হুমায়ুন মাসুদ, চট্টগ্রাম
প্রকাশ : ০৬ মে ২০২৪ ১৫:৩৩ পিএম
চট্টগ্রাম বে-টার্মিনাল প্রকল্প। ছবি : সংগৃহীত
উদ্যোগ নেওয়ার এক দশক পর অবশেষে বাস্তবায়নের পথে বে-টার্মিনাল প্রকল্প। প্রতীকী মূল্যে ৫০১ একর জায়গা পাওয়ার পর ভূমি অধিগ্রহণ, মাস্টারপ্ল্যান চূড়ান্তকরণসহ নানা জটিলতার কারণে দীর্ঘদিন মুখ থুবড়ে পড়ে থাকা প্রকল্পটিতে এখন নতুন করে গতি সঞ্চার হয়েছে। ভূমি অধিগ্রহণ জটিলতা কেটে যাওয়ায় শিগগিরই শুরু হতে যাচ্ছে প্রকল্প এলাকায় টার্মিনাল নির্মাণকাজ। সব ঠিক থাকলে চলতি বছরের শেষ দিকেই প্রকল্প এলাকায় শুরু হবে টার্মিনাল নির্মাণের কাজ। এজন্য আগামী ১৬ মে আবুধাবি পোর্টের সঙ্গে চুক্তি করতে যাচ্ছে বন্দর কর্তৃপক্ষ।
বন্দর কর্তৃপক্ষ সূত্রে জানা যায়, আগামী ১৩ মে আবুধাবি পোর্টের উচ্চপর্যায়ের একটি প্রতিনিধিদল চট্টগ্রাম আসবে। ওই প্রতিনিধিদলের সঙ্গে একাধিক বৈঠক শেষে ১৬ মে চুক্তি স্বাক্ষর করবে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ। এরপর বে-টার্মিনাল এলাকায় মাল্টিপারপাস টার্মিনাল নির্মাণের কাজ শুরু করবে প্রতিষ্ঠানটি।
আবুধাবি পোর্টের সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষরের মধ্য দিয়ে অবশেষে শুরু হতে যাচ্ছে বহুল আকাঙ্ক্ষিত বে-টার্মিনাল প্রকল্পের বাস্তবায়ন কাজ। শুধু তাই নয়, আবুধাবি পোর্ট টার্মিনাল নির্মাণ শুরুর কয়েক মাস পর সেখানে আরেকটি টার্মিনাল নির্মাণের কাজ শুরু করবে পোর্ট অব সিঙ্গাপুর (পিএসএ) ইন্টারন্যাশনাল। এরপর আরেকটি টার্মিনাল নির্মাণ করবে দুবাইয়ের ডিপি ওয়ার্ল্ড। পিপিপির আওতায় প্রতিষ্ঠান দুটি বে-টার্মিনাল এলাকায় দুটি টার্মিনাল নির্মাণে বিনিয়োগ করার আগ্রহ প্রকাশ করেছে। প্রতিষ্ঠান দুটির সঙ্গে চুক্তি করার জন্য প্রাথমিক প্রক্রিয়াও শুরু করেছে বন্দর কর্তৃপক্ষ। মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন পেলে আগামী জুন অথবা জুলাই মাসের মধ্যে এই দুটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষর করবে বন্দর কর্তৃপক্ষ।
এ সম্পর্কে জানতে চাইলে বন্দর চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল মোহাম্মদ সোহায়েল প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, ‘চট্টগ্রাম বন্দরের অগ্রাধিকার প্রকল্পের বে-টার্মিনালের মাল্টিপারপাস টার্মিনালের নির্মাণকাজ ২০২৪-এর শেষ নাগাদ শুরু করার পরিকল্পনা রয়েছে। চট্টগ্রাম বন্দরের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে এই টার্মিনাল নির্মাণের জন্য আবুধাবি পোর্ট গ্রুপ এক বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের প্রস্তাব দিয়েছে। আগামী সপ্তাহে প্রতিষ্ঠানটির একটি প্রতিনিধিদল চট্টগ্রাম আসছে। তাদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার পর এ বিষয়ে সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষর করা হবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘বে-টার্মিনালের অন্য দুটি কন্টেইনার টার্মিনাল নির্মাণের কাজও এগিয়ে চলছে। টার্মিনাল এক ও দুই নির্মাণ এবং পরিচালনার জন্য পিএসএ সিঙ্গাপুর ও ডিপি ওয়ার্ল্ড বিনিয়োগের প্রস্তাব দিয়েছে। আশা করছি, চলতি বছরে আমরা প্রতিষ্ঠান দুটির সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষর করতে পারব।’
বন্দরের সক্ষমতা বাড়াতে সরকার ২০১৪ সালে বে-টার্মিনাল নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়ার পর ২০১৭ সালে নগরীর ইপিজেড এলাকা থেকে দক্ষিণ কাট্টলী রাসমনি ঘাট পর্যন্ত বঙ্গোপসাগরের তীরে ৮৭০ একর জমিতে প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য মাস্টারপ্ল্যান প্রণয়ন করে বন্দর কর্তৃপক্ষ। তখন প্রাক্কলন ব্যয় ধরা হয়েছিল ২১ হাজার কোটি টাকা। এরপর ২০১৯ সালের জুলাই মাসে প্রকল্পটি পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপ (পিপিপি) পদ্ধতিতে বাস্তবায়ন করার অনুমোদন দেন প্রধানমন্ত্রী। পরে দুই দফায় মাস্টারপ্ল্যান সংশোধন করার পর গত বছরের নভেম্বর মাসে মাস্টারপ্ল্যান চূড়ান্ত করা হয়। এরপর গত ১৪ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রী মাস্টারপ্ল্যানের মোড়ক উন্মোচন করেন।
মাস্টারপ্ল্যান অনুযায়ী, বে-টার্মিনাল প্রকল্পে চারটি টার্মিনাল নির্মাণ করা হবে। এর মধ্যে কন্টেইনার ও পণ্য ওঠানো-নামানোর জন্য থাকবে তিনটি টার্মিনাল। বাকি একটি নির্মাণ করা হবে গ্যাস ও তেল খালাসের জন্য। গ্যাস ও অয়েল টার্মিনালটি বিদেশি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যৌথভাবে বাস্তবায়ন করবে ইস্ট কোস্ট গ্রুপ। প্রকল্প বাস্তবায়নে প্রতিষ্ঠানটি ইতোমধ্যে ৩৫০ কোটি ডলার বিনিয়োগের প্রস্তাব দিয়েছে।
বাকি তিনটি টার্মিনালের মধ্যে সিঙ্গাপুরের পোর্ট অব সিঙ্গাপুর অথরিটি (পিএসএ) ইন্টারন্যাশনাল ও আমিরাতের ডিপি ওয়ার্ল্ড দুটি টার্মিনাল নির্মাণ ও পরিচালনা করবে। এজন্য প্রতিষ্ঠান দুটি ১৫০ কোটি ডলার করে ৩০০ কোটি ডলার বিনিয়োগের প্রস্তাব দিয়েছে। অপর মাল্টিপারপাস টার্মিনালটি নির্মাণে প্রস্তাব দিয়েছে আবুধাবি পোর্ট। প্রকল্পটি বাস্তবায়নে প্রতিষ্ঠানটি ১০০ কোটি ডলার বিনিয়োগ করবে বলে প্রাথমিকভাবে জানিয়েছে। তবে প্রকল্পে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগের প্রস্তাব প্রায় চূড়ান্ত হলেও কোনো প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে এখন পর্যন্ত চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়নি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বন্দরের এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, আবুধাবি পোর্টের উচ্চপর্যায়ের একটি প্রতিনিধিদল আগামী ১৩ মে চট্টগ্রাম আসবে। ওই প্রতিনিধিদলের সঙ্গে একাধিক বৈঠক শেষে ১৬ মে চুক্তি স্বাক্ষর করবে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ। চুক্তি স্বাক্ষরের পর চলতি বছরের শেষ দিকে প্রকল্প এলাকায় মাল্টিপারপাস টার্মিনাল নির্মাণের কাজ শুরু করবে প্রতিষ্ঠানটি।
একই সময়ে প্রকল্পের জন্য নির্ধারিত ৮৭০ একর জায়গার মধ্যে ২০১৭ সালে ৬৭ একর বরাদ্দ পায় চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ। কিন্তু বাকি ৮০৩ একর খাস জায়গার মূল্য নির্ধারণ নিয়ে জেলা প্রশাসন এবং বন্দর কর্তৃপক্ষের মধ্যে বিরোধ তৈরি হয়। জেলা প্রশাসন জমি অধিগ্রহণের মূল্য বাবদ তিন হাজার ৫৯৪ কোটি টাকা দাবি করার পর ওই জায়গা প্রতীকী মূল্যে পাওয়ার জন্য কয়েক দফায় চিঠি চালাচালির পর সর্বশেষ নৌ মন্ত্রণালয়ে চিঠি লিখে বন্দর কর্তৃপক্ষ। এরপর ভূমি মন্ত্রণালয়ের হস্তক্ষেপে ভূমি অধিগ্রহণের এই জটিলতা দূর হয়। শেষ পর্যন্ত ২০২২ সালে পুরো জমি বরাদ্দ পায় বন্দর কর্তৃপক্ষ। গত ২ মে প্রকল্প এলাকায় ৫০১ একর জায়গা চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষকে বন্দোবস্ত দিতে সম্মতিপত্র পাঠিয়েছে জেলা প্রশাসন। জেলা প্রশাসন থেকে পাঠানো তিনটি চিঠিতে ৫০১ একর জায়গা বন্দোবস্তির জন্য তিন কোটি ৩ টাকা প্রতীকী মূল্য পরিশোধ করতে বন্দর কর্তৃপক্ষকে নির্দেশনা প্রদান করা হয়। এ হিসেবে এখন পর্যন্ত প্রকল্প এলাকায় ৫৬৮ একর জমি বন্দোবস্তি পেয়েছে বন্দর। তবে আরও প্রায় ৩০০ একরের মতো জমি এখনও বুঝে পায়নি বন্দর কর্তৃপক্ষ।