প্রবা প্রতিবেদক
প্রকাশ : ২৫ মার্চ ২০২৪ ২৩:৫৫ পিএম
আপডেট : ২৬ মার্চ ২০২৪ ১৪:৩৬ পিএম
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন। ফাইল ফটো
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যেমন কাউন্সিল অব ইকোনমিক এডভাইজরস আছেন, বাংলাদেশের সরকারপ্রধানের যদি সে রকম একজন আস্থাভাজন লোক থাকেন যিনি জানেন, বোঝেন এবং ভালো পরামর্শ দিতে পারবেন, তার নেতৃত্বে একটা উপদেষ্টা কমিশন দরকার। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন এই মন্তব্য করেছেন।
সোমবার (২৫ মার্চ) তিনি তার ‘বাংলাদেশের অগ্রযাত্রায় আগামীর করণীয়: জাতীয় সপ্তবার্ষিক কর্মপরিকল্পনার একটি প্রস্তাবিত রূপরেখা’ গ্রন্থের আলোচনা অনুষ্ঠানে এ কথা বলেন। বইটি প্রকাশ করেছে দি ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড (ইউপিএল)।
ফরাসউদ্দিন বলেন, বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে ও তার আস্থাভাজন হিসেবে কাজ করেছি। অনেক কাছ থেকে তার কাজ দেখেছি। তার কাজের সেসব বিষয় জোর দিয়ে লেখা জরুরি বলে মনে করছি। আবার কিছু পুরনো বিষয় যা জনসম্মুখে প্রকাশ করা দরকার, সেজন্যও লিখতে হয়েছে। আমরা বাঙালিরা কোনটা জনগণের জন্য মঙ্গলজনক হবে সেটা জানি। কিন্তু এটা বাস্তবায়ন করতে হলে জাতির জনক তার ফিস্কেল পলিসিতে বলেছিলেন, ধনীদের কাছ থেকে বেশি হারে ট্যাক্স আদায় করে সেই অর্থ দিয়ে বিত্তহীন ও কম বিত্তের লোকদের জন্য প্রকল্প করতে হবে। সেটি এখন করতে পারছি না। তিনি বলেন, আড়াই কোটি লোকের ট্যাক্স নেওয়ার কথা। সেখানে দেশে ৮৭ লাখ অতি ধনী, তাদের মধ্যে মাত্র ৯ লাখ লোক ট্যাক্স দেন। ব্যাংকে যত আমানত আছে তার অর্ধেক হচ্ছে কোটিপতিদের। অগ্রগতিটা সমতাভিত্তিক হতে হবে। মাত্র কয়েকজনের কাছে অর্থ তুলে দেবে তা আমি বিশ্বাস করি না। আমাদের অগ্রগতি সর্বজনীন হওয়া দরকার।
বৈষম্য সম্পর্কে তিনি বলেন, দেশে বৈষম্য আছে, তবে দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশে সবচেয়ে কম। গত ৪০ বছর আগে যে দরিদ্রতা ছিল সে তুলনায় আজ অনেক ভালো আছে। যিনি ধনী ছিলেন তিনি আরো ধনী হয়েছেন। তাকে রুখে দেওয়ার মতো, দেশের বাইরে অর্থ নিয়ে যাওয়ার রাস্তা বন্ধ করে দেওয়ার মতো অল্প কয়েকজন মানুষ আছে। মুষ্টিমেয় কিছু লোক বলছে, তারা শিল্পপতি ও বাণিজ্যের প্রতিনিধিত্ব করে—এটি একেবারে সত্য কথা নয়। বিরাট সংখ্যাগরিষ্ঠ শিল্পপতি এবং ব্যবসায়ী মনে করে, কিছু বিষয় ঠিক হচ্ছে না। কর ফাঁকি দেওয়া, ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে ফেরত না দেওয়া, অর্থপাচারসহ যে অন্যায়গুলো হচ্ছে তা কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা দরকার। বাংলাদেশের বড় সমস্যা মধ্যস্বত্বভোগী। চুয়াত্তরে দুর্ভিক্ষ হয়েছিল মধ্যস্বত্বভোগীদের জন্য। মুদ্রা পাচার করে মধ্যসত্বভোগীদের কারণে। এখন বছরে ৭০০ কোটি মার্কিন ডলার বিদেশে চলে যায়। এটাকে রাজনৈতিক সদিচ্ছা বলব নাকি কৃতসংকল্প বলব সেটি আমি জানি না।
তিনি বলেন, আমার একটি লেখায় বলেছিলাম, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ইতোমধ্যে ভালো প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন। তার রাষ্ট্রের বাইরে স্টেসসম্যান হওয়ার সময় এসেছে। তার এখন আর চাওয়ার ও পাওয়ার কিছু নাই। যা চাওয়া ও পাওয়ার ছিল তা পেয়ে গেছেন। এজন্য শেখ হাসিনাকে বৃত্তের বাইরে বের হয়ে আসতে হবে। তিনি কতটুকু বৃত্তের বাইরে বেরিয়ে আসতে পারবেন তা আমি জানি না। যদি বৃত্তের বাইরে এসে কাজ করেন তাহলে ২০৩০ সালে মধ্যে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছানো সম্ভব। বৃত্তের বাইরে বলতে উন্নয়ন বিষয়কে বুঝিয়েছেন বলে মন্তব্য করেন মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন।
সাবেক গভর্নর বলেন, প্রধানমন্ত্রী একটি চক্রের বাইরে এসে জনকল্যাণের কথা চিন্তা করেছেন, অনেক কাজ করেছেন। আরো ভালো কাজ হবে যদি তিনি সমস্ত ক্ষমতা ঢাকায় কেন্দ্রীভূত না করে প্রদেশ করেন। তা ছাড়া গভর্নরের পদটি একটি কনস্টিটিউশনাল পদ হোক অথবা ছয় বছরের জন্য একটি টার্মে নিয়োগ দেওয়া হোক। যাতে তাকে অন্য কারো কাছে সময় বৃদ্ধির জন্য যেতে না হয়।
অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য রাখেন সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) ডিস্টিংগুইশড ফেলো অধ্যাপক ড. রওনক জাহান, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক আব্দুল বায়েস ও একাত্তর টেলিভিশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোজাম্মেল হক বাবু, ইউপিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাহ্রুখ মহিউদ্দীন প্রমুখ।
রওনক জাহান বলেন, বইয়ে অনেকগুলো কমিশন করার কথা বলা হয়েছে। এমনকি পুরানো কমিশনগুলো সচল করার কথাও বলা হয়েছে। কিন্তু দেশের অভিজ্ঞতায় আমরা জানি যে, কমিশন করলেও সেগুলো কার্যকর থাকছে না। এখানে দুর্নীতি দমন কমিশন, মানবাধিকার কমিশন আছে। এগুলো স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারছে কি না তা গুরুত্বপূর্ণ। স্বাধীনভাবে কাজ করতে চাইলে তার চাকরি থাকছে না।
অধ্যাপক আব্দুল বায়েস বলেন, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে টিসিবির কার্যকর ভূমিকা নিয়ে লেখক বলেছেন। বাংলাদেশে সমবায় পদ্ধতি কেন জরুরি, তার বাস্তবান ও দুর্নীতি দূর করার বিষয়ে বলেছেন। মোজাম্মেল হক বাবু বলেন, বইটি সুশাসনের নির্দেশিকা। দেশে একটি ‘সুস্থ মুক্তবাজার’ দরকার। এখন ‘অসুস্থ মুক্তবাজার’ বিরাজ করছে। দেশে সব সেক্টরের যা কিছু অর্জন হচ্ছে তা ‘লিক’ বা ফুটো দিয়ে বের হয়ে যাচ্ছে। এই লিকেজ বন্ধ না করা গেলে উন্নয়ন ধরে রাখা যাবে না।