্ডের মোড়কে নকল প্রসাধনী তৈরি করা হচ্ছে। শ্রমিকরা কারখানার মালিকের নাম বলতে পারেননি। বাড়ির মালিকও এখানে থাকেন না। তার ফোন নম্বর পাওয়া যায়নি। কারখানাটিতে তৈরি হচ্ছে বিদেশি বিভিন্ন ব্র্যান্ডের লিপস্টিক, নেইলপলিশ, আইলাইনার, মাশকারা, ফেস পাউডার, ফাউন্ডেশন, হাইলাইটার। 

এ ছাড়া ভাড়ালিওয়া এলাকার বোচার মসজিদের গলিতে নিজ বাড়িতে মো. ফয়সাল নামে এক ব্যক্তি কারখানা বানিয়ে নকল ও ভেজাল চন্দন, শ্যাম্পু ও তেলসহ বিভিন্ন ধরনের প্রসাধনী তৈরি করে বাজারজাত করছেন।

রাজধানীর চকবাজার, মৌলভীবাজারসহ বিভিন্ন মার্কেট ঘুরে দেখা গেছে, প্রকাশ্যেই বিক্রি হচ্ছে নকল প্রসাধনী। পৃথিবীর নামকরা ব্র্যান্ডের প্রসাধনী সামগ্রী দোকানে সাজানো রয়েছে। তাদের কাছে যেকোনো ব্র্যান্ডের কসমেটিকস পাওয়া যায়। আসল আমদানিকারকের স্টিকারের মতো হুবহু স্টিকারও লাগানো রয়েছে সব পণ্যের প্যাকেটের গায়ে। রয়েছে উৎপাদন ও মেয়াদোত্তীর্ণের তারিখ এবং সর্বোচ্চ খুচরা মূল্যের ছাপ। 

কোহিনূর কেমিক্যালের তিব্বত স্নোর অনুকরণ করে তিবেল, তিব্বেল স্নো তৈরি করে বিক্রি করা হচ্ছে। কিছুটা উন্নত মানের বোতলে রাখা প্যান্টিন ও হেড অ্যান্ড শোল্ডার শ্যাম্পুর নকল পণ্য ৪০০ মিলির বোতলের দাম ১০০ টাকা এবং একটু উন্নতটির দাম ১৪০ টাকা। বাজারে এ দুটি ব্র্যান্ডের একই পরিমাপের আসল পণ্যের দাম ৪০০ থেকে ৪৫০ টাকা। ইউনিলিভারের এক্স বডি স্প্রে ৭০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে, এটির আসল পণ্যের দাম তিনগুণ। ডুইট, হ্যাভক, ফগসহ বিভিন্ন ব্র্যান্ডের বডি স্পের দাম ৭০ থেকে ৯০ টাকার মধ্যে। বাজারে আসলগুলোর দাম ৫০০ থেকে ৮০০ টাকার মধ্যে। ৩৮৫ মিলির নকল জিলেট ফোম ১০০ টাকা, আসলটির দাম ৩৯০ টাকা। নকল পন্ডস ফেসওয়াস ৫০ টাকা, এর আসলটির দাম ১৮০ টাকা। সব পণ্যের দামই আসলের চেয়ে অর্ধেকেরও কম।

ত্বক বিশেষজ্ঞ ও চিকিৎসকরা বলছেন, ভেজাল প্রসাধনী ব্যবহার ত্বকের জন্য বিপজ্জনক। ত্বকে ঘা-সহ নানা জটিল রোগ হতে পারে। ত্বকের ক্যানসারও হতে পারে।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে প্রসাধনীর বিশাল বাজার এবং বিদেশি পণ্যের প্রতি মানুষের আকর্ষণকে পুঁজি করে অতিমুনাফার আশায় একশ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী জেনেশুনে মানুষকে এই বিপদে ফেলছেন। নকল প্রসাধনীর বিরুদ্ধে কঠোর আইন ও তৎপরতা না থাকার সুযোগ নিচ্ছেন তারা। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী মাঝেমধ্যে অভিযান চালালেও নকল প্রসাধনী তৈরি থামছে না।

নকল প্রসাধনী সবচেয়ে বেশি তৈরি হয় পুরান ঢাকার লালবাগ, চকবাজার, বেগমবাজার, মৌলভীবাজার, মোগলটুলী, ইসলামবাগ, ছোট কাটরা, বড় কাটরা এবং বুড়িগঙ্গা নদীর ওপারের কেরানীগঞ্জ। সাভার, আশুলিয়া এমনকি উত্তরাঞ্চলেও নকল প্রসাধনী তৈরি হচ্ছে। নকল প্রসাধনীর বড় পাইকারি বাজার চকবাজার, বেগমবাজার ও মৌলভীবাজার। এ তিন স্থান থেকেই মূলত রাজধানীসহ সারা দেশে নকল ও ভেজাল প্রসাধনী ছড়িয়ে পড়ছে। 

পণ্যের মান নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশন (বিএসটিআই) বলছে, আমদানি করা প্রসাধনী বন্দরে আসার পর নমুনা বিএসটিআইয়ে পরীক্ষা করে মানসম্মত হলে ছাড়পত্র দেওয়া হয়। এসব প্রসাধনীর মোড়কের গায়ে আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানের দাম, পূর্ণাঙ্গ ঠিকানা, সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য এবং বিএসটিআইয়ের মানচিহ্নসহ বাংলায় লেখা একটি স্টিকার থাকার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। বারকোডও থাকে। কোনো পণ্যে ওই স্টিকার না থাকলে তার অর্থ সেটি অবৈধভাবে আনা হয়েছে। মানও যাচাই হয়নি।

ব্যবসায়ীরা জানান, আমদানির পাশাপাশি লাগেজ পার্টির মাধ্যমেও কিছু প্রসাধনী বিদেশ থেকে আসে। সেগুলোর গায়েও বিএসটিআইয়ের নির্দেশিত তথ্যসংবলিত স্টিকার থাকে না। কখনও কখনও স্টিকারও নকল করে ভেজাল পণ্যের মোড়কে সেঁটে দেওয়া হয়। বারকোডও থাকে। এতে তারাও ধোঁকা খান।

কেরানীগঞ্জের বিভিন্ন দোকানে বিশ্বখ্যাত ওলে ব্যান্ডের প্রসাধনী থাকলেও কোনোটির গায়ে বাংলায় লেখা স্টিকার ও বিএসটিআইয়ের মানচিহ্ন নেই। একই চিত্র দেখা গেল বেগমবাজারে প্রসাধনীর একটি পাইকারি দোকানে। কোনো প্রসাধনীর গায়েই বাংলায় স্টিকার নেই।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে বেগমবাজারের এক প্রসাধনী ব্যবসায়ী বলেন, নামিদামি প্রতিষ্ঠানের প্রসাধনী নকল হচ্ছে। আবার একটি প্রতিষ্ঠান একটি চালানের অনুমোদন নিয়ে কয়েকটি চালান আনছে অনুমোদন ছাড়া। বিভিন্ন সংস্থাকে ‘ম্যানেজ’ করে ব্যবসা চালাচ্ছেন।

রাজধানীর নারিন্দা এলাকার এক গৃহবধূ মোড়কের গায়ে পাকিস্তানে তৈরি লেখা ত্বক ফরসা করা ক্রিম ব্যবহার করে ত্বকের সমস্যায় পড়েন। তাকে চিকিৎসকের শরণাপন্নও হতে হয়। এমন ঘটনার শিকার অনেকেই হচ্ছেন।

এ বিষয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের চর্ম ও যৌনরোগ বিভাগের চিফ কনসালট্যান্ট ড. দীপক কুমার দাস জানান, নকল ও মানহীন প্রসাধনী ব্যবহারে অ্যালার্জিজনিত জটিলতা দেখা দেয়। এ ছাড়া ত্বকে দীর্ঘমেয়াদি সংক্রমণ হতে পারে। এ ধরনের প্রসাধনী দীর্ঘদিন ব্যবহারে ক্যানসারও হতে পারে। তিনি এসব অসাধু ব্যবসায়ীর প্রতি সরকারকে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি অনুসরণের পরামর্শ দিয়ে বলেন, এদের আইনের আওতায় এনে কঠোর শাস্তি দিতে হবে।

বিএসটিআইয়ের উপপরিচালক রিয়াজুল হক জানান, আমদানি করা প্রসাধনীর গুণগত মান পরীক্ষার পরই ছাড়পত্র দেওয়া হয়। নকল-ভেজাল প্রসাধনী উৎপাদনকারী ও বাজারজাতকারীদের বিরুদ্ধে নিয়মিত অভিযান চলছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে কেরানীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. আবু রিয়াদ প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, নকল বা ভেজাল কোনো পণ্য উৎপাদন এটি আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ। সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য পেলে মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে অভিযান পরিচালনা করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা