× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের কোনো পদক্ষেপই কাজে আসছে না

রেদওয়ানুল হক

প্রকাশ : ২৯ এপ্রিল ২০২৪ ০৮:৫৬ এএম

আপডেট : ২৯ এপ্রিল ২০২৪ ১১:২০ এএম

মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের কোনো পদক্ষেপই কাজে আসছে না

কখনও ডিম, কখনও মাংস, কখনও তেল-পেঁয়াজ-আলু- দেশে প্রতিনিয়ত বাড়ছে খাদ্যসামগ্রীর দাম। এর ফলে মূল্যস্ফীতিও বাড়ছে ক্রমাগত। পাগলা ঘোড়ার মতো ছুটে চলা অর্থনীতির জন্য ক্ষতিকর এ সূচকটিকে সামলানো যাচ্ছে না। এক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রক সংস্থা কেন্ত্রীয় ব্যাংকের কোনো পদক্ষেপই কাজে আসছে না। যদিও চলতি অর্থবছরের দ্বিতীয়ার্ধে মুদ্রাব্যবস্থাপনায় আমূল পরিবর্তন এনেছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের বর্তমান গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার। কিন্তু তারপরও ঠেকানো যায়নি মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা। 

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নিজের ঝুলিতে থাকা সব সূত্র প্রয়োগ করেও মূল্যস্ফীতি পরীক্ষায় ফেল করেছেন গভর্নর। বাজার ব্যবস্থাপনার ত্রুটির ওপর দায় চাপিয়ে নিজেদের ব্যর্থতা আড়াল করতে চাচ্ছে আর্থিক খাতে নেতৃত্বে থাকা বাংলাদেশ ব্যাংক।

প্রতিষ্ঠানের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মেজবাউল হক জানান, সরবরাহ ব্যবস্থায় ত্রুটি থাকায় মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে কাঙ্ক্ষিত ফল পাওয়া যাচ্ছে না। বাজার সিন্ডিকেট রুখতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ব্যর্থতাকেও এক্ষেত্রে দায়ী করেছেন তিনি। 

তবে অর্থনীতিবিদরা বলছেন, দেশের মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি ও মূল্যস্ফীতির লক্ষ্য নির্ধারণসহ সার্বিক বাজেট প্রণয়ন করে সরকার। বাজেটের আলোকে মুদ্রাব্যবস্থাপনা গড়ে তোলার দায়িত্ব কেন্দ্রীয় ব্যাংকের। সরকারের বেঁধে দেওয়া লক্ষ্য অর্জনে কার্যকর মুদ্রানীতি প্রণয়ন করেন গভর্নর। আর বাজারে মুদ্রা সরবরাহ এবং বৈদেশিক বাণিজ্য ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে বাজেটের লক্ষ্য অর্জনের গুরু দায়িত্ব পালন করে বাংলাদেশ ব্যাংক। আর বাজার ব্যবস্থাপনার ত্রুটি সমাধান তথা সরবরাহ ব্যবস্থা স্বাভাবিক রাখতে সহায়তা করে রাষ্ট্রের বিভিন্ন সংস্থা।

এককথায় বাজেটের লক্ষ্য অর্জনে কার্যকর মুদ্রাব্যবস্থাপনা গড়ে তোলা এবং বাজার ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে তার ফলাফল অর্জনের মূল দায়িত্ব কেন্দ্রীয় ব্যাংকের। কিন্তু বর্তমানে ঊর্ধ্ব মূল্যস্ফীতির লাগাম টানতে ব্যর্থ হয়ে বাজার সিন্ডিকেটকে দোষারোপ করছেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক ড. সেলিম রায়হান বলেন, ‘সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে না পারা, বিশ্ববাজারের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন না করা, দীর্ঘ সময় ধরে সুদের হারে সীমা বেঁধে রাখা, রাজস্ব আদায়ে ঘাটতি, সরকারের ঋণ পরিশোধ এবং মূল্যস্ফীতির সঙ্গে জড়িত বিভিন্ন পদক্ষেপে সমন্বয় না থাকায় মুদ্রানীতি কাজ করছে না।’

২০২২ সালের ১২ জুলাই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ১২তম গভর্নর হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন আব্দুর রউফ তালুকদার। দায়িত্ব নেওয়ার পরপরই তিনি বলেছিলেন, কার্যকর মুদ্রানীতি গ্রহণের মাধ্যমে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করবেন। তবে এটি অর্জনে ব্যর্থ হয়ে গত জানুয়ারি মাসে ঘোষিত মুদ্রানীতির কাঠামোই বদলে ফেলা হয়। সর্বশেষ ঘোষিত ওই মুদ্রানীতি ছিল সংকোচনমূলক। এটি বাজারে টাকার জোগান কমানোর মাধ্যমে মূল্যস্ফীতি কমিয়ে আনার কৌশল। অথচ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কার্যক্রম চলছে পুরো উল্টো ধারায়। 

দেশের আর্থিক বাজারে স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে, বাংলাদেশ ব্যাংক ২০২২-২৩ অর্থবছরে প্রচলিত ব্যাংকগুলোকে ১৩ লাখ কোটি টাকা তারল্য সহায়তা দিয়েছে, যা আগের বছরের তুলনায় সাড়ে সাতগুণ বেশি। ২০২১-২২ অর্থবছরে তারল সহায়তার অঙ্ক ছিল পৌনে ২ লাখ কোটি টাকা। অর্থাৎ সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি নিয়ে তার উল্টো কাজ করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। যার ফলস্বরূপ মূল্যস্ফীতিও কমেনি।  

২০২৩ সালের ৭ নভেম্বর অর্থনীতি বিষয়ক সাংবাদিকদের সংগঠন ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরামের (ইআরএফ) নেতাদের সঙ্গে এক বৈঠকে গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার বলেছিলেন, ‘ডিসেম্বরের মধ্যে মূল্যস্ফীতি ৮ শতাংশ ও আগামী জুনের মধ্যে তা ৬ দশমিক ৫ শতাংশে নামিয়ে আনা হবে।’ 

এরপর পুনর্গঠিত মুদ্রানীতি কমিটির প্রথম সভায় মূল্যস্ফীতির লাগাম টেনে ধরতে ত্বরিৎ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। গত ২৬ নভেম্বর সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে সব ধরনের সুদহার বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের কথা বলা হয়। ওইদিন সাংবাদিকদের লিখিতভাবে জানানো হয় অর্থবছরের প্রথমার্ধ শেষে তথা ডিসেম্বরে মূল্যস্ফীতি ৮ শতাংশ এবং অর্থবছর শেষে অর্থাৎ জুনে ৬ শতাংশে নামিয়ে আনা হবে। এ লক্ষ্যের কথা জানান কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তৎকালীন প্রধান অর্থনীতিবিদ ও বর্তমান ডেপুটি গভর্নর ড. মো. হাবিবুর রহমান। 

কিন্তু ডিসেম্বর শেষে সার্বিক মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক ৪১ শতাংশ। অর্থাৎ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গৃহীত পদক্ষেপ কাজে আসেনি। এমন প্রেক্ষাপটে গত ১৮ জানুয়ারি নতুন মুদ্রানীতি ঘোষণা করা হয়। এতে মুদ্রানীতির কাঠামো পরিবর্তন করে দ্রুততম সময়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের ঘোষণা দেন গভর্নর। ডিসেম্বরের লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থতার জন্য সময় চান তিনি। কিন্তু চার মাস পেরিয়ে গেলেও মূল্যস্ফীতিতে লাগাম টানা যায়নি। ২০২২ সালের জুলাই মাসে নতুন গভর্নর দায়িত্ব নেওয়ার সময় মূল্যস্ফীতি ছিল ৭ দশমিক ৪৮ শতাংশ। প্রায় দুই বছর লড়াই শেষে সবশেষ গত মার্চে মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৯ দশমিক ৮১ শতাংশ। আর গত ১৩ মাস ধরে মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশের ওপরে অবস্থান করছে।

মূল্যস্ফীতির এ দশা থেকে উত্তরণের উপায় কী হতে পারে তা জানতে যোগাযোগ করা হয় বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য পণ্যের উৎপাদন বৃদ্ধির পাশাপাশি সরবরাহ বাড়াতে হবে। বাজার ব্যবস্থায় শৃঙ্খলা আনতে হবে। দেশে কর্মসংস্থান বাড়ানোর কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। মুদ্রানীতিতে এসব বিষয়ে সুস্পষ্ট বার্তা না থাকলে সেটি প্রণয়ন কিংবা ঘোষণা দিয়ে কোনো লাভ নেই।’

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্য সামনে রেখে গত ১০ মাসে দেশে ব্যাংকঋণের সুদহার সাড়ে ৪ শতাংশ বেড়েছে। ৯ থেকে বেড়ে চলতি এপ্রিলে ব্যাংকঋণের সর্বোচ্চ সুদহার উঠেছে সাড়ে ১৩ শতাংশে। ভোক্তাঋণে যা সাড়ে ১৪ এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে সাড়ে ১৫ শতাংশ। 

প্রসঙ্গত, বাংলাদেশে না কমলেও ২০২৩ সালে বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম গড়ে ১০ শতাংশের বেশি কমেছে। আর বৈশ্বিক খাদ্যমূল্য কমেছে প্রায় ১৪ শতাংশ। এ সময় খাদ্যশস্যের দামও কমেছে প্রায় এক-চতুর্থাংশ। আন্তর্জাতিক পণ্য পরিবহন ব্যয়ও এ সময় উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে। কিন্তু বাংলাদেশের বাজারে এর কোনোটিরই ইতিবাচক প্রভাব দেখা যায়নি। পণ্যের দাম না কমে বরং দেশে উল্টো জ্বালানি তেলসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় সব পণ্যের দাম বেড়েছে। 

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. ফরাসউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘বর্তমানে দেশে ৭৮ শতাংশ মানুষ বেকার। এ অবস্থায় সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি আত্মহত্যার শামিল।’

সম্প্রতি ইনস্টিটিউট অব কস্ট অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট অ্যাকাউন্টস অব বাংলাদেশ (আইসিএমএবি) আয়োজিত ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রাক-বাজেট আলোচনায় বিশেষ অতিথির বক্তব্যে তিনি বলেন, ‘সংকোচনমূলক মুদ্রানীতির মাধ্যমে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়। কারণ যখন ৯ শতাংশ সুদহার ছিল তখনও মূল্যস্ফীতি ছিল। এটি সমাধানের জন্য মজুদ ও সরবরাহ বাড়াতে হবে। এক্ষেত্রে স্বচ্ছতার সঙ্গে কাজ করতে হবে।’

এদিকে আমদানির এক-তৃতীয়াংশের বেশি কমিয়েও ডলার সংকট কাটাতে পারছে না কেন্দ্রীয় ব্যাংক। পাশাপাশি ব্যাংক খাতে তীব্র হয়ে উঠেছে তারল্য বা নগদ টাকার সংকট। স্থবিরতা চলছে বেসরকারি বিনিয়োগেও। দেশি-বিদেশি উৎস থেকে ঋণ বাড়ছে সরকারের। বিপরীতে কমছে রাজস্ব আহরণ। অর্থ সংকটে পড়ে বিদ্যুৎ, সারসহ বিভিন্ন খাতের ভর্তুকি ও প্রণোদনার অর্থও পরিশোধ করতে পারছে না সরকার। বিশেষ ট্রেজারি বন্ড ইস্যু করে ভর্তুকির দায় পরিশোধের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে সরকারের তরফে। স্থবিরতা চলছে দেশের পুঁজিবাজারেও। 

এ বিষয়ে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক অর্থনীতিবিদ ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘দীর্ঘ সময় পরে হলেও ৯ শতাংশ সুদহার থেকে বের হয়ে এসেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্য সামনে রেখে সুদহার অনেকটাই বেড়েছে। আগামী এক বছর পর্যন্ত এটি সহ্য করতে হতে পারে। মূল্যস্ফীতি আপাতত কমাতে এর বিকল্প নেই।’

শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা