একীভূতকরণ নীতিমালা
রেদওয়ানুল হক
প্রকাশ : ১৭ এপ্রিল ২০২৪ ০৯:২৭ এএম
আপডেট : ১৭ এপ্রিল ২০২৪ ১৩:৫৯ পিএম
অর্থনীতির যে আকার তার তুলনায় দেশে ব্যাংকের সংখ্যা অনেক বেশি; যা নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই উদ্বেগ প্রকাশ করে চলেছেন অর্থনীতিবিদরা। বিশেষত রাজনৈতিক বিবেচনায় ডজনখানেক ব্যাংকের অনুমোদন দেওয়াকে বড় ভুল বলে মনে করেন তারা। বর্তমানে কার্যরত বাণিজ্যিক ব্যাংকের সংখ্যা ৬১টি। এবার দুর্বল ব্যাংকগুলোকে সবল ব্যাংকের সঙ্গে একীভূতকরণের মাধ্যমে আগের ভুল শোধরাতে চাইছে সরকার। এই প্রক্রিয়ায় ব্যাংকের সংখ্যা কমাতে গত ৪ এপ্রিল নীতিমালা জারি করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
অর্থনীতিবিদদের মতে, ঘোষিত নীতিমালায় বেশ কিছু গলদ রয়েছে। বিষয়টিকে ‘ভুল শোধরাতে গিয়ে নতুন ভুল’ হিসেবেও দেখা হচ্ছে। কেননা যেসব পরিচালকের অনিয়মের কারণে চিহ্নিত ব্যাংকগুলো দুর্বল হয়েছে, তাদের শাস্তির ব্যবস্থা নেই এই নীতিমালায়। উল্টো বিশেষ ছাড় দিয়ে ফের পরিচালক হওয়ারও সুযোগ দেওয়া হয়েছে। সেই সঙ্গে সুরক্ষা দেওয়া হয়েছে কর্মকর্তাদেরও।
নীতিমালায় বলা হয়েছে, দুর্বল যে ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান একীভূত হবে, সেটির পরিচালকরা পাঁচ বছর পর আবার একীভূত হওয়া ব্যাংকের পর্ষদে ফিরতে পারবেন।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, ‘একীভূতকরণের লক্ষ্যে যে নীতিমালা করা হয়েছে সেটি যুক্তিসংগত হয়নি। কেননা যেসব পরিচালক বিভিন্ন অনিয়মের মাধ্যমে ব্যাংকগুলোকে দুর্বল অবস্থার মধ্যে ফেলেছেন তাদের শাস্তি হওয়া দরকার। কেন তারা পাঁচ বছর পর আবার ফিরতে পারবেন তা বোধগম্য নয়।’
নীতিমালায় আরও বলা হয়েছে, একীভূত হওয়া ব্যাংকের কর্মীদের তিন বছর পর্যন্ত ছাঁটাই করা যাবে না। এমনকি একীভূত হওয়ার আগে কর্মকর্তা-কর্মচারীরা যে বেতন ও শর্তে কর্মরত ছিলেন, সেই শর্তেই তাদের বহাল রাখতে হবে।
তবে আপাতত পদ্মা ব্যাংক, বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক লিমিটেড (বিডিবিএল), ন্যাশনাল, বেসিক ও রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকের (রাকাব) বাইরে অন্য কোনো ব্যাংকের একীভূত হওয়ার প্রস্তাব গ্রহণ করবে না নিয়ন্ত্রক সংস্থা। সোমবার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মেজবাউল হক।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রকাশিত সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরের শেষে রাষ্ট্রায়ত্ত বেসিক ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি ছিল ৩ হাজার ১৫০ কোটি টাকা। রাষ্ট্রায়ত্ত অপর ব্যাংক বিডিবিএলের মূলধন ঘাটতি না থাকলেও বিশেষায়িত ব্যাংক রাকাবের মূলধন ঘাটতি ছিল ২ হাজার ৪৭২ কোটি টাকা। বেসরকারি খাতের পদ্মা ও ন্যাশনাল ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি যথাক্রমে ৬০৭ ও ২ হাজার ২৪ কোটি টাকা।
এ ছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংকের ডিসেম্বর ২০২৩ ভিত্তিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, বেসিক ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ৮ হাজার ২০৪ কোটি টাকা। এ অঙ্ক মোট বিতরণকৃত ঋণের ৬৩ দশমিক ৭৬ শতাংশ। এর মধ্যে মন্দ ঋণ ৮ হাজার ৪২ কোটি টাকা। ব্যাংকটির বিতরণকৃত ঋণ ১২ হাজার ৮৬৮ কোটি টাকা। বিডিবিএলের খেলাপি ঋণ ৯৮২ কোটি টাকা বা ৪২ দশমিক ৪৬ শতাংশ। এর মধ্যে মন্দ ঋণ ৯৩২ কোটি টাকা। ব্যাংকটির বিতরণকৃত ঋণ ২ হাজার ৩১৩ কোটি টাকা। রাকাবের বিতরণ করা ঋণ ৭ হাজার ১৭৮ কোটি টাকা। এর মধ্যে মন্দ ঋণ ১ হাজার ৩১১ কোটি টাকা। তাদের মোট খেলাপি ঋণ ১ হাজার ৫৩৪ কোটি টাকা।
বেসরকারি পদ্মা ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ১ হাজার ৮৮০ কোটি টাকা, যা মোট বিতরণ করা ঋণের ৪৬ দশমিক ৩৯ শতাংশ। এর মধ্যে মন্দ ঋণ ১ হাজার ৮৬৩ কোটি টাকা। ব্যাংকটির বিতরণকৃত মোট ঋণ ৪ হাজার ৫৩ কোটি টাকা। ন্যাশনাল ব্যাংকের বিতরণ করা ঋণের অঙ্ক ৪২ হাজার ৭৭১ কোটি টাকা। এর মধ্যে মন্দ ঋণ ১১ হাজার ৩৭৭ কোটি টাকা। আর মোট খেলাপি ঋণ ১২ হাজার ৩৬৮ কোটি টাকা বা ২৮ দশমিক ৯২ শতাংশ।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সাধারণত বেনামি ঋণগুলো ব্যাংক কর্মকর্তাদের যোগসাজশে সৃষ্টি হয়। তাই কোনো ব্যাংক দুর্দশাগ্রস্ত হয়ে পড়ার পেছনে ওই ব্যাংকের বেশ কিছু দুর্নীতিগ্রস্ত কর্মকর্তা দায়ী। নতুন নীতিমালায় এদেরই সুরক্ষা দেওয়া হয়েছে।
ব্যাংকাররা বলছেন, এ বিধানের ফলে ব্যাংকের কর্মীদের মধ্যে একধরনের বৈষম্য তৈরি হতে পারে। এর কারণ ব্যাখ্যা করে তারা বলেন, সাধারণত ব্যাংকে প্রতিবছর কর্মীদের কাজের মূল্যায়ন করা হয়। তার ভিত্তিতে তাদের পদোন্নতি ও অন্যান্য বিষয় নির্ধারিত হয়ে থাকে। নীতিমালায় খারাপ ব্যাংকের কর্মীদের তিন বছরের জন্য চাকরি ও আর্থিক সুবিধার গ্যারান্টি দেওয়া হয়েছে। অথচ ভালো ব্যাংকের কর্মীরা প্রতিবছর তাদের কাজের ভিত্তিতে মূল্যায়িত হবেন।
এ বিষয়ে প্রশ্ন রেখে ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘অদক্ষদের কেন তিন বছর রাখতে হবে। যারা অদক্ষ কিংবা অনিয়ম করেছে নতুন ম্যানেজমেন্টের হাতে তাদের বাদ দেওয়ার সুযোগ থাকা দরকার ছিল। বাংলাদেশে অপরাধ প্রমাণ করতে সময় লাগে। তিন বছরের মধ্যে তারা কোনো একটা ফন্দি বের করবে, এরপর আবার স্থায়ী হয়ে যাবে।’
নীতিমালায় স্বেচ্ছায় একীভূত হলে কী করতে হবে, আর স্বেচ্ছায় না হলে বাংলাদেশ ব্যাংক কী প্রক্রিয়ায় খারাপ ব্যাংককে একীভূত হতে বাধ্য করবে, তার আলাদা আলাদা বিধান করা হয়েছে। বাধ্যতামূলক একীভূত করা সম্পর্কিত নীতিমালায় বলা হয়েছে, গত ডিসেম্বরে বাংলাদেশ ব্যাংকের জারি করা ‘প্রম্পট কারেক্টিভ অ্যাকশন (পিসিএ)’ নীতিমালার আওতায় মূলধন ঘাটতি, উচ্চমাত্রার খেলাপি ঋণ, তারল্য ও সুশাসনের ঘাটতিসহ বিভিন্ন সূচকের ভিত্তিতে দুর্বল ব্যাংকগুলোকে চারটি শ্রেণিতে ভাগ করা হবে। এর মধ্যে ৩ ও ৪ শ্রেণিভুক্ত ব্যাংকের আর্থিক অবস্থার উন্নতির জন্য এক বছর সময় দেওয়া হবে। এ সময়ের মধ্যে উন্নতি না হলে সেসব ব্যাংককে একীভূত করার উদ্যোগ নেবে বাংলাদেশ ব্যাংক।
বিশ্লেষকরা প্রশ্ন তুলেছেন, এখন পর্যন্ত যেসব ব্যাংককে একীভূত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, সেগুলো কোন নীতিতে পড়বে, সেটি নিয়ে এ নীতিমালা একধরনের ধোঁয়াশা তৈরি করে।
এ বিষয়ে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, ‘বাধ্যতামূলক একীভূত করার বিষয়ে নীতিমালায় বলা হয়েছেÑ দুর্বল ব্যাংকগুলোকে একীভূত করার বিষয়ে প্রথমে পত্রিকায় বিজ্ঞাপন প্রকাশ করা হবে। এরপর কেউ আগ্রহ দেখালে তাদের খারাপ সম্পদের বিষয়ে যাচাই-বাছাইয়ের উদ্যোগ নেওয়া হবে। প্রশ্ন হলো, খারাপ সম্পদের তথ্য আগে না জানলে এসব ব্যাংককে একীভূত করার বিষয়ে কেন এবং কীসের ভিত্তিতে অন্যরা আগ্রহী হবে। এ ছাড়া পরিচালকদের পাঁচ বছর পর আবার পর্ষদে ফেরার যে সুযোগ রাখা হয়েছে, তা একধরনের দায়মুক্তি। ব্যাংক খাতের সুশাসনের ক্ষেত্রে তা সমস্যা তৈরি করতে পারে।’
এদিকে এ নীতিমালা করার আগে দেশের দুর্বল তিনটি ব্যাংককে অপেক্ষাকৃত ভালো তিন ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত করার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে সরকার। এর মধ্যে বেসরকারি এক্সিম ব্যাংকের সঙ্গে পদ্মা ব্যাংকের একীভূত হওয়ার বিষয়ে সমঝোতা চুক্তিও হয়ে গেছে। আর সরকারি খাতের কৃষি ব্যাংকের সঙ্গে রাকাব ও সোনালী ব্যাংকের সঙ্গে বিডিবিএলকে একীভূত করারও সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
সম্প্রতি বিশ্বব্যাংক জানিয়েছে, ব্যাংক একীভূত করার ক্ষেত্রে আরও সতর্ক হওয়া প্রয়োজন। আন্তর্জাতিক রীতিনীতি মেনে এই প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা দরকার। সম্পদের মান ও সুনির্দিষ্ট নীতিমালার ভিত্তিতে ব্যাংক একীভূত করা উচিত। এমনকি ব্যাংক খাতে সংস্কারে বাংলাদেশকে সহায়তা দিতে প্রস্তুত আছে বলেও সম্প্রতি এক সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছে বিশ্বব্যাংক।
তবে নীতিমালার বিষয়ে গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর মনে করেন, ‘দুর্বল ব্যাংকগুলোকে আর সময় না দিয়ে তাদের সম্পদের মূল্যায়ন করা উচিত। একটা ব্যাংকে কতটা ক্ষত হয়েছে, তার হিসাব জানা আগে জরুরি। হিসাবটা জানলে দামদর করে কেনাবেচা করা সহজ হয়। তবে একীভূত করার পাশাপাশি অবসায়নের সুযোগ রাখাটাও জরুরি।’
নীতিমালা অনুযায়ী, একীভূত হওয়া ব্যাংকের আর্থিক সূচক যাতে খারাপ না হয়, তার জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে নীতি ছাড় ও তারল্য সুবিধা দেওয়া হবে। পাশাপাশি একীভূত হওয়া ব্যাংককে বিশেষ নীতিসহায়তা দিতে সরকারের কাছেও আবেদন করবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।